ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বস্তিবাসীর জীবন কাহিনী শেষ

মশা মাছি রোগ বালাই নিত্যসঙ্গী

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

মশা মাছি রোগ বালাই নিত্যসঙ্গী

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বস্তির জীবন যাপনে মশা মাছি রোগ বালাই নিত্য সঙ্গী। অনেক শিশু মাঝে মধ্যেই বস্তির নোংরা পরিবেশের কারণে ডায়রিয়া, আমাশয়, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, ডেঙ্গু জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না বড়রাও। বস্তির কারণে ঢাকায় টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বিশ্বের অন্য যে কোন দেশের তুলনায় বেশি। বস্তির নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক শিশুর মৃত্যুও হয়। শুধু রোগ বালাই নয়, বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এক বিহারী দম্পতির এক শিশু মৃত্যুর সূত্র ধরে ২০১৪ সালে পল্লবীতে বিহারী ক্যাম্পে আগুন পুড়িয়ে ৯ জনকে হত্যার আলোচিত ঘটনা ঘটে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, এখনই বস্তির বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। অন্যথায় বস্তি পরিবেশের ভারসাম্য রীতিমতো আরও হুমকির মুখে ফেলে দেবে। ২০১৪ সালের ১৩ জুন পবিত্র শব-ই-বরাতের রাতে রাজধানীর পল্লবী থানাধীন ১২ নম্বরের ই ব্লকের কালশী সড়কের পাশে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের কুর্মিটোলা ক্যাম্পের ৭টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দিলে দগ্ধ হয়ে নারী ও শিশুসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার সূত্র ধরে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে আরও একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তার রেশ ধরে টানা একসপ্তাহ ধরে রাস্তা অবরোধ ও পুলিশের সঙ্গে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সংঘর্ষ হয়। ঘটনাটি দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিষয়টির তদন্ত করে একাধিক সংস্থা। তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাতে দেখা যায়, বিহারী ক্যাম্পের পূর্ব পাশে কালশী নতুন রাস্তার ঢালে বিহারী-বাঙালী যৌথ ক্যাম্প নামে একটি বাসস্থান রয়েছে। সেখানে বিদ্যুত সরবরাহের নিজস্ব কোন ব্যবস্থা নেই। কালশী বিহারী ক্যাম্পের জন্য বরাদ্দকৃত ট্রান্সফরমার থেকে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে ক্যাম্পটি আলোকিত ছিল। এ নিয়ে বিহারী ক্যাম্পের সঙ্গে রাস্তার ঢালের ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে ঘটনার এক সপ্তাহ আগ থেকে চরম বিবাদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে বিদ্যুত সংযোগ বন্ধ করে দেয় তারা। তখন প্রচ- গরম চলছিল। প্রচ- গরমের মধ্যে বিদ্যুত না থাকায় রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন বিহারী-বাঙালী ক্যাম্পের বাসিন্দারা। একদিকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, তার ওপর আবার বিদ্যুত না থাকায় সিদ্ধ ছাড়াই দোষিত পানি পান করানোর কারণে বিহারী-বাঙালী বস্তির অনেক শিশু ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে এক বিহারী দম্পতির এক নবজাতক ডায়রিয়ায় মারা যায়। এমন ঘটনায় যেন জ্বলন্ত আগুনে ঘি পড়ে। তারা কালশী বিহারী ক্যাম্পের বাসিন্দাদের কারণেই নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে বলে দোষারোপ করতে থাকেন। আটকে পড়া পাকিস্তানী হয়ে আরেক আটকে পড়া পাকিস্তানীর এক সর্বনাশ তারা মেনে নিতে পারেননি। এরপর বিহারী-বাঙালী যৌথ ক্যাম্পের বাসিন্দারা জোটবদ্ধ হন। তারই জের ধরে শব-ই-বরাতের রাতে দুই ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে আতশবাজি খেলাকে নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে বিহারী-বাঙালী ক্যাম্পের আটকে পড়া শতাধিক পাকিস্তানী ক্ষিপ্ত হয়ে নবজাতক মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবে ৭টি ঘরে বাইর থেকে ছিটকিনি আটকে দিয়ে আগুন দিলে ৯ জনের মৃত্যু হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকার অধিকাংশ বস্তির সঙ্গে ডোবা, নর্দমা, পরিত্যক্ত খাল বা ঝিল রয়েছে। এর ওপর অস্থায়ীভাবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে শত পায়খানা। এসব পায়খানার মলমূত্র সরাসরি ডোবার পানিতে গিয়ে পড়ছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত এসব নর্দমা, ডোবা বা পরিত্যক্ত খালে ফেলা হচ্ছে আর্বজনা। ফলে পুরো এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। বস্তির কারণে ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান ও উত্তরায় ব্যাপক পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এর মধ্যে কড়াইল বস্তির কারণে গুলশান লেক ও এর আশপাশের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। গুলশান লেকে জমে আছে হাজারো রকমের আবর্জনা। দেখলে মনে হয়, লেকে পানি নেই। আছে শুধু ময়লা আবর্জনা। কড়াইল বস্তির কয়েক শ’ মলমূত্র ত্যাগ করার জায়গা সরাসরি স্থাপন করা হয়েছে লেকের ওপর। একই অবস্থা উত্তরায়ও। দেশের প্রায় চারভাগের এক ভাগ বস্তিই গড়ে ওঠেছে পরিত্যক্ত ডোবা, নর্দমা, খাল বা ঝিলের পাড়ে। ঢাকার ১১০টি বস্তির অন্তত ৭০টির পাশেই পরিত্যক্ত জলাশয় রয়েছে। এসব বস্তি থেকে মলমূত্রসহ নানা ধরনের বর্জ্য প্রতিনিয়ত ডোবায় ফেলা হচ্ছে। সব বস্তি ঘিরেই একই চিত্র। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী মোঃ আব্দুস সোবহানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বস্তির বিষয়ে সরকারের এখনই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় দেশের পরিবেশ আরও মারাত্মকভাবে বিঘিœত হবে। পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেয়াও বিচিত্র নয়। কারণ বস্তির কারণে প্রতিদিন ঢাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ময়লা, আবর্জনা আর মলমূত্রের কারণে ইতোমধ্যেই গুলশান ও উত্তরা এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে বলে আমাদের পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। সরকারের এখনই উচিত নতুন করে বস্তিতে যাতে আর কেউ বসবাস করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। আর বস্তিগুলোতে স্বাস্থ্যমতো বাথরুম তৈরি করে দেয়া। অন্যথায় গুলশান ও উত্তরা এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। মহাখালী আইসিডিডিআরবির হিসাব অনুযায়ী গরমকালে ঢাকায় ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্তদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসব শিশুদের অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের। যাদের বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের বেশির ভাগেরই বসবাস রাজধানীর বস্তি, বস্তির মতো ঘিঞ্জি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাহজাদা সেলিম জনকণ্ঠকে বলেন, বস্তি পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে জন্ডিস, টাইফয়েড, আমাশয়, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, এইডস, কৃমিসহ নানা ধরনের চর্ম রোগ হয়ে থাকে। একমাত্র বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে বিশ্বের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই টাইফয়েডের ক্ষেত্রে প্রায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে মাদক নির্ভর নানা দূরারোগ্য ব্যাধির জন্ম হচ্ছে বস্তির কারণেই। যা গোটা সমাজ ব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। মাদক ছড়িয়ে পড়ার কারণে স্বাভাবিক কারণেই রোগ বালাইও ছড়াচ্ছে। এছাড়া সেনিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিনিয়ত নানা ধরনের রোগ বালাই ছড়াচ্ছে। পরিবেশের মারাত্মক দূষণ ঘটছে। অন্যদিকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বস্তিতে একেবারেই মুখথুবড়ে পড়েছে। যা দেশে পুষ্টিহীন শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছে। বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভয়াবহ হারে মশা মাছিসহ নানা পোকা মাকড় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব প্রাণী নানা রোগ জীবাণু বহন করছে। যা থেকে মানুষও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আর যাতে কেউ বস্তি এসে বসবাস করতে না পারে এজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
×