ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টাঙ্গাইলের এমপি রানাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কারের দাবি

প্রকাশিত: ০২:২০, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

টাঙ্গাইলের এমপি রানাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কারের দাবি

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল ॥ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী, আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার চার্জশীট আদালতে জমা দেয়ার পর থেকেই টাঙ্গাইল জেলায় চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। জেলার সর্বত্র এখন একই আলোচনা টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমপি আমানুর রহমান খান রানা ও তাঁর তিনভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পার কি শাস্তি হবে? জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী এবং আওয়ামী পরিবারের সদস্যরা বলছেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হত্যার অভিযোগে এদের ফাঁসি হওয়া উচিত। ’৭১ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের কর্মকান্ডে যদি তাদের এখন ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে। তাহলে কেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যার আসামীদের ফাঁসি হবে না। জেলার জনগন আরও বলছেন, বঙ্গবন্ধুর আর্দশে গড়া দলে কোন মুক্তিযোদ্ধা হত্যার আসামীরা থাকতে পারে না। তাদেরকে দ্রুত আওয়ামী লীগ থেকে চিরতরে বহিস্কার করা হোক। আওয়ামী লীগ থেকে যদি তাদেরকে বহিস্কার করা না হয়, তাহলে জামায়াতের সাথে এ দলের কোন পার্থক্যই থাকবে না। এমপি রানা ও তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয়ায় নিহতের পরিবার, জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতারাকর্মীরা স্বস্তি এবং সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে নামকরণে সকালে জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পূর্বনির্ধারিত আনন্দ মিছিলের কর্মসূচি ছিল। আনন্দ মিছিল থেকে খান পরিবার বিরোধীরা স্লোগান এবং মুক্তিযোদ্ধা ফারুকের খুনিদের বিচারের দাবিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত মিছিলটি ফারুক হত্যাকারীদের ফাঁসি ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কারের দাবির মিছিলে পরিণত হয়। এদিকে ফারুক আহমেদের পরিবার, নিহতের স্ত্রী ও মামলার বাদী নাহার আহমেদ মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ এবং এমপি রানাসহ অন্য অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে বলেন, এমপি রানা ও তাঁর ভাই সাবেক মেয়র মুক্তি ঢাকাতেই আছেন বলে জানতে পেরেছি। তাঁদের ঘোরাফেরা করতেও দেখেছে অনেকে। তারপরও পুলিশ কেন তাঁদের গ্রেফতার করতে পারছে না, তা বুঝতে পারি না। আসল খুনিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করায় আমি সন্তুষ্ট। এজন্য জেলা পুলিশ প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই। তবে খুনিরা গ্রেফতার না হওয়ায় মনের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। আমি চাই চূড়ান্ত বিচার, মানে ফাঁসি এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার। এমপি রানা ও তার ভাইয়েরা খুবই প্রভাবশালী। ওরা পারে না এমন কোন কাজ নেই। তদের মধ্যে কোন মনুষত্ব নেই, ওরা সবসময়ই হাসতে হাসতে মানুষ খুন করতে অভ্যস্ত। টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের বলেন, অভিযোগপত্র দাখিল হওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মী ও সমর্থকরা খুশি। তিনি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এ হত্যা মামলাটি পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া ওদের মতো খুনিদের আওয়ামী লীগে থাকার কোন অধিকার নেই। ওদের দল থেকে বহিস্কারের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দলের সভানেত্রী ও দেশের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করা হবে। তবে পুলিশ ও ডিবি পুলিশকে আমরা ধন্যবাদ দিতে চাই যে তারা এই মামলায় স্বাধীনভাবে তদন্ত চালিয়ে ক্ষমতাসীন দলের এমপি ও তাঁর ভাইদের অভিযুক্ত করেছে। জানা যায়, এর আগে টাঙ্গাইলে প্রভাবশালী খান পরিবারের সদস্যরা ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। অভিযুক্ত চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অর্ধশত মামলা হলেও তার কোনো সফল বিচার প্রক্রিয়া মানুষ দেখেনি। কখনো বাদী ও সাক্ষী আদালতে হাজির হননি। আবার ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ সরকার নিজেই কখনো তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিয়েছে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে জেলা পুলিশ বিভাগ। হত্যাকান্ডের দীর্ঘ তিন বছর ১৫ দিন পর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়। এমপি রানাসহ তার তিন ভাই নিহত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বাদি নাহার আহমেদ এই মামলার এজাহারে কোনো আসামির নাম উল্লেখ করেননি। সেদিক থেকে এটা একটা ব্যতিক্রমী অভিযোগপত্র। টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সালেহ্ মোহাম্মদ তানভীর জানান, এটি একটি চাঞ্চল্যকর মামলা। তাই এটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের পক্ষ থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে চিঠি দেয়া হবে। আদালতে জমা দেয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে- জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন ফারুক আহমেদ। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার খুব সম্ভাবনাও ছিল তাঁর। অন্যদিকে পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তিও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। হত্যাকান্ডের দেড় মাস আগে এমপি রানা ও তাঁর তিন ভাই মুক্তি, কাকন, বাপ্পা এবং নাছির উদ্দিন, ছানোয়ার হোসেন ও আলমগীর হোসেন চাঁনে ফারুককে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে রানা ও তাঁর ছোট ভাই বাপ্পা তাঁদের কলেজ পাড়ার বাসার কাছে গ্লোবাল ট্রেনিং সেন্টারে আনিসুর রহমান রাজার মাধ্যমে ফারুককে ডেকে আনেন। সেখানে ফারুককে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদের প্রার্থিতা থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করেন বাপ্পা। কিন্তু ফারুক তাতে রাজি হননি। এক পর্যায়ে ফারুক কক্ষ থেকে বের হয়ে বাথরুমে যান। বাথরুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পথে এমপি রানার ঘনিষ্ঠ কবির হোসেন তাঁকে পিস্তল দিয়ে গুলি করেন। এ সময় এমপি রানা দুই মিনিটের মধ্যে সব পরিষ্কার করার নির্দেশ দেন। তাঁর কথামতো রাজা, মোহাম্মদ আলী, আবদুল হক, সমীর ও কবির হোসেন ফারুকের মৃতদেহ তাঁরই বাসার সামনে ফেলে রেখে আসেন। সেখান থেকেই তাঁর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। খান পরিবারের চার ভাই ছাড়াও অভিযোগপত্রভুক্ত অন্য আসামিরা হলো- এমপি রানার ঘনিষ্ঠ সহযোগী কবির হোসেন, আনিসুর রহমান রাজা, মোহাম্মদ আলী, সমীর, ফরিদ আহমেদ, এমপি রানার দারোয়ান বাবু, যুবলীগ নেতা আলমগীর হোসেন চাঁন, ছানোয়ার হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নাসির উদ্দিন নূরু ও সাবেক পৌর কমিশনার মাছুদুর রহমান মাসুদ। হত্যাকান্ডের পর গ্রেফতার হওয়া পৌর কাউন্সিলর শফিকুল হক শামীম, ফিরোজ আহমেদ ও মোহাম্মদ ফজলুর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযোগপত্রে এই মামলা থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া এই মামলায় অভিযুক্ত আবদুল হক অজ্ঞাতদের হাতে খুন হওয়ায় তাঁকেও এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আবদুল হক ২০১৪ সালের ১০ আগস্ট অজ্ঞাতদের হামলায় নিহত হন। এই মামলায় মোট ৩৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। টাঙ্গাইল গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোলাম মাহফিজুর রহমান বলেন, অভিযুক্ত ১৪ জনের মধ্যে আনিসুর রহমান রাজা, মোহাম্মদ আলী, সমীর ও ফরিদ আহমেদ কারাগারে রয়েছে। এমপি রানা ও তাঁর তিন ভাইসহ অন্য ১০ জন্য বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। গোপন সূত্রে জানা গেছে, খান পরিবারের চার ভাইয়ের মধ্যে এমপি রানা ও সাবেক পৌর মেয়র মুক্তি দেশেই আত্মগোপন করে আছেন। অন্য দুই ভাই ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন মালয়েশিয়ায় এবং অপর ভাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন। অন্য আসামিরা দেশে আছেন বলে তাঁদের ধারণা। অভিযুক্তদেও গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এমপি রানা ও তার তিন ভাইদের গ্রেফতার করতে পারলে এ হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হবে। এছাড়া তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে হত্যাকান্ডের বিষয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া সম্ভব।
×