ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

উত্তাল পদ্মায় ইতোমধ্যেই ৩০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন

দ্রুত এগোচ্ছে পদ্মা সেতুর বিশাল নির্মাণযজ্ঞ ॥ মাওয়ায় বৈপ্লবিক ছোঁয়া

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

দ্রুত এগোচ্ছে পদ্মা সেতুর বিশাল নির্মাণযজ্ঞ ॥ মাওয়ায় বৈপ্লবিক ছোঁয়া

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ পদ্মা সেতু নির্মাণ তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। মানুষের মুখে মুখে শুধু নয়, কাজেরও বাস্তবায়ন হচ্ছে। সেতুর দু’প্রান্ত মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলা পেরিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২১ জেলাই নয় সারাদেশে এর বৈপ্লবিক ছোঁয়া লাগছে। ‘আমরা পারি, আমরা করি’ এমন মানসিকতা লালন করেই যেন বাঙালী তরঙ্গ প্রসারিত হচ্ছে সবখানে। আর এই স্রোতধারা যে স্থানটি ঘিরে সেই মাওয়ার অবস্থা কি? খুব সহজেই অনুমেয়। পদ্মা সেতুর তরঙ্গ শুধু বাঙালীদের ছাপিয়ে পেয়ে বসেছে বিদেশীদের মধ্যেও। বৃহস্পতিবার চীনা রাষ্ট্রদূত মিং কিয়াং পদ্মা সেতুর নির্মাণযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে এসে এমন ইঙ্গিত করেছেন। রাষ্ট্রদূত মিং কিয়াং বছরখানেক আগে এই প্রকল্প এলাকায় এসেছিলেন। কিন্তু এবার এসেই তিনি বিস্মিত। বিশাল সেতুকর্ম দেখে তিনি অভিভূত! তার দেশের ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা এই পরিবর্তনের মূল ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, এখানে না এলে বোঝা সম্ভব ছিল না পদ্মা সেতুর এই বিস্ময়কর চিত্র। চীনা রাষ্ট্রদূতের মতে, পদ্মা সেতু ঘিরে বৈপ্লবিক এই পরিবর্তন বাংলাদেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে মাইলফলক। পদ্মা সেতুর মূল পাইলিংয়ে বেশ গতি এসেছে। ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। তিনটি মূল পাইল স্থাপিত হওয়ার পর এখন ৬ ও ৭ নম্বর পিলারে আরও দুটি মূল পাইল বসছে দ্রুতগতিতে। এছাড়া নতুন করে টেস্ট পাইল এবং ট্রায়াল পাইল স্থাপন হচ্ছে। পদ্মা সেতুতে কর্মরতরা শুক্রবার বিকেলে এসব খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরে জনকণ্ঠকে বলেন, ৪০ নম্বর পিলারে চলছে টেস্ট পাইলের কাজ এবং ৩৯ পিলারে ট্রায়াল পাইল বসছে। টেস্ট পাইল সহজ লোড দিয়ে টেস্ট করা হয়। কিন্তু ট্রায়াল পাইল অনেকটা মূল পাইলের মতই, বেশ মোটা। স্থাপনে অনেক ভারি যন্ত্রপাতির ব্যবহার হচ্ছে। ট্রায়াল পাইলের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয় এখানে মূল পাইল স্থাপন করা যাচ্ছে কিনা। এছাড়াও সেতুর দু’প্রান্তে ভায়াডকের কাজও শুরু হয়ে গেছে পুরো দমে। সব মিলিয়ে মূল সেতুর কাজ ছড়িয়ে পড়েছে পদ্মার দু’তীরে। যারা পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছেন তারা খুব সহজেই বলবেন, বিশেষ এক গতিতে কাজ হচ্ছে এখানে। যা না দেখে বলা মুস্কিল। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও উত্তাল পদ্মায় সেতুর ৩০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। মূল সেতুর পাইল স্থাপন চলছে হরদম। আর বিশাল বিশাল এই পাইল তৈরি হচ্ছে সেতুর পাশেই। বাংলাদেশে এতবড় পাইল তৈরির ঘটনা বিরল। প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ ওয়াকশপে পাইল তৈরির কর্মযজ্ঞ বিস্ময়কর। পাইল তৈরির জন্য ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহারসহ সূক্ষ্ম কাজগুলো করছে নারী সদস্যরা। অতি নিখুঁত এই কাজগুলো সম্পন্ন হচ্ছে একরকম নীরবে। মূল সেতুর পাশাপাশি নদী শাসনের কাজও চলছে অতি গুরুত্বের সঙ্গে। কারণ আগামী বর্ষার আগেই প্রকল্প এলাকায় পদ্মাকে বশ মানাতে চলছে এখন নানা যজ্ঞ। ড্রেজিং, ব্লক তৈরি, জিও ব্যাগ ফেলা সবই হচ্ছে পরিকল্পনা মাফিক। পদ্মা সেতুর কাজে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে করা হচ্ছে নদী শাসনকে। শীত মৌসুমের সুবিধা নিয়ে এ কাজে গতি আনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কাজে সাফল্য পেলে নদীর গতিপথ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পদ্মার দুই কূলকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। নদীতে ফেলার আগে গুণগতমান পরীক্ষা করা হচ্ছে জিওব্যাগ ও ব্লকের। সিনোহাইড্রোর নিজস্ব ইয়ার্ডে পুরো নদী শাসন প্রকল্পের জন্য তৈরি করা হচ্ছে সাড়ে ৭ কোটি ব্লক। ইট, বালু ও সিমেন্টের মিশ্রণ প্রক্রিয়াজাত করে প্রতিদিন তৈরি করা হচ্ছে ২০ হাজার কংক্রিটের ব্লক। পরে সেগুলোকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইয়ার্ডের খোলা জায়গায়, জড়ো হচ্ছে নদী শাসন প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য। পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে প্রবাহিত হচ্ছে এক লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি। বর্ষায় প্রমত্তা এ নদী এখন কিছুটা শান্ত। এ সুযোগে প্রতিদিন ফেলা হচ্ছে শত শত বালু ভর্তি জিও ব্যাগ। বালু ভর্তি বড় নৌকা নিয়ে আসা হচ্ছে মাঝ নদীতে। আর সেখানে নদী শাসনের জন্য আনা পাঁচটি বড় বার্জে বস্তা ভরাট করা হচ্ছে ডাম্পিংয়ের জন্য। গত মৌসুমে অন্তর্বর্তীকালীন কাজের অংশ হিসেবে ১২৫ কেজি ওজনের জিও ব্যাগ ফেলা হলেও এবার মূল কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ৮শ’ কেজি ওজনের জিওব্যাগ। চলতি মৌসুমে মাওয়া প্রান্তে ফেলা হচ্ছে ১৪ লাখ বস্তা। সেতু নির্মাণে দু’পাড় রক্ষার পাশাপাশি নদীর স্রোতকে নিয়ন্ত্রণের জন্যই এ নদী শাসন প্রকল্প। নদী শাসন প্রকল্পের আবাসিক প্রকৌশলী লি থে হেল বলেন, পদ্মা সেতুর নদী শাসন খুবই কঠিন কাজ। এখানকার নদীতে যে স্রোত প্রবাহিত হয়, তা বিশ্বের যে কোন নদীর চেয়ে বেশি। এ অবস্থায় নদী শাসনের কাজ হয়ে গেলে পদ্মার দু’কূলকে রক্ষা সম্ভব হবে। প্রয়োজনীয় সার্ভে শেষে কাজ এগিয়ে চলছে। মাওয়া প্রান্তে দেড় কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকায় নদী শাসন করা হবে। আগামী মে পর্যন্ত পুরো সময় জুড়েই চলবে এ কাজ। আর এই কাজ পুরোদমে শুরু হয় গত নবেম্বরে। থেমে নেই এ্যাপ্রোচ রোড তৈরিসহ অন্যান্য কাজও। সেতুর সঙ্গে রেল যুক্ত করা এবং গ্যাসলাইন রাখাসহ নানাবিধ কাজ এগিয়ে চলছে যথাযথ গতিতে। আর পদ্মা সেতুর কাজের বাইরেও মহাপরিকল্পনা চলছে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে। বড় বড় বিনিয়োগকারীর চোখ এখন পদ্মা সেতু ঘিরে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও বসে নেই। মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল জানান, পদ্মা সেতু ঘিরে এক রকম আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক রকম পরিকল্পনা যেমন সরকারীভাবে হচ্ছে, আবার বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আশপাশে জমি কেনাসহ নানা রকম বিনিয়োগ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে পদ্মা সেতু ঘিরে সবকিছুই যেন পরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন হয় সেই চেষ্টাই করবে সরকার। স্থানীয় সাংসদ অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, পদ্মা সেতুর অর্জনকে বাঙালীর সার্বিক মুক্তি এবং নিজেদের আত্মবিশ্বাসী এবং সেই আদলে বদলানোর একটি ধাপ তৈরি হয়েছে। যার সাড়া মিলছে চারদিকে। এতে বিদেশে কর্মরতরাও অনেক বেশি উজ্জীবিত। এর সুফল কাজে লাগাতে সরকার বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু এলাকায় হংকং কিংবা সিঙ্গাপুরের মতো শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। এছাড়াও পদ্মার চরে অলিম্পিক ভিলেজ তৈরি ছাড়াও পরিকল্পনা রয়েছে পানি ও পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের জাদুঘর তৈরি করা। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর নির্মাণযজ্ঞে সব খবরই নিয়মিত রাখছেন। পদ্মা সেতুকে কর্মরত একজন দায়িত্বশীল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল কাজের উদ্বোধনের পরই পদ্মা সেতুর কাজে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। দেশে বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে তা খুব কাছ থেকে অনুধাবন করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ এবং দেশী বিদেশী বিশিষ্টজনদের সফর প্রকৌশলী কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের আরও বেশি উৎসাহিত করেছে। এর আগে পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞ নিজের চোখে দেখতে আসেন বাংলাদেশস্থ সাবেক পাঁচ চীনা রাষ্ট্রদূত ও এক গবেষক। ঘুরে গেছে এক্সপার্ট প্যানেল। জার্মানির তৈরি ২ হাজার ৪শ’ কিলো জুল ক্ষমতার হ্যামারের হাতুড়ি দিয়ে মূল পাইল স্থাপন করা হচ্ছে। পাইলিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হবে সেতুর স্প্যান (পিলার)। পিলারের ওপর বসবে সেতুর স্ল্যাব ও ট্রাস। চীনে সø্যাব ও ট্রাস বানানোর কাজ চলছে। পিলার বানানোর কাজ শেষ হলে সø্যাব ও ট্রাসজুড়ে দেয়া হবে। তাই প্রথমেই সেতুর ৪২ পিলার তৈরি করা হচ্ছে। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ের সেতুটি চার লেনবিশিষ্ট মূল সেতুটি দৈর্ঘ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ২২ মিটার। সেতুটিতে মোট ৪১ স্প্যান (অংশ) থাকছে, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। স্প্যান বড় হওয়ায় রিইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে তৈরি না করে ওজন কমাতে সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে স্টিল দিয়ে। তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও ভূমিকম্পজনিত ধাক্কা মোকাবেলায় বেছে নেয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাস ফর্ম। পুরো সেতুর ভার বহন করার জন্য থাকছে ৪২ পিয়ার (পিলার), যার প্রতিটির নিচে থাকছে গড়ে প্রায় ৬ পাইল। এই সেতু বাংলাদেশের ভাগ্য বদলে দেবে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ইতোমধ্যেই মূল সেতুর ২০ শতাংশ, নদী শাসনে ১৫ শতাংশ, এ্যাপ্রোচ সড়কের ৬০ শতাংশসহ সব মিলিয়ে গড়ে সেতুটির প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম প্রকল্পটির নানা বিষয় তুলে ধরে জনকণ্ঠকে বলেন, কাজের মান ও অগ্রগতি সন্তোষজনক। সব কিছুই চলছে পরিকল্পনামাফিক। যেভাবে কাজ এগোচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পদ্মা সেতু জনগণের জন্য খুলে দেয়া সম্ভব হবে।
×