ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ময়মনসিংহে বিসিকের শিল্প প্লটে দুই দশকেও উৎপাদনে যায়নি অনেকে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ময়মনসিংহে বিসিকের শিল্প প্লটে দুই দশকেও  উৎপাদনে যায়নি অনেকে

বাবুুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ শহরের মাসকান্দা বিসিক শিল্প নগরীতে শিল্প স্থাপনের শর্তে গত দুই দশক আগে প্লট নেয় মিতা ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই প্লটে কোন নির্মাণ কাজই শুরু করা হয়নি! একই অবস্থা এইচ কে ট্রেডার্সের। তবে এই প্লটের একাংশে সম্প্রতি শর্ত ভেঙ্গে মুড়ির কারখানা করা হয়েছে। প্লটের বাকি সিংহভাগ পতিত ফেলে রাখা হয়েছে। সুপার কেবল ইন্ডাস্ট্রিজের নামে প্লট নিয়ে নির্মাণ কাজ করার পর আর কোন অগ্রগতি নেই। ইব্রাহীম ফ্লাওয়ার মিলসের কাছ থেকে কেনা রানার মটর্স ও আরেক জনের কাছ থেকে কেনা এম রহমান ইন্ডাস্ট্রিজ শিল্প স্থাপন না করে ব্যবহার করা হচ্ছে গুদামঘর হিসেবে। এ রকম প্রায় অর্ধশত প্লট বরাদ্দ নিয়ে এভাবেই বছরের পর বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে এ রকম অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের নাম বিসিকের কালো তালিকায় নেই! স্থানীয় প্রশাসন ও বিসিক কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে শিল্প স্থাপন না করে বছরের পর বছর ধরে শর্ত ভঙ্গ করে এলেও কারও প্লট বাতিল হয়েছে এমন নজির নেই। ফলে অনেক ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তা একদিকে বিসিকে প্লট পাচ্ছে না, অন্যদিকে বরাদ্দের প্লটে শিল্প স্থাপন না করায় কোন কাজেই আসছে না বিসিকের মূল্যবান জমি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ স্থানীয় ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তারা। জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ (নাসিব) ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি ও বিসিকের মেসার্স আসগর এ্যান্ড সন্স স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক অধ্যক্ষ গোলাম সরওয়ার জানান, বিসিকের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের আইনী বেড়াজাল ও অসহযোগিতার কারণেই বিসিকের এই বেহাল দশা। এর বাইরে কতিপয় প্লট মালিক এতটাই প্রভাবশালী যে বিসিকের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে সাহস পায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি। স্থানীয় সূত্র জানায়, ১০ দশমিক ৮১ একর জায়গা নিয়ে বিগত ১৯৬৮ সালে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে শহরের মাসকান্দা বাণিজ্যিক এলাকায় যাত্রা শুরু করে ময়মনসিংহ বিসিক। পরে আরও ৯ দশমিক ৬২ একর জায়গা নিয়ে সম্প্রসারিত করা হয় বিসিক শিল্প নগরীর পরিধি। বর্তমানে পুরনো ৫৫ প্লট ও নতুন ৫০ প্লটসহ মোট ১০৫ প্লট রয়েছে ময়মনসিংহ বিসিকের। ২০ দশমিক ৪৩ একর জায়গা জুড়ে বিসিকের ১০৫ প্লটের মধ্যে ৭৫টিতে ছোট বড় শিল্প-কারখানা চালু রয়েছে বলে দাবি করেছে বিসিকের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। এসব প্লটে ওষুধ, ছাপাখানা, জর্দা, বেকারি, তেলের মিল, চানাচুর ও মুড়ির কারখানাসহ বাহারি পণ্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে। ১৫ প্লটের শিল্প রুগ্ন এবং বাকি প্লট পরিত্যক্ত বলে দেখানো হয়েছে বিসিকের তালিকায়। এর মধ্যে দীর্ঘ ১৮ বছর উৎপাদনে গেছে লিমা রাইস মিল ও সৃজন ইন্ডাস্ট্রি। বরাদ্দপত্রের ১২ ধারা মতে ১৮ মাসের মধ্যে কোন প্লটে কোন শিল্প স্থাপন না হলে প্লট বাতিলের বিধান রয়েছে। প্রতি দুই মাস পর পর প্লট বরাদ্দ কমিটির সভায় বিষয়টি মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, বাস্তবে অর্ধশত প্লটে কোন শিল্প-কারখানা স্থাপন না করে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। অথচ বিসিকের কালো তালিকায় এসব প্লট মালিকের কোন নাম নেই! নামকাওয়াস্তে হাতেগুনা কয়েক প্লট বিসিকের রেকর্ডে দেখানো হচ্ছে। বিসিকের দাবি মিতা ফুডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এম রহমান ও রানার মটর্সকে উচ্ছেদের নোটিস দেয়া হয়েছে বলে জানান বিসিকের এস্টেট কর্মকর্তা মোঃ শামসুদ্দীন। সরেজমিন বিসিকে গিয়ে দেখা গেছে, পরিত্যক্ত প্লটের ভেতর গুদাম বানিয়ে ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। কোনটির আংশিক নির্মাণ কাজ শেষ করে ফেলে রাখা হয়েছে। পরিত্যক্ত প্লটের ভেতর দিনে দুপুরে আড্ডা জমিয়ে তুলছে নেশাখোর মাদকাসক্তরা। আবার বরাদ্দের শর্ত লঙ্ঘন করে কোনটি ব্যবহার করা হচ্ছে বাসা বাড়ি হিসেবে। জয়নাল আবেদিনের নামে বরাদ্দ করা এইচকে ট্রেডার্সের প্লটে অনুমোদন ছাড়াই কারখানা ভাড়া দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে লে আউট প্ল্যান বহির্ভূত সাড়ে ৫ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর নির্মাণ কাজ চলছে। কারখানার ভেতরে তেল ও মুড়ির মিল দেয়া হয়েছে অনুমোদন ছাড়াই। মিসেস জান্নাতুল ফেরদৌসের নামে বরাদ্দ দেয়া মিতা গার্মেন্টস চালু না করে ফেলে রাখা হয়েছে। নির্মাণ কাজও মাঝপথে। সীমানা প্রাচীর ও ড্রেনের ওপর ভবন নির্মাণেরও অভিযোগ রয়েছে এই প্লট মালিকের বিরুদ্ধে। বিগত ১৯৭৯ সালে সাড়ে ১৩ হাজার বর্গফুটের প্লট নিয়ে সাজ্জাতুল জুম্মা ফ্রেসকো ফ্লাওয়ার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড আটা-ময়দা-সুজি তৈরির কারখানা চালু করলেও পরে সেটি বন্ধ রয়েছে। প্লট মালিকের কাছে বিসিকের সার্ভিস চার্জ বাবদ পাওনা রয়েছে ২ লাখ টাকার ওপরে। বিসিকের সভায় একাধিকবার এসব প্লট বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও তা অদৃশ্যকারণে কার্যকর হয়নি। নোমান আহমদ খানের নামে বরাদ্দ দেয়া ৯ হাজার বর্গফুটের একটি প্লটে সৃজন ইন্ডাস্ট্রিজ নামে কারখানা দিলেও পরে তা চালু করা হয়নি। এ সময় প্লট মালিকের নামে সার্ভিজ চার্জের বকেয়া প্রায় ৩ লাখ টাকা আদায়েও কোন অগ্রগতি নেই বিসিকের। ১৮ হাজার বর্গফুটের প্লট নিয়ে মাজাহরুল হক বেগ বেগ রয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এ সময় বিসিকের অনুমোদন ছাড়াই গোপনে ভাড়া দেয়া হয়েছিল গুদামঘর হিসেবে। এই প্লট মালিকের বিরুদ্ধেও মোটা অঙ্কের সার্ভিস চার্জ বকেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ছয় হাজার বর্গফুটের প্লট বরাদ্দ নিয়ে এখনও কিস্তি পরিশোধ করেননি শেলী এন্টারপ্রাইজের মালিক শফিকুল ইসলাম ফরাজী। প্লট মালিকের নামে কিস্তির ও সার্ভিস চার্জের বকেয়ার অঙ্ক ৫ লাখ টাকার ওপরে। নয় হাজার বর্গফুটের প্লট নিয়ে পাকিজা ইলেকট্রিক্যাল কোং না করে অর্ধেক জায়গা পতিত রেখে দিয়েছেন নঈম উদ্দিন। অভিযোগ লে আউট বহির্ভূত ৩ হাজার বর্গফুটের ওপর অনুমোদিত ইলেকট্রিক পণ্য তৈরি না করে চানাচুর তৈরির কারখানা দেয়া হয়েছে। বাকি ৬ হাজার বর্গফুট ফেলে রাখা হয়েছে। এ রকম নানা অনিয়মসহ শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে মেসার্স রাজা বাড়ীয়া কেমিক্যালস, বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স পিএলওয়েল মিল ও লক্ষ্মী এন্টারপ্রাইজসহ অনেক প্লট মালিকের বিরুদ্ধে। রাজাবাড়ীয়া কেমিক্যালস খাতের কারখানা নির্মাণ না করে টিনশেডের ঘর নির্মাণ করে কর্মচারীদের কাছে মেস হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে একাংশে। বিসিকের জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটির প্রতিটি সভায় এক ডজনেরও বেশি প্লট বাতিলের সুপারিশ করা হলেও পরে তা আলোরমুখ দেখে না। অগ্রগতি নেই মোটা অঙ্কের বকেয়া আদায়েও। প্রচার রয়েছে বিসিকের স্থানীয় কর্মকর্তার যোগসাজসে অসাধু প্লট মালিকেরা বছরের পর বছর ধরে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে বরাদ্দের প্লট নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে নতুন শিল্প উদ্যোক্তারা শিল্প স্থাপনে বিসিকের কোন প্লট পাচ্ছেন না।
×