ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা ফারুক

সিরাজুল ইসলাম মুনিরের উপন্যাসসমগ্র

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সিরাজুল ইসলাম মুনিরের উপন্যাসসমগ্র

আশির দশকের অঙ্গীকারাবদ্ধ কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম মুনির। ২০১৫ সালের একুশে বইমেলাতে পার্ল পাবলিকেশন্সের ব্যানারে প্রকাশিত হয়েছে তার উপন্যাস সমগ্র প্রথমখ-। মুনিরের রচনার পারম্পর্যতায় যে বিষয়টি উল্লেখ্য, তাহলো তিনি একটি উপন্যাসে তার কথনের আধুনিক ছায়াচিত্র যেমন ফুটিয়ে তোলেন নির্মোহরূপে। তেমনি হৃদয়গ্রাহী, বাস্তবিক জীবনবোধের দৃশ্যাবলীকেও অত্যন্ত সনিপুণভাবে বুনন করেন শব্দের শৈল্পিক আর অন্তশীল মোহাচ্ছন্নতার নিবিড় ঐশ্বর্যময়তায়। আর এখানেই তার স্বাতন্ত্রিক ধারার ৭টি উপন্যাস নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত। সিরাজুল ইসলাম মুনিরের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘আবর্ত’ হলেও তার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘যখন প্রপাত’। ‘যখন প্রপাত তরুণ প্রেমের এক হৃদয়স্পর্শী উপন্যাস। দুটি কিশোর-কিশোরীর অন্তরের রক্তক্ষরণ আর বিরহ যাতনার গল্প অত্যন্ত নিপুণ বুননে উঠে এসেছে এ উপন্যাসে। সব মানুষের জীবনেই কিছু কিছু মন কেমন করা নিভৃত স্মৃতি থাকে, সে স্মৃতির ভেতর ফুটে থাকে কিছু উচ্ছ্বল-উত্তাল অর্থহীন অতীত। কিছু কিছু স্মৃতির অনল নিভে এসেও হৃদয়ের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে যায় পোড়া ছাই-ভস্ম। কিছু স্মৃতি কাটা ঘার মতো শুকিয়ে গেলেও রেখে যায় জ্বলজ্বলে দাগ আর ক্ষতচিহ্ন। সে হিসেবে যখন প্রপাত তরুণ বয়সের ভালোবাসার আবেগ জড়িত উপন্যাস হলেও এ উপন্যাস এক অর্থে সব বয়সী নারী-পুরুষের প্রেমের দুঃখাহত পদাবলীর ছবিকেই লালন করছে রচনার প্রতিটি ঘটনাক্রম অনুচ্ছেদে। আগেই উল্লেখ করেছি তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস হলো ‘আবর্ত’। যখন প্রপাতের সম্পূর্ণ বিপরীত এক শব্দগাথা। আবর্ত উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে চর অঞ্চলের নিরন্তর সংগ্রামে ও জীবন শৈলীর বহু বিচিত্র এক বর্ণাঢ্য চিত্ররূপ নিয়ে। বিশাল ক্যানভাসে আঁকা এক চলমান ছবির মতো এগিয়েছে এর বর্ণিল ঘটনাপ্রবাহ। উথাল-পাতাল সমুদ্রের ক্রমাগত ভাঙন আর পত্তনের মুখে জেগে উঠা নতুন চরকে ঘিরে মানুষের অভূতপূর্ব আনন্দ উল্লাস বেদনা চিরদিনের। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে নোয়াখালীর দক্ষিণ অঞ্চলে এরকম একটি নতুন পত্তন চর ‘ভাটিরটেকে’ নৃশংসতা ও বর্বরতার ঘটনা ঘটিয়েছিল একশ্রেণীর ক্ষমতাবান লোভী মানুষ। তখন ওই চরদখলকে কেন্দ্র করে শতাধিক মানুষের হতাহতের রক্তাক্ত ঘটনা প্রকাশিত হয় তৎকালীন পত্র-পত্রিকায়। পত্রিকার এ’নৃশংসতম সংবাদ পাঠ করে ঔপন্যাসিক সিরাজুল ইসলাম মুনিরের ক্রিয়েটিভ মন নিদারুণ পীড়িত হয়ে ওঠে। এবং পববর্তীতে এই মর্মন্তুদ বাস্তব এই ঘটনাপঞ্জিকে উপজীব্য করেই রচিত হয় আবর্ত। এক কথায় আবর্ত আশির দশকের এক উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। যেখানে ভাবাপ্লুত প্রেমের বদলে একজন তরুণ লেখকের লেখায় উঠে এসেছে এক বিচ্ছিন্ন ঘটনাসমূহের হৃদয়বিদারক চিত্রবীথি। ‘আবর্ত’ এর গল্প বাস্তব হলেও শৈল্পিক বুননশৈলীর কারণে হয়ে উঠেছে আরও সংবেদনশীল। আর এ উপন্যাসের চরিত্রগুলো লেখকের শিল্পগুণে হয়ে উঠেছে অসম্ভব জীবন্ত আর বাস্তবিক। সিরাজুল ইসলাম মুনিরের তৃতীয় উপন্যাস ‘সব পাখি ঘরে ফেরে’। স্বাধীনতা উত্তর অস্থির সময়ে এক শ্রেণীর ক্ষমতালিপ্সু, আমলা, সামরিক কর্মকর্তাদের লবিং-তদবির আর অর্থবিত্ত ও বৈভবের প্রাচুর্যে গা ভাসানোর স্বপ্নে বিভোর আদর্শহীন এক অনৈতিক সমাজের গল্প সুনিপুণ গদ্যভঙ্গির নির্মোহ বয়ানে ক্ষীণকায় এ উপন্যাসের পরতে-পরতে উঠে এসেছে। উচ্চবিত্ত এক স্বপ্নবিমুখ নারী আর নিম্নবিত্ত সমাজের এক উচ্চাভিলাষী পুরুষকে ঘিরে এর কাহিনী প্রবাহিত। বহুরৈখিক ঘটনাপুঞ্জের লতাতন্তুতে আচ্ছাদিত ‘সব পাখি ঘরে ফেরে’ উপন্যাসের অবয়ব মূর্ত হয়ে উঠেছে। যেখানে রয়েছে দুই প্রান্তের সমাজ বিজড়িত নারী ও পুরুষের দ্বন্দ্ব সংঘাতের অনুপম গাঁথুনি বিন্যাস। লেখকের সর্বাধিক আলোচিত এবং পাঠকনন্দিত উপন্যাস হলো ‘পদ্মা উপাখ্যান’। একজন পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জে এসে থিতু- হয়ে বসতে না বসতেই তার চোখের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ে সীমান্ত ঘেঁষা পদ্মার দুই পাড়স্থ দুই বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক সামাজিক, রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক জীবন ধারার আড়ালে প্রবাহিত এক গোপন নিষ্ঠুর নিষিদ্ধ জীবনের মানবেতর গল্প। যে গল্পের আলবেয়ে এগিয়েছে এক অমানবিক সমাজচিত্রের দোদুল্যমান সাংস্কৃতির বিচূর্ণ বিস্তারজীর্ণ কথকতা। পদ্মার দুই তীরের জনপদে কেন এই অন্ধকারের হানা এবং এতদঞ্চলের মানুষের বুকের গহীনে আগুনেরহল্কা লাগা হাহাকার চুয়ে ঝরেপড়া এক করুণ-বিষাদিত চিত্রকেই লেখক গভীর মনো নিবিষ্টতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। পদ্মাউপাখ্যানের প্রতিটি ছত্রে। ‘প্রিয় প্রেম’ সিরাজুল ইসলাম মুনিরের এক হৃদয়গ্রাহী উপন্যাস। যে উপন্যাসের তিনটি চরিত্র যেন তিনটি বিষণœ ঝরাপাতা। উপন্যাসের দুটি চরিত্র জাকির আর সাব্বির আপন সহোদর। এরা দুজনেই অজান্তে একটি মেয়েকেই প্রাণ উজার করে ভালোবাসে। যে ভালোবাসায় কোন খাদ নেই। যখন জানতে পারে ওরা পরস্পর একজনকেই ভালোবাসে। তখন যে কী এক তুফান ঝর বয়ে যায় দুই ভাইয়ের হৃদয়ের উপত্যকায়। প্রিয় প্রেম পড়তে-পড়তে ওই বেদনার্ত ঝড়ো ক্রন্দনের গঙানিতে নিজেদের চোখের পাতাও হয়ত অলক্ষ্যেই ভিজে উঠবে। উপন্যাস সমগ্রের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হলো ‘রক্তে ভেজা অববাহিকা’। এ উপন্যাসের পটভূমি রচিত হয়েছে প্রায় দুই শ’ বছরের একটানা ভাঙন পত্তনের পর নোয়াখালীর দক্ষিণে জেগে ওঠা চরসমূহে সত্তরের দশকে উপকূলীয় অঞ্চলে বনায়ন সৃজনের কাজ শুরু হয়। দীর্ঘ তিন দশকের অবিশ্রাম প্রচেষ্টায় সেখানে গড়ে ওঠে হাজার হাজার একর নিবিড় বনভূমি। কিন্তু এই বনভূমি সরকারী রক্ষকদের ক্ষমতার অপব্যবহারে উদ্ভব ঘটে একশ্রেণীর বনদস্যুদের। সরকারী এই বনভূমি দখলের লক্ষ্য নিয়ে এলাকার নষ্ট রাজনীতিক, ভূমিপ্রাসী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, মুখোশধারী এই ক্ষমতাবান সামাজিক টাউটরা ওই ভূমিদস্যুদের ব্যবহার করে। গড়ে তোলে সন্ত্রাসী বাহিনী এই দখলবাজদের ভয়াবহতা এবং চরের বঞ্চিত, নিপীড়িত অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীর পরিণতির করুণ ইতিহাসই বিবৃত হয়েছে রক্তেভেজা অববাহিকার প্রতিটা স্তবকে। ভূমিদস্যুরা দরিদ্র মানুষদের জমিদেবার প্রলোভন দেখিয়ে বন উজারের প্রেক্ষাপট রচনা করার অব্যবহিত পর ওই দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপরই চালায় সন্ত্রাসের স্টিমরোলার। খুন ধর্ষণ, সঙ্গমহানির ঘটনা হয়ে পড়ে নিত্যকার ঘটনা। কিন্তু চর উপকূলের সাধারণ মানুষের সীমাবন্ধ ক্ষমতা ভূমিদস্যুদের কেশও স্পর্শ করতে পারে না। এর প্রেক্ষিতেই লেখকের অত্যন্ত দরদমাখা অনুভূতির বহির্প্রকাশই হলো রক্তেভেজা অববাহিকা। ‘কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি’ উপন্যাস পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী কবিতার সেই চিরায়ত পঙ্ক্তি গুচ্ছকালো সে যতই কালো হোক/আমি দেখেছি তার কালো হরিণ চোখের কথাই মনে পড়ে যায়, কিন্তু উপন্যাসের কালোমেয়ের চরিত্রটি নিজের জীবনের বিদীর্ণ স্মৃতিগাথার গল্প অকপটে সহৃদয় পাঠকের কাছে বলতে বলতে একটি প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়ায়। কালো এই মেয়ের দুঃখাহত গল্পের প্রথম অধ্যায়ের অভিষেক হয় ১৯৭১-এর জনযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে। অসীম দিগন্তে ছড়িয়ে পড়া কৃষ্ণ মেয়েটির প্রশ্নের উত্তর কবে ফিরে পাবেÑ সেই প্রত্যাশায় গুনতে থাকে অনন্তপ্রহর। এই অনন্ত জিজ্ঞাসার ভেতরেই গল্পের যতি টানেন লেখক নিপুণ মুন্সিয়ানায়। আলোচিত উপন্যাস সমগ্রে গ্রন্থিত প্রতিটা উপন্যাসের কথনেই পাঠক পেয়ে যাবেন বিচিত্রমুখী চরিত্রের সন্ধান। আলাদা প্রেক্ষাপট, ভিন্ন মাত্রার স্বাদ। যা পাঠক পাঠের মাধ্যমেই অনুধাবন করতে পারবেন।
×