ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাদিক ইসলাম

চিরকালের আধুনিক

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

চিরকালের আধুনিক

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) রবীন্দ্র-উত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। রবীন্দ্র-জোয়ারের যুগে পাশ্চাত্যের রোমান্টিকতার রূপকথা আর স্বাপ্নিক ভুবন নিয়ে সবাই যখন নিমগ্ন তখন তিনি হাঁটলেন অন্য পথে; রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক যুগের হাত ধরে তিনি ইম্প্রেশনিস্টিক যুগে প্রবেশ করেন। তার সময়ের বিশ্বখ্যাত ইংরেজ কবি টিএসএলিয়ট, ডাব্লিউ বি ইয়েটস এবং উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, জন কীটস, তাকে ভীষণভাবে আলোকিত করেছিলেন। ইউরোপীয় আধুনিকতা বাংলা কবিতা ধারায় নিয়ে এসেছিল নতুন ব্যঞ্জনা। বলা হয়ে থাকে ফরাসী বিখ্যাত কবি শার্ল বোদলেয়ারও তার কবিতায় প্রভাব ফেলেছিলেন। বোদলেয়ারের শূন্যতাবোধ আর মানসিক ক্লান্তির পরিচয় মেলে জীবনানন্দের কাব্যে। বোদলেয়ারের কাব্যে যে ক্ষয়চিত্র জীবনানন্দ সেটি তার বহুস্তরের নারী চেতনায় উপস্থাপন করেন। জীবনানন্দের কবিতা সচেতনভাবে ইউরোপীয় আধুনিক কবিতা থেকে পুষ্টি লাভ করে বিবর্তন-বিবর্ধন এনেছে বাংলা কাব্যচর্চায়। কিন্তু, পাশ্চাত্যের প্রভাবে ঋদ্ধ হলেও তার কবিতার হৃদস্পন্দন বাংলার মাটি, পাখি, ফুল, জলাভূমি আর নারীতেই পূর্ণ। শুধু নির্জনতার কবি বললে তার বিরাট কাব্য সীমাকে খাটো করে দেখা হবে। তার কাব্যের পরিপ্রেক্ষিত যেমন ছিল একদিকে সুদূর অতীতে, তেমনি অনাগত ভবিষ্যতের কল্পলোকে নিবদ্ধ। প্রাচীন-মধ্যযুগের প্রথাগত কবিতাকে মুক্তি দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন অসামান্য একাধিক কবিতা; যা বাংলা কবিতাকে বিশ্বজনীন করে তুলেছে। তার কবিতা সব ভাষায় পঠিত হলে হতে পারতেন তিনি বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। জীবনানন্দ বাস্তবকে খুব বেশি গ্রহণ করেছেন বলে তা ঢাকবার তাগিদও অনুভব করেছেন অনেক বেশি; তাই তার কবিতায় রূপকালঙ্কার আর বিমূর্ততা এসেছে এতো চমৎকার আধিক্যে। তার কবিতায় এক ধরনের অতীত মুখিতা আছে, আছে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। তিনি কখনো নিজ দেশ ছেড়ে মলয় সাগড়, ট্রয়নগর, দারুচিনি-দ্বীপ আবার কখনো বিম্বিসার ধূসর জগতে ভেসে যান। এভাবেই তিনি দেশ ও কালের বাইরে নিজেকে স্থাপন করেছেন। জীবনানন্দ যেহেতু ইংরেজী সাহিত্য পড়াতেন তাই দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন ইংরেজ সাহিত্যের বহুমাত্রিকতায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপীয় সাহিত্য অঙ্গনে যে ওলটপালট ঘটে- মানুষের অস্তিত্বের সংকটে আলোড়িত লেখকরা যখন নিরাশাবাদ, মানবিক ব্যাধি, বিষণœতা, একাকীত্ব, অসহায়ত্ব, বিপন্নতা এবং নিরাপত্তাহীনতার মতো স্পর্শকাতর বিষগুলো সাহিত্যের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন; জীবনানন্দ তার দ্বারা আচ্ছন্ন হন। জীবনানন্দ ইউরোপের সেই রূপান্তরকে গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রয়োগ করেছিলেন বাংলা কবিতায় সফলভাবে। ইম্প্রেশন কাব্যের তিনটি ধারা চিত্রকল্পবাদ (ওসধমরংস), প্রতীকীবাদ (ঝুসনড়ষরংস) এবং পরাবাস্তববাদ (ঝঁৎৎবধষরংস) এর প্রবর্তন একাই ঘটান বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ। বাংলার মায়াবী বাস্তবতার শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে স্বপ্ন বাস্তবতার (উৎবধস জবধষরঃু) এক অপরূপ জগত সৃষ্টি করেন জীবনানন্দ। তার কবিতায় আধুনিকতার ছোঁয়া বোঝা যাবে প্রতীক ব্যবহারের প্রবণতা দেখে। তার অনুভূতিকে তিনি পরোক্ষভাবে স্নিগ্ধ দুর্বোধ্যতায় ও অস্পষ্টতায় প্রকাশ করেছেন ‘ধূসর পা-ুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতায় এটি পাওয়া যায়। কবি হৃদয় বিদীর্ণ করে একটি পাখিকে তীরবিদ্ধ হতে দেখে। এটি যেন শরবিদ্ধ মানুষেরও প্রতিচ্ছবি : ‘সে এসে পাখির মতো স্থির হয়ে বাঁধে নাই নীড়,- তার পাখায় শুধু লেগে আছে তীর-’ বোদলেয়ার, যিনি সব আধুনিক কবিদের পথিকৃত ; তার শূন্যতাবোধ আর ক্লান্তির চিহ্ন মেলে ধূসর পা-ুলিপির ‘পরস্পর’ কবিতায়। এক নির্বেদ চেতনায় কবির অবসাদ প্রতীয়মান হয় ; এই লাইনগুলো তারই সাক্ষী: ‘তারা আছে যাদের দিন যায় অসুখে, শরীরে ঘুন ঢেকে রাখে, ব্যর্থতা লুকিয়ে রাখে বুকের ভিতর’।’ আট বছর আগের একদিন’ কবিতার একটি লাইন সীমাহীন ক্লান্তি তুলে ধরে এইভাবে ‘আমরা নিরন্তর ক্লান্ত’। ‘বোধ’ কবিতায় এক গভীর শূন্যতাবোধ বোদলেয়ারের অদ্ভুত শূন্যতাবোধেরই উপলদ্ধি- ‘কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর’ পরে?/স্বপ্ন নয়,- শান্তি নয়,- কোনো এক বোধ কাজ করে/ মাথার ভিতরে।’ আবার, জীবনানন্দের কবিতা কীটসের মতো প্রকৃতির মায়া আর রূপ চিত্রায়নে বিভোর। কীটসের প্রকৃতি চিত্রময়তা জীবনানন্দের অনেক কবিতায় পাওয়া যায়। কীটসের মতো কবি প্রকৃতির ভিতর দিয়ে অস্তিত্বের কল্পনায় ডুবে যান। গ্রাম-বাংলার আবহমান প্রকৃতির সুচারু বর্ণনায় কবি ব্যবহার করেছেন কিছু প্রাচীন মিথও, যা টমাস গ্রে- এর কথা মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য মৃত্যুকেও তিনি কীটসের মতো বিলাস-বাসনা হিসেবে খুঁজে নিয়েছেন। ‘ওড টু নাইটিঙ্গেল’ কবিতায় কীটস ভীষণ যন্ত্রণাপিষ্ট জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে বেশি আরামদায়ক মনে করেন- ‘ধহফ, ভড়ৎ সধহু ধ ঃরসব ও যধাব নববহ যধষভ রহ ষড়াব রিঃয বধংবভঁষ উবধঃয,’ একইভাবে ‘নিরালোক’ কবিতায় বিষাদগ্রস্ত জীবনানন্দ মৃত্যুকে শ্রেয় ভাবেন যন্ত্রণাকাতর জীবন থেকে মুক্তি পেতে- ‘এখন মরণ ভালো,- শরীরে লাগিয়া রবে এই সব ঘাস; অনেক নক্ষত্র রবে চিরকাল যেন কাছাকাছি।’ ধূসর পা-ুলিপির ‘প্রেম’ কবিতাতেও তিনি মৃত্যুর মাঝে শান্তি পেতে চান- ‘মানুষের মতো পায়ে চলিতেছি যতদিন,- তাই ক্লান্তির পরে ঘুম,- মৃত্যুর মতো শান্তি চাই। আবার, ধূসর পা-ুলিপির শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘ক্যাম্পে’ এখানে কবি সুন্দরের পাশে মরণাপন্নকে আবিষ্কার করেন নিদারুণ বিষণœতায়- ‘বসন্তের জোস্নায় ওই মৃত মৃগের মতো আমরা সবাই’ ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি জীবনানন্দের অভিনব প্রতীকে ভরপুর। ইকো-কবিদের মতো প্রাণী হত্যার বিষয়টিও এসেছে এভাবে - ‘কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;/বনের ভিতর আজ শিকারিরা আসিয়াছে’। এই লাইটিতে পোরমতো গা ছমছমে একটা অভিব্যক্তি লুকিয়ে থাকে। আরেকটা বিষয় ছিল ‘হৃদয়ের বোন’ উপমাটি ফ্রয়েডিয়ান রহপবংঃ কে স্মরণ করিয়ে দেয় সমালোচকদের। কবিতাটি পড়লে এলিয়ট বা ইয়েটসের কবিতার মেটাফোরের ছায়া পাওয়া যায়। ইংরেজী কবিতার আঙ্গিক জটিল হওয়ার পেছনে শিল্প বিপ্লব, পুঁজিবাদের উত্থান, সামাজিক, ও সংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তন, বিজ্ঞানের প্রসার এবং সামগ্রিকভাবে জীবন জটিলতর হয়ে যাওয়া একটা বিশেষ কারণ ছিল। তাই, পাশ্চাত্যের গঠনে জীবনানন্দ যখন তার সময়ে সেই দুর্বোধ্যতা বাংলা সাহিত্যে নিয়ে আসলেন স্বাভাবিকভাবে তা অনেকেই গ্রহণ করতে পারেননি; কিন্তু আমরা এখন বুঝতে পারি আসলে তিনি সময়ের চেয়ে কতটা এগিয়ে ছিলেন, কত বেশি আধুনিক ছিলেন চিন্তা আর আঙ্গিকে। ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটিতে আস্ফল জীবনের ইঙ্গিত এসেছে ; আধুনিক জীবনের অনিরাপদ অনুভূতির কথা বক্রভাবে ব্যক্ত হয়েছে যেমনভাবে হয় ইংরেজী আবসার্ড লেখাগুলোতে। প্রতীকের ব্যবহারও কী অসামান্য কবিতাটিতে। কী অসাধারণভাবে জীবনানন্দ মানুষের অস্তিত্বের সংকট আর কঠিন নিরাশ্রয়তার ভাবনা তুলে ধরেছেন এই কবিতায় বারবার- ‘আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাব, মাংস খাওয়া হলো তবু শেষ? কেন শেষ হবে? কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে তাদের মতন নই আমিও কি?’ কবিতাটিতে মানুষের অনিশ্চিত জীবন আর চিরায়ত সংকট উঠে এসেছে রূপকের মাধ্যমে। ‘ক্যাম্পে’ শেষ হয় আমাদের অন্তরের রক্তক্ষরণের শাশ্বত চিত্র আর দিশাহীন জীবনের চিত্র এঁকে- ‘হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে তাহারাও তোমার মতন- ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদেরও হৃদয় কথা ভেবে ভেবে।’ ‘কথা ভেবে ভেবে’ লাইনে ‘ভেবে ভেবে’ আধুনিক জীবনের ক্লান্তিকর রূপটি তুলে আনে। জীবনানন্দের চিন্তা যেন অন্তহীনভাবে একঘেয়ে গধপনবঃয এর ক্লান্তির মতোই, ‘ঞড়সড়ৎৎড়ি , ঃড়সড়ৎৎড়ি ধহফ ঃড়সড়ৎৎড়’ি, এক অন্তহীন জীবনের নিশ্চেতনার উপস্থাপন। এর সঙ্গে মহাপৃথিবীর ‘আদিম দেবতারা’ কবিতার ‘ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-ব্যবহৃত’ শব্দগুলোও তুলনীয়। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতাটিতে জীবনানন্দ ‘কাক ও কোকিল’- কে অবিনশ্বর ও প্রবাহমানতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন এভাবে- ‘কবেকার কোকিলের, জানো কি তা? যখন মুকুন্দরাম, হায়, লিখিতেছিলেন ব’সে দু’পহরে সাধের সে চন্ডিকামঙ্গল, কোকিলের ডাক শুনে লেখা তাঁর বাধা পায়- থেমে থেমে যায়;’ কীটসের ‘ওড টু নাইটিঙ্গেল’ কবিতায় নাইটিংগেল পাখিকে একই অবিনশ্বর ধারার প্রতীক হতে দেখা যায়- ‘ঞযব াড়রপব ও যবধৎ ঃযরং ঢ়ধংংরহম হরমযঃ ধিং যবধৎফ ওহ ধহপরবহঃ ফধুং নু বসঢ়বৎড়ৎ ধহফ পষড়হি.’ জীবনানন্দ বর্তমানকে খুঁজে নিয়েছেন অতীতের মাঝে। এবং সেখানে রয়েছে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের প্রাণপ্রাচুর্য। ‘বনলতা সেন’ আমাদের চমক জাগিয়ে কীটসের কবিতা ‘অন ফার্স্ট লুকিং ইনটু চ্যাপম্যানস হোমার’ এর কথা মনে করিয়ে দেয়- গঁপয যধাব ও ঃৎধাবষষবফ রহ ঃযব ৎবধষসং ড়ভ মড়ষফ, অহফ সধহু মড়ড়ফষু ংঃধঃবং ধহফ শরহমফড়সং ংববহ; জড়ঁহফ সধহু বিংঃবৎহ রংষধহফং যধাব ও নববহ ডযরপয নধৎফং রহ ভবধষঃু ঃড় অঢ়ড়ষষড় যড়ষফ. ‘বনলতা সেন’ কাব্যের আরেকটি সুপরিচিত কবিতা হলো ‘হায় চিল’: ‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!’ এই কবিতাটির সঙ্গে ইয়েটস এর ‘হি রিপ্রুভস দা কারলিউ’ এর কী অপূর্ব মিল পাওয়া যায়- ঙ পঁৎষব,ি পৎু হড় সড়ৎব রহ ঃযব ধরৎ, ঙৎ ড়হষু ঃড় ঃযব ধিঃবৎ রহ ঃযব বিংঃ; ইবপধঁংব ুড়ঁৎ পৎুরহম নৎরহমং ঃড় সু সরহফ চধংংরড়হ-ফরসসবফ বুবং ধহফ ষড়হম যবধাু যধরৎ. জীবনানন্দের সঙ্গে ইয়েটস এর মানস-নৈকট্য বুঝে ওঠায় সহায়ক হয় ইয়েটস ‘দা ক্যাট এ্যান্ড দা মুন’ এর পাশে এর জীবনানন্দের ‘বিড়াল’ কবিতাটি রাখলে। ‘মহাপৃথিবী’কাব্যের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর অর্থাভাব, কর্মহীনতা, বেকারত্ব ইত্যাদি নির্বিশেষ সামাজিক অবক্ষয়গুলো প্রকটভাবে প্রকাশিত। ইউরোপের মন্দা বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করেছিল। এ কবিতায় তাই পাওয়া যায় ঐ সময়ের মানুষের জীবনের পীড়ন এবং যন্ত্রণাময় সময়ের গ-ি পেরোনোর চিত্রকল্প। কবিতাটির এ অংশটি উল্লেখযোগ্য- ‘জানি-তবু জানি নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি; অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়- আরও-এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে ক্লান্ত করে, ক্লান্ত করে; লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই; তাই লাশকাটা ঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।’ কবিতার ‘ক্লান্ত করে, ক্লান্ত করে’ লাইন দুটোর অন্তর্গত নিষ্ফলতা, অসাড়তা এবং ক্লান্তিবোধের সঙ্গে এলিয়টের ‘লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফক’ কবিতার প্রতিচ্ছবি এক হয়ে যায় ; এক ধরনের অসুস্থ মানসচিত্র ধরা পরে প্রুফকের ‘ঢ়ধঃরবহঃ বঃযবৎরুবফ ঁঢ়ড়হ ঃধনষব’ এর মতো করে। কবিতার লাইন ‘লাশকাটা ঘরে/সেই ক্লান্তি নাই’ আবারও জীবনানন্দের জীবনের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণার প্রতিবাদ হয়ে থাকে। পরবর্তী জীবনে কবি বরিশালের মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি, ধানসিঁড়ি নদী থেকে চলে আসেন কলকাতার প্যাঁচানো অলিগলি আর ফুটপাথে। মহাপৃথিবী কাব্যের ‘ফুটপাথে’ কবিতায় এক বিবমিষাকর শহরের চিত্র আঁকেন কবি। বরিশালের অপরূপ প্রকৃতি নয় ‘ফুটপাথে’ কবিতায় অনুভূত হয় ‘বিষাক্ত বিষাদ স্পর্শ’ ‘ঠা-া বাতাস’ ‘পায়ের তলে লিকলিকে ট্রামের লাইন’। এই মায়াহীন শহরে কবি হৃদয় ভেঙ্গে যায় কারণ ‘প্যাঁচা তার ধূসর পাখা আমলকীর ডালে ঘষবে না এখানে,/আমলকীর শাখা থেকে নীল শিশির ঝরে পড়বে না’। ‘পায়ের তলে লিকলিকে ট্রামের লাইন’ আবার এলিয়টের ‘লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফক’ এর কথা মনে করিয়ে দেয়; ‘বষষড়ি ংসড়শব’ ‘যধষভ-ফবংবৎঃবফ ংঃৎববঃ’ ‘ংঃৎববঃং ঃযধঃ ভড়ষষড়ি ষরশব ধ ঃবফরড়ঁং ধৎমঁসবহঃ ড়ভ রহংরফরড়ঁং রহঃবহঃ’ এগুলো কুটিল শহরের অন্ধকার চিত্রায়ন। অন্যদিকে, জীবনানন্দের ‘রাত্রি’ কবিতাটিতে এলিয়েটের মতো হৃদয়হীন, অগভীর ভালোবাসার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। ‘একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে অস্থির পেট্রল ঝেড়ে,-’ লাইনটিতে ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতার ‘ঃধীর ঃযৎড়ননরহম ধিরঃরহম’ এর একটা সামীপ্য মেলে। ‘রাত্রি’ কবিতার শেষের স্তবকটি এলিয়টের মতো সিম্বলিজমপূর্ণ কবিতাটি আবেগহীন শহুরে জীবন, জঙ্গল আর নৈরাজ্যবাদের মাঝে কোনো দেয়াল রাখেনা ‘নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়/লিবিয়ার জঙ্গলের মতো। তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব- অতিবৈতনিক,/ বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত’। কবিদের কবি এডগার এ্যালান পোর সৌন্দর্যভাবনা, মায়া, স্বপ্নময়তাও জীবনানন্দের কবিতায় পাওয়া যায়। পোর মতো জীবনানন্দও স্বপ্নের হাতে কবি নিজেকে সমর্পণ করেন; এটি পাওয়া যায় কবির ধূসর পা-ুলিপির ‘স্বপ্নের হাত’ কবিতায় কবির স্বপ্ন বাস্তবতা এখানে প্রতীয়মান হয়, ‘পৃথিবীর বাধা-এই দেহের ব্যাঘাতে/হৃদয়ে বেদনা জমে;/স্বপনের হাতে আমি তাই/ আমারে তুলিয়া দিতে চাই।’ ব্যথাহীন স্বপ্ন-কল্পনায় কবি মিশে যান, ‘তোমরা চলিয়া আস- সব।/ভুলে যাও ঐ ব্যথা- ব্যাঘাত-বাস্তব।’ কিন্তু, এতো আধুনিক হয়েও কবি বিচ্ছিন্ন হন না তার প্রিয় গ্রামকেন্দ্রিক মাতৃভূমি থেকে। জীবনানন্দ যত গভীরভাবে বাংলার প্রকৃতিকে ভালোবেসেছেন কোনো কবি এতে তার সমতুল্য হতে পারেন না। তার কাব্যে বিমূর্ততা, স্বপ্ন বাস্তবতা, এবং পরাবাস্তবতা থাকলেও তিনি নেশা ভরা বাংলার প্রকৃতিকে সাজিয়েছিলেন সরল আর সত্য অনুভূতির অভিব্যক্তিতে। জীবিত কালে যেমন অপার স্নিগ্ধতা, আকূলতা, মোহ আর নির্জনতায় সবুজ বাংলার প্রকৃতি প্রেমে আকণ্ঠ নিমগ্ন ছিলেন তেমনি সমান মুগ্ধতা নিয়ে মরণের পরে পেতে চেয়েছেন বাংলার প্রকৃতির উদারতা। মিশে যেতে চেয়েছেন এই মাটিতেই ; রূপসী বাংলার ‘ঘুমায়ে পড়িব আমি’ কবিতায় তারই সরল কিন্তু গভীর আকাক্সক্ষাবোধ। এই কবিতায় কবির আমরণ ভালোবাসা ফুটে উঠে বাংলার প্রকৃতির প্রতি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এখানেও মৃত্যু চিন্তা বাদ যায় না। ‘বাংলার আমের পাতাতে কাঁচপোকা ঘুমায়েছে- আমিও ঘুমায়ে রবো তাহাদের সঙ্গে, ঘুমাবো প্রাণের সাধে এই মাঠে- এই ঘাসে- কথাভাষাহীন আমার প্রাণের গল্প ধীরে ধীরে মুছে যাবে’ জীবনানন্দের কাব্যে আরেকটি বিশেষ যে দিক এখন পাওয়া যায় তা হলো তার মাঝে আধুনিক ইকো-কবিদের মতো পরিবেশ সচেতনতা। তার ‘অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ’ এর অনেক কবিতা এ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ‘মশা মেরে, ধান ভেনে, ইঁদুর তাড়িয়ে’। ‘বড় বড় গাছ কেটে ফেলছে তারা, ঐ মৃত গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি’। ‘পাখির পালক বটের পাতা হতেছে ম্লান’/মরুভূতি সৃষ্টি করে গেছে’। ‘কোথায় গিয়েছে আজ সেসব পাখি আর সেসব ঘোড়া-’। ‘পথের ধারে দেখলাম একটা বেড়াল পড়ে আছে/আস্তে আস্তে ছটফট করে মরে যাচ্ছে’। এ রকম কবিতাগুলোতে প্রকৃতি ও জীবের প্রতি কবির সহানুভূতি আসলে একধরনের পরিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এটা খুব আধুনিক একবিংশ শতকের চেতনা যা থেকে জীবনানন্দ পৃথক নন। জীবনানন্দ দাশ আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্যগুলো গ্রহণ করে অসামান্যভাবে বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু অসাধারণ এই কবিকে শুধু একটি ফ্রেমে বাঁধা যায় না। জীবনানন্দের পেঁচা, এখানে ঘুঘুর ডাকে, বুনো-হাঁস, হঁাঁস, নদী, হেমন্ত, বিড়াল, ঘোড়া, ঘাস, শঙ্খমালা, ডাহুকি, সুন্দরবনের গল্প, জোনকি, রজনীগন্ধা, বড় বড় গাছ, জল, ইত্যাদি কবিতার নাম সাম্প্রতিক অনেক উত্তর-আধুনিক কবিদেরও ব্যবহার করতে দেখা যায়। একটি বিষয় অবাক হয়ে লক্ষ্য করতে হয় সাম্প্রতিক প্রকৃতি কবিতার নবতর ধারা ইকো-পয়েট্রির প্রকৃতি সচেতন লেখক শুধু একজন নয় অনেকে যেমন- জড়নরহংড়হ ঔবভভবৎং , এধৎু ঝহুফবৎ, ঞবফ ঐঁমবং, ঝুষারধ চষধঃয,ঞড়হু ঐধৎৎরড়ংড়হ, উবহরংব খবাবৎঃড়া, ঔড়ু ঐধৎলড়, ঐধৎঃ ঈৎধহব, এর উল্লেখ করার মতো অনেক কবিতার নাম বললে মনে হবে তারা যেন নিজের অজান্তেই জীবনানন্দকে তাদের পূর্বসূরি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এখন তাদের কবিতার নামগুলো পড়া যাক ঐঁৎঃ ঐধশি, খরঃঃষব ডযধষব ঝড়হম, ইধফমবৎ, ঝঢ়ধৎৎড়,ি চযবধংধহঃ, ঋরৎব ধহফ ওপব, ঞযব ঞৎববং, ঝযড়ৎব ইরৎফং, এৎধংং, ঐড়ৎংব, ঝবিবঃ ঈড়ৎহ, ইত্যাদি। যে গাছ, লতাপাতা, পশুপাখি এগুলো প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা নান্দনিকতা আর প্রতীকের কারণে জীবনানন্দের কবিতায় স্থান নিয়েছিল সেগুলোকে এখন প্রকৃতির প্রতি সচেতন করতে ইউরোপ, আমেরিকার প্রথিতযশা কবিরা তুলে আনছেন তাদের কবিতায়। উত্তর-আধুনিক বিশ্ব-সাহিত্যে জীবনানন্দ যেন নতুন করে আবার ফিরে এসেছেন আরও আধুনিক হয়ে। যেন পশ্চিমের কাছে ধার করা নান্দনিকতা আরও ফলবান করে তাদের কাছেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন জীবনানন্দ। যদিও রাজনৈতিক ব্যাপারে জীবনানন্দ তার কাব্যে এক ধরনের নিস্পৃহতা দেখিয়েছিলেন কিন্তু সমাজ সচেতনতা খুব গভীরভাবেই তার কাব্যে বিদ্যমান। চলমান যাপিত জীবনের সংকট, আশাহীন ভবিষ্যতের অমানিশা, মানবিক বিপর্যয়ের আভাস তার কবিতাগুলোতে অত্যন্ত জোরালোভাবেই উপস্থিত। কী ভীষণভাবেই না ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতাটি পড়লে মনে হয় জীবনানন্দ কবিতাটিতে অনেক বছর আগের কোনো মানবিকতার চরম সংকট নয় বরং এই আধুনিক জীবনের ভঙ্গুর রূপটাই এঁকেছেন। অগভীর চেতনার প্রাদুর্ভাব আর বর্তমান মূল্যবোধের দারুণ অবক্ষয় জীবনানন্দ বিদ্রƒপ ভরে বলে গেছেন এক শতাব্দী আগেই। আমরা আজও দেখি না- ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া’ তাই, জীবনানন্দ আজও এতো আধুনিক এবং অনেক বর্তমান আধুনিক কবিদের চেয়েও। তিনি আধুনিক ইউরোপের কবিতার রূপ ও আকার গ্রহণ করে সর্বকালীন অমলিন সাহিত্য রচনা করেছেন। তাই, আজও জীবনানন্দ আমাদের পথ দেখায় আজও তার কাব্যের লালিত মণিমুক্তা আমাদের ঠুনকো ঐশ্বর্যকে ম্লান করে দেয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যের সংগ্রহ করা তার সীমাহীন রূপসী কাব্য সম্ভার আজও হৃদয় সচেতন করে ‘আলোর পৃথিবী’ গড়ে দিয়ে যায় আর মানবিকতার ‘মহাপৃথিবী’ জাগিয়ে তোলে।
×