ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোরসালিন মিজান

ছুটির দিনে প্রত্যাশার বেশি পাঠক, শিশুদের মজার সময়

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ছুটির দিনে প্রত্যাশার বেশি পাঠক, শিশুদের মজার সময়

ছুটির দিন যেহেতু, ভিড় বাড়বে। এই অঙ্ক মোটামুটি জানা ছিল। এর পরও অবাক করল মেলার প্রথম শুক্রবারটি। এদিন শুধু ভিড় ছিল না। জনস্রোত নেমেছিল। বাংলা একাডেমি চত্বর ছিল লোকে লোকারণ্য। সে তুলনায় অনেক বড় পরিসর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেখানেও নানা বয়সী মানুষ। এলোমেলো করে সাজানো স্টল। কোথায় শুরু কোথায় শেষ বোঝা মুশকিল। এর পরও অধিকাংশ স্টলের সামনে কৌতূহলী পাঠক। বই দেখছিলেন। কিনছিলেন যারা, তাদের সংখ্যাও কম নয়। দেখে সত্যি মন ভাল হয়ে যায়। পঞ্চম দিনের চিত্র সামনের দিনগুলো সস্পর্কে সুন্দর ধারণা দেয়। শিশুপ্রহর দিয়ে শুরু ॥ মেলা শুরু হওয়ার পর শুক্রবার ছিল প্রথম শিশুপ্রহর। নিয়ম অনুযায়ী, সকাল বেলাটি শিশুদের জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দ ছিল। এ সময় অমর একুশে উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শিশুকিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী। প্রতিযোগিতা ক-শাখায় ২৬৫ জন, খ-শাখায় ২২৫ জন এবং গ-শাখায় ৭২ জন সর্বমোট ৫৬২ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। এর আগে সকাল ১১টায় বাবা মায়ের আঙুল ধরে একাডেমি চত্ব্রে প্রবেশ করতে থাকে ছোট্ট সোনামনিরা। শিশু কর্নার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তরিত হলেও, এখানে আছড়ে পড়ে প্রথম ঢেউ। মাত্র কয়েকটা স্টল। প্রতিটির সামনে গায়ে গা লাগা ভিড়। বাবা মা হাতে ঠেলে জায়গা করে দিচ্ছিলেন। বাচ্চারা ব্যস্ত ছিল পছন্দের বই খোঁজার কাজে। মাঝখানের পথ দিয়ে প্রবেশ করলে হাতের ডান পাশে শিশু একাডেমির স্টল। শিশু-কিশোরদের উপযোগী বই দিয়ে সাজানো। এখানে বিশেষভাবে চোখে পড়ল ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশু গ্রন্থমালা’। ‘ছবি ছড়ায় বঙ্গন্ধু’, ‘কবিতায় বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধু কোষ’ ইত্যাদি শিরোনাম। শিরোনামগুলোই বলে দেয় বইয়ের বিষয়বস্তু। অপেক্ষাকৃত সচেতন বাবা মায়েরা এখান থেকে বই কিনছিলেন। এবং দেখে ভাল লাগল যে, এই সচেতন পিতা-মাতার সংখ্যা অনেক! পাশেই নলেজ ভিউ নামের আরেকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এখানে বিদেশী কার্টুন চরিত্রগুলোর সমাবেশ। দুই দশ পাতার বই। প্রচ্ছদ থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত কার্টুন আঁকা। তা-ই দেখে শিশুরা মুগ্ধ। বাবা মাও কিনে দিচ্ছিলেন। রঙিন ফুল নামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি শিশুদের বরাবরই টানে। এবারও এখানে শিশুদের রাজ্য। অনেক কষ্টে স্টলের সামনে একটু জায়গা করে নিতে হয়। আর তখন দেখা যায়, হরেক রঙের রকমের বই। চমৎকার সাজানো। এখানেও একাধিক সিরিজ গ্রন্থ। ‘ছোটমনিদের গল্পের ঝুলি’ সিরিজের বইগুলো আবার একেকটি একের রঙের। লাল রঙের প্রচ্ছদ যেটির, বলা হচ্ছে লাল বই। নীল রং হলে নীল বই। এভাবে শিশুদের কাছে পৌঁছার চেষ্টা। সফলও বটে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিশুদের ভিড় বাড়ে বিকেল বেলায়। মূল ভেন্যুতে প্রবেশ করতেই শিশু কর্নার। এই কর্নারে অনেকগুলো স্টল। সবক’টিতে বাচ্চাদের উৎসব। বই সংগ্রহে ওদের কী যে মনোযোগ! সিসিমপুর খুব পরিচিত। এখানে আকর্ষণীয় উপস্থাপনা। বইয়ের বেশ কয়েকটা সেট প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। নতুন আসা নয়টি বইয়ের একটি সেট। মূল্য ৬০০ টাকা। ইকরি ও প্রজাতি, দেখব বলে জগৎটাকে, বেঙের ছানা ও ডিম, টুকটুকি যখন বড় হবে, হলুদ ভূত নামের বইগুলোর পাতা উল্টে দেখতে বেশ লাগে। শিশুদের আকৃষ্ট করার সব আছে। গত বছর মেলায় আসা ১১টা বইয়ের সেটটিও বিক্রি হচ্ছে। মূল্য ৫৪০ টাকা। আছে বিগবুক। পাজেল। স্টলের কর্মী শোভন জানান, এই বইয়ের চরিত্রগুলো সম্পর্কে বাচ্চারা ভাল করেই জানে। বইগুলোও তাদের চেনা। ফলে খুব বেশি বুঝিয়ে বলতে হয় না। নিজ থেকেই অনেকে চেয়ে নেয়। ময়ূরপঙ্খী নামের একটি স্টল গল্পের বই দিয়ে সাজানো। বিদেশী গল্প নয়। বাংলাদেশের প্রচলিত গল্পের ধারায় লেখা। প্রচ্ছদে কার্টুন। চরিত্রগুলো এদেশীয়। শিশুদের আগ্রহের কথা মাথায় রেখেই হয়ত শিরোনাম ঠিক করা হয়েছে। যেমনÑ বিড়াল ও ইঁদুর, ইঁদুর ও বাদুড়, রাজকন্যা রূপালী, বুড়ি মা, অহঙ্কারী তোতা, ধূর্ত উজির। এখানে রয়েছে বাংলা একাডেমির একটি স্টল। শুধু শিশুদের বই দিয়ে সাজানো স্টলে সুনির্বাচিত বই। চোখে পড়ল ‘ছোটদের অভিধান’, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই সম্পাদিত ‘আমার প্রথম লেখা’, আখতার হুসেন সম্পাদিত ‘হাবীবুর রহমান কিশোর রচনাসংগ্রহ’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা’, আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, বেবী মওদুদের ‘রাসেলের গল্প’, শাহজাহান কিবরিয়ার ‘আফ্রিকার রূপকথা’ এবং ‘চালাক শিয়াল ও বোকা শিয়াল’। একাডেমি সূত্র জানায়, মেলায় এখন পর্যন্ত ২১টি নতুন শিশুতোষ বই প্রকাশিত হয়েছে। শিশু কর্নারের বাইরেও বিভিন্ন স্টলে সাজানো ছিল শিশুদের বই। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাম্রলিপির সামনে শিশু-কিশোরদের একটা ভিড় লেগেই থাকে। শিশুপ্রহরে সেটা বেড়েছিল। বইমেলার সবচেয়ে চাহিদা সম্পন্ন লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের নতুন বই এখানে। সায়েন্সফিকশনের পাঠকেরা ভির করে কিনছিল। সকালে যে মেলায় শিশুদের প্রাধান্য ছিল সন্ধ্যায় সেখানে সব বয়সী মানুষ। কোন স্টলই শূন্য পড়ে ছিল না। সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেই বই কম বেশি বই বিক্রি হয়েছে। দিব্য, অনন্যা, অন্যপ্রকাশ, এ্যাডর্ন, ঐতিহ্য, পাঠকসমাবেশসহ বহুল পরিচিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছিল পাঠকের বিপুল উপস্থিতি। নতুন বই একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়েছে নতুন ২৫৬টি বই। এগুলোর মধ্যে গল্প ৪০, উপন্যাস ৪৯, প্রবন্ধ ৮, কবিতা ৬৪, গবেষণা ৪, ছড়া ৮, শিশুসাহিত্য ১৩, জীবনী ৮, মুক্তিযুদ্ধ ৪, নাটক ১, বিজ্ঞান ৩, ভ্রমণ ৪, ইতিহাস ৫, রাজনীতি ৪, কম্পিউটার ১, ধর্মীয় ২, অনুবাদ ১, অভিধান ৫, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ২ এবং অন্যান্য বিষয়ে লেখা বই ৩০টি। মেলা মঞ্চের প্রস্তুতি বিকেলে মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী : অভিধান ও ব্যাকরণ কর্মসূচী, অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক স্বরোচিষ সরকার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক হাকিম আরিফ এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আহমদ কবির। প্রাবন্ধিক বলেন, প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিক থেকেই বাংলা একাডেমি অভিধান প্রণয়ন ও প্রকাশ কর্মসূচীকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতো প-িত ব্যক্তিবর্গ যেসব অভিধান কর্মসূচীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তা-ই পরবর্তীকালে বিকশিত হয়ে বাংলা একাডেমির অভিধানকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। বাংলা একাডেমির অভিধান বিষয়বৈচিত্র্যের দিক থেকেও অনন্যতার দাবিদার। আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, বাংলা-ইংরেজী অভিধান, বাংলা ভাষার বিবর্তনমূলক অভিধান, তুর্কি-আরবি-ফারসি অভিধান, ছোটদের অভিধান এবং অতি সম্প্রতি প্রণীত আধুনিক বাংলা অভিধান একাডেমির অভিধান-সন্ধিৎসারই পরিচয়বহ। তিনি বলেন, অভিধানের পাশাপাশি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যকরণ এবং বিজ্ঞান বিশ্বকোষের মতো মহাকায় কোষগ্রন্থ জ্ঞানান্বেষু মানুষের কাছে বিপুলভাবে আদৃত হয়েছে। তবে এখন পরিবর্তমান সময়ের দিকে লক্ষ্য রেখে এমন একটি অভিধানের প্রয়োজন যেখানে শব্দ চয়িত হবে সমকালীন প্রমিত ভাষার সাহিত্য থেকে, পৌনঃপুনিকতার বিচারে। আলোচকরা বলেন, বাংলা একাডেমির অভিধান ও ব্যাকরণ কর্মসূচীর আওতায় আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লাভ করেছি যার মধ্য দিয়ে জাতির অভিধানমনস্কতা তৈরি হয়েছে, অনেকক্ষেত্রে আভিধানিক পরনির্ভরশীলতাও হ্রাস পেয়েছে। তবে এসব অভিধান প্রণয়নের একটি সুনির্ধারিত নীতিমালা নির্ধারিত থাকা প্রয়োজন এবং নিয়মিত হালনাগাদের মাধ্যমে অভিধানগুলোকে সমসাময়িক করে তোলাও জরুরী। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আহমদ কবির বলেন, বাংলা একাডেমির প্রধান কাজের মধ্যে অভিধান ও ব্যাকরণ কর্মসূচী অন্যতম। এদেশে খ্যাতনামা গবেষকবৃন্দ যে নিষ্ঠা ও শ্রমে একাডেমির অভিধান প্রণয়ন করেছেন তা আজ গোটা বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে সমাদৃত হচ্ছে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত বেগম রাহিজা খানম ঝুনু-এর পরিচালনায় ‘বাংলাদেশ একাডেমী অব ফাইন আর্টস লি.’-এর শিল্পীবৃন্দ। সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী আবদুল লতিফ শাহ্, শফি ম-ল, রণজিত দাস বাউল, মমতা দাসী বাউল, ভজন কুমার ব্যাধ এবং কোহিনুর আকতার গোলাপী।
×