ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চাঁদাবাজিতে জড়িত পুলিশ ও ওয়ার্ড কমিশনারের মস্তানরা

হকারদের দখলে ফুটওভারব্রিজ

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

হকারদের দখলে ফুটওভারব্রিজ

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ জনসাধারণের রাস্তা পারাপারের জন্য রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড় বা স্থানে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে তার ভিন্ন ঘটনা। ব্রিজগুলো হকারদের ব্যবসার অন্যতম স্থানে পরিণত হয়েছে। পণ্যের পসরা সাজিয়ে হকাররা দখল করেছেন পথচারীর ব্যবহার্য বেশিরভাগ ব্রিজ। মানুষের হাঁটাচলা তো দূরের কথা, বিড়ম্বনা হতে পারেÑ এই শঙ্কায় ব্রিজে কেউ পারতপক্ষে উঠতে চান না। অনেক ওভারব্রিজ আবার নেশাগ্রস্তরা দখলে রেখেছে। ব্রিজ ব্যবহার করতে না পারায় অনেকেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন বলে অভিজ্ঞজনরা মত দিয়েছেন। থানা-পুলিশ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ চাঁদা আদায় নেপথ্যে থাকায় ব্রিজগুলো দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সামনে (বিএসএমএমইউ) কাজী নজরুল ইসলাম এ্যাভিনিউয়ের ওপর ফুটওভারব্রিজের ওঠানামার রাস্তা ফাঁকা। কিন্তু ওপরে উঠলেই দেখা যাবে, হকারদের পণ্যের পসরা। আমড়া, মুঠোফোনের ব্যাগ, বাচ্চাদের খেলনা, চুড়ি-ক্লিপ-লিপস্টিক, জুতা বিক্রেতাসহ ৫০ জনের মতো হকার পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করছেন। কথা হয় আমড়া বিক্রেতা আখতার মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন ব্রিজের ওপর ব্যবসা করছি। এ জন্য লাইনম্যানকে প্রতিদিন ২০ টাকা করে দিতে হয়। দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করব, সে টাকাও নেই। তাই এখানে বসেছি।’ এ সময় পথচারীদের চলাচলে অসুবিধা পরিলক্ষিত হয়। পরীবাগের এক বাসিন্দা জানান, দোকানের আধিক্যে ওভারব্রিজ দিয়ে হাঁটা যায় না। আরেকজন জানান, যখন তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চান, তখন এসব ব্যবসায়ীর কারণে চলাচলে অসুবিধা হয়। বিক্রেতারা জানান, দোকানের কারণে মানুষের হাঁটাচলায় সামান্য অসুবিধা হলেও অল্প দামে এখানে সবকিছু পাচ্ছেন। তাই অনেকে জামাকাপড় ছাড়া চিরুনি, ফিতা, ব্যাগ এখান থেকেই কেনেন। চুড়ি বিক্রেতা ইদ্রিস জানান, ব্রিজের ওপর দখল হওয়ায় মানুষ এখানে আসতে চায় না। আর কমলাপুর ব্রিজের বেশিরভাগ জায়গাজুড়ে নিত্যপণ্য থেকে সবজি-ফল পর্যন্ত বিক্রি করছে হকাররা। এই ব্রিজে সব সময় ৫০ জনের বেশি হকার থাকে বলে স্ট্রবেরি বিক্রেতা কামাল জানান। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘পেটের জন্য এখানে ব্যবসা করি।’ অন্য সময় না হলেও অফিস সময় এখান দিয়ে পথচারীদের বেগ পেতে হয় বলেই জানান তিনি। এ জন্য দোকানপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হয়। এ টাকা সবুজকাননের জাহাঙ্গীর তোলে বলে অনেকেই জানান। ফার্মগেটে ফুটওভার ব্রিজগুলোর অর্ধেক জায়গা এখন হকারদের দখলে। আর বিমানবন্দর স্টেশনসংলগ্ন ব্রিজটি মাঝে মধ্যে হকারমুক্ত থাকলেও বেশিরভাগ সময় পুরো ব্রিজটি হকাররা দখলে রেখে ব্যবসা করছেন। প্রায়ই দিনই তাদের কারণে ব্রিজ দিয়ে হেঁটে যেতে সমস্যা হয় বলে বিমানবন্দরের এক সরকারী চাকুরে আলাপে জানান। একই অবস্থা নিউমার্কেট, শাহবাগ, মিরপুর-১ ও ১০ নম্বরের ব্রিজসহ বেশিরভাগ ফুটওভারব্রিজের। রমনা পার্ক, বাংলামোটরসহ আরও কয়েকটি ব্রিজে পথচারীরা তেমন ওঠে না। ব্রিজগুলো মাদকসেবনকারী এবং ছিন্নমূল মানুষ দখলে রেখেছে। অপরিচ্ছন্ন থাকায় হাঁটাও দুষ্কর। সিটি কর্পোরেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ১২৮টির বেশি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ফুটওভারব্রিজ আছে ৮৭টি। আন্ডারপাস আছে ৩টি। এ ছাড়া আরও কয়েকটির নির্মাণকাজ চলছে। পথচারীদের ঝুঁকি নিয়ে যেন সড়ক পার হতে না হয়, সে জন্য ব্রিজগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। অচিরেই ব্রিজগুলো হকারমুক্ত করতে অভিযান শুরু হবে বলে মেয়র সাঈদ খোকন নিশ্চিত করেন। ফার্মগেটে ট্রাফিক সার্জেন্ট কেরামতের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, মানুষ ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করে রাস্তা দিয়ে পার হওয়ায় গাড়িগুলোর গতি কমে যায়। আবার ফুটওভারব্রিজে হকার বসে থাকায় মানুষও সেখান দিয়ে পার হতে চায় না। এতে অনেক সময় দুর্ঘটনার শিকার হন পথচারীরা। হকারদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, রাজধানীর সব ব্রিজ এক সমান নয়। এ কারণে কোনটিতে ২০ কিংবা ৫০ জন বা তার বেশিও দোকান বসে। তবে প্রতিটি দোকান থেকে চাঁদা তোলার জন্য এলাকাভিত্তিক লাইনম্যান নিয়োগ করা আছে। এই লাইনম্যান কোন কোন দোকান থেকে প্রতিদিন ২০, ৩০ কিংবা স্থানভেদে ৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করেন। সে ক্ষেত্রে পুরো রাজধানী থেকে বিপুল পরিমাণ চাঁদার টাকা আদায় করা হয় প্রতিদিন। এই টাকা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং থানা-পুলিশের কাছে চলে যায়। বিশেষ করে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার, তার মস্তান বাহিনী ও স্ব-স্ব এলাকার থানা পুলিশ ভাগবাটোয়ারা করে খায়। এটাই শেষ নয়, ঢাকা শহরের প্রতিটি এলাকায় তিনজন করে পুলিশ ও আনসার সদস্য টহল দেয়। তারাও মস্তানদের মতো যার যার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা থেকে হকারপ্রতি ৫ বা ১০ টাকা করে চাঁদা তোলে। সম্প্রতি মোহাম্মদপুর সেন্ট জোসেফ হাইস্কুলের সামনে এক বাদাম বিক্রেতাকে হকারদের কাছ থেকে ৫ টাকা করে চাঁদা তুলে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যকে দিতে দেখা গেছে। ফলে এই চাঁদার ভাগ বাটোয়ারার কারণেই হকার উচ্ছেদ বন্ধ করা যায় না। হঠাৎ তাদের উচ্ছেদ করা হলেও চাঁদা আদায়কারীরাই আবার বসার সুযোগ করে দেয় নিজেদের স্বার্থে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি গণমাধ্যম) মারুফ হাসান বলেন, কোন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে তদন্তপূর্বক অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কার এত ঠেকা পড়েছে যে, স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার, রাজনৈতিক নেতা বা পুলিশ সদস্যদের চাঁদাবাজির অভিযোগ গিয়ে পুলিশের কাছে জানানোর। এতে উল্টো অভিযোগকারীকেই হয়রানির মুখে পড়তে হয় বরং পুলিশের এই চাঁদাবাজি বন্ধে পৃথক ইন্টিলিজেন্ট ইউনিট গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। সমাজের আইনশৃঙ্খলা সমস্যার দায়িত্ব নিয়ে পুলিশকেই সমাধান করতে হবে। নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ফুটওভারব্রিজের যে উচ্চতা থাকা প্রয়োজন ঢাকার ব্রিজগুলোর উচ্চতা তার চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণে বিভিন্ন এলাকার ফুটওভারব্রিজ পথচারীরা ব্যবহারে উৎসাহ পান না। পরিবেশবাদী আন্দোলনের নেতা আবু নাসের বলেন, ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারে মানুষকে বাধ্য করতে হবে। একই সঙ্গে ব্রিজগুলো তৈরি করার আগে এর ব্যবহার উপযোগিতা মাথায় রেখে করতে হবে। তাহলে হকার বা অন্য কেউ এটি দখলও করতে পারবে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের গত এক বছরের গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় বছরে ৪০০টির অধিক দুর্ঘটনা ঘটে। যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনায় নিহত হন পথচারীরা। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ পথচারী রাস্তা পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। আর রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় পড়েন ৫০ শতাংশ পথচারী। পথচারীরা ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করা এবং ট্রাফিক পুলিশের অস্বচ্ছতা থাকায় এ ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
×