ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ ফারুক হোসেন

ফের পলিথিনের অবাধ ব্যবহার

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ফের পলিথিনের অবাধ ব্যবহার

স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ফের চলছে পলিথিন ব্যাগের অবাধ ব্যবহার। এমন এলাকা পাওয়া দুষ্কর, যেখানে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নেই। প্রকাশ্যে এখন এর ব্যবহার চলছে দেদার। সহজলভ্য ও ব্যবহারে সুবিধা বিধায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই অভ্যস্ত এটি ব্যবহার করতে। অভিজাত রেস্টুরেন্ট, মুদির দোকান, কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে ফুটপাথের প্রায় সব দোকানের পণ্য বহনে ব্যবহৃত হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণায় নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রার্থীরা নিজেদের পোস্টারগুলো দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য পলিথিন মুড়িয়ে এলাকার বিভিন্ন স্থানে ঝুলিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালান। সর্বত্রই নিষিদ্ধ পলিথিনের ছোট-বড় ব্যাগের ছড়াছড়ি। পলিথিনের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ থাকার পরও কেবল রাজধানী ঢাকাতেই দৈনিক ব্যবহৃত হচ্ছে ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন। হিসাব মতে প্রতিমাসে ব্যবহার হচ্ছে ৪২ কোটি পিস পলিথিন। সারাদেশে তা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারী আকারে। যৌথভাবে এ তথ্য জানিয়েছে, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-পবাসহ ১৭টি পরিবেশবাদী সংগঠন। তবে আগের পলিথিন ব্যাগে হাতল ছিল, এখন হাতল ছাড়া পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। আর প্রকাশ্যেই আইন ভঙ্গ করে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে ২০০২ সালে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করে সরকার। ওই বছরের ১ জানুয়ারি ঢাকা ও ১ মার্চ সারাদেশে পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পলিথিন তৈরির কারখানাগুলোর বেশিরভাগই পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক। ঢাকার পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, কামরাঙ্গীচর ও টঙ্গীতে বেশকিছু কারখানা রয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা। স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও পরিবেশবাদীদের মতে, পলিথিন অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে অবিকৃত অবস্থায় থেকে মাটিতে সূর্যালোক, পানি ও অন্যান্য উপাদান প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। পচে না বলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যায় ও উপকারী ব্যাকটেরিয়া বিস্তারে বাধা তৈরি করে। এছাড়া পলিথিন মোড়ানো গরম খাবার খেলে মানুষের ক্যান্সার ও চর্মরোগের সংক্রমণ হতে পারে। পলিথিনে মাছ ও মাংস প্যাকিং করলে তাতে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়, যা দ্রুত পচনে সহায়তা করে। অন্যদিকে, উজ্জ্বল রঙের পলিথিনে রয়েছে সিসা ও ক্যাডমিয়াম, যার সংস্পর্শে শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত ও চর্মপ্রদাহের সৃষ্টি হয়। মাটিকে উত্তপ্ত করা ও গাছের মূল মাটির গভীরে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাঁধার সৃষ্টি করে পলিথিন। পুকুরের তলদেশে জমে থাকা পলিথিন মাছ ও জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব সঙ্কট সৃষ্টি করে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ ও বালু নদীর তলদেশে জমে থাকা কয়েক ফুট পলিথিনের স্তর নদীর তলদেশের পলি আটকিয়ে শুধু নদীর নাব্যই নষ্ট করছে না বরং মাছ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে পানিতে স্বাভাবিক অক্সিজেনের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস করছে। কৃষি পলিথিন ব্যাগ জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। ঢাকা শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের ৮০ ভাগ ড্রেন পলিথিন ব্যাগ কর্তৃক জমাট বেঁধে আছে। যার দরুন সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরে দেখা দেয় অসহনীয় জলাবদ্ধতা। বৃষ্টির সময় অনেক ম্যানহোল থেকে শত শত পলিথিন ভেসে বের হতে দেখা যায়। ড্রেনেজ সিস্টেমকে সর্বদাই অচল করে রাখে। সম্প্রতি ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার তলদেশ থেকে বর্জ্য অপসারণের যে কর্মসূচী নেয়া হয়েছিল তাতে দেখা যায় যে, উত্তোলনকৃত বর্জ্যরে অধিকাংশই পলিথিন ব্যাগ। আগে থেকে সর্বনাশা পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হলে নদীর তলদেশ থেকে বর্জ্য উত্তোলনের জন্য ২০৬ কোটি টাকা বাজেট করতে হতো না। বেঁচে যেত সরকারের ২০৬ কোটি টাকা, যা একটি উন্নয়নশীল গরিব দেশের জন্য বিরাট ব্যাপার। শুধু বুড়িগঙ্গাই নয় বরং ঢাকার চারদিক দিয়ে প্রবাহিত সকল নদীর তলদেশেই পলিথিনের দূষণ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চলছে লাগামহীনভাবে। কৃষিক্ষেত্রে পলিথিন ব্যাগ সূর্যের আলোকে ফসলের গোড়ায় পৌঁছতে বাধা দেয়। ফলে মাটির ক্ষতিকারক ব্যাকেটরিয়া মরছে না বলে কৃষিজমিতে উৎপাদন কমে আসছে। এসব বিষয়ে বিবেচনায় রেখে বর্তমান সরকার পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধে ৬টি পণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহনে পাটের বস্তা ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। এই অভিযানের ফলে সারাদেশে পাটের বস্তার ব্যবহার বেড়েছে বলে জানা যায়। পলিথিন বর্জনের প্রথম পদক্ষেপই হচ্ছেÑ পাটের ব্যবহার নিশ্চিত করা। প্রাথমিক পর্যায়ে গত বছরের ৩০ নবেম্বর থেকে চাল, ডাল, গম, ভুট্টা, চিনি ও সার এ ৬টি পণ্যে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ওই ৬ পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেয়া না হলে ব্যাংক ঋণ দেয়া হবে না। বাতিল করা হবে এলসি এবং খাদ্য বিভাগের আওতাধীন ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স। এই পলিথিনের স্থলে পাট, কাগজ ও চটের ব্যাগ যা সহজে মাটিতে পচনশীল সেগুলো ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। এগুলো পচলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে যেসব মালিকদের পলিথিন উৎপাদনের কারখানা রয়েছে তাদের পাটের ব্যাগ তৈরির মেশিন ক্রয়ে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে তারা আগ্রহী হবে। দেশের সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পলিথিন আসতে না পারে সেটিও নজরদারিতে রাখতে হবে। কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙ্গা সহজলভ্য করার জন্য উদ্যোগ নেয়াসহ মনিটরিং টিম বাড়াতে হবে এবং অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার বন্ধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা প্রয়োজন। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সারাদেশে ক্যাম্পেইন, মাইকিং, পোস্টার, লিফলেট বিতরণ করতে হবে। প্রতিটি মহল্লায় ছোট-বড় সব ধরনের দোকানে অভিযান পরিচালনাসহ শপিংমল থেকে ফুটপাথের অস্থায়ী দোকানসহ সর্বত্র যাদের কাছেই পলিথিন পাওয়া যাবে সকলকে জরিমানার আওতায় নিয়ে আসলে হয়ত এর ব্যবহার কমবে। সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে মার্কেটসমূহে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা তা নিয়মিত মনিটরিং করা একান্ত প্রয়োজন। সর্বোপরি পলিথিন ব্যবহার বন্ধে চাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পরিবেশ। পরিবেশ ক্ষতির সম্মুখীন হলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। কাজেই পরিবেশ রক্ষায় আমাদের অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে। সেজন্য প্রথম কাজ হবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।
×