ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেলের জমিতে গুলিস্তানে অস্থায়ী বাস টার্মিনাল হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৪ জানুয়ারি ২০১৬

রেলের জমিতে গুলিস্তানে অস্থায়ী বাস টার্মিনাল হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর যানজট নিরসনে গুলিস্তানে বঙ্গবাজারসংলগ্ন আনন্দবাজারে অস্থায়ী সিটি বাস টার্মিনাল স্থাপন করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় সাড়ে ৪ একর জমিতে এ অস্থায়ী বাস টার্মিনাল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বুধবার ডিএসসিসির উদ্যোগে সংস্থাটির সেমিনার কক্ষে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাস ট্রাক মালিক ও শ্রমিক ফেডারেশনসহ ট্রাফিক বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে যানজট নিরসনে করণীয় শীর্ষক আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাবৃন্দ ও স্থানীয় পরিবহন শ্রমিক নেতাদের মতে, এ বাস টার্মিনালটি নির্মাণ করা হলে রাজধানীর একাংশের প্রতিদিনের চলমান সৃষ্ট যানজট অনেকাংশে কমে আসবে। নৌপরিবহনমন্ত্রী, ডিএসসিসি মেয়র ও পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতৃবৃন্দের জোর দাবির মুখে ও নানা যুক্তিতর্কের পর রেলমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের এ জমিতে অস্থায়ী বাস টার্মিনাল করার অনুমতি দেন। ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের সময় ওই জমিতে সিটি বাস টার্মিনাল করার সিদ্ধান্ত হলেও পরে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর একই জমিতে নতুন করে টার্মিনাল নির্মাণের চিন্তা করা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ রেলপথ মন্ত্রীর কাছে ওই জমি রেলওয়ের প্রয়োজনসাপেক্ষে যে কোন সময় ফেরত দেবেÑ এমন শর্তে রাজি হওয়ায় এ অস্থায়ী টার্মিনাল স্থাপনের জন্য জমি প্রদানে রাজি হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। বর্তমানে এ জমিটি অবৈধ দখলে রয়েছে বলে সভাসূত্রে জানা গেছে। রেলওয়ের ওই জমি অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার করে সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পরিবহন সেক্টরের নেতৃবৃন্দ সহায়তা করবেন বলে আশ্বাস দেয়া হয়। ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকনের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেনÑ নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, ট্রাফিক বিভাগের ২ জন উপ-পুলিশ কমিশনার এবং বাস-ট্রাক মালিক ও শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা। সভায় যানজট নিরসনে ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, আমরা নগরীর যানজট কমাতে রেলের জমিতে এ অস্থায়ী বাস টার্মিনালটি নির্মাণ করব। অস্থায়ীভিত্তিতে এ জায়গায় বাস রাখা যাবে। তবে রেল কর্তৃপক্ষ যখন চাইবে তখনই জায়গাটি ফেরত দেয়া হবে। আমরা জানি রাজধানীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে গুলিস্তান ফুলবাড়ীয়া। এ এলাকায় প্রতিদিন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ লোক আসা-যাওয়া করেন। এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এ এলাকায় অবস্থিত। ফলে প্রায় সময়ই যানজট লেগে থাকে। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, গুলিস্তানকে কোনক্রমেই যানজট করে রাখা যাবে না। এজন্য প্রয়োজনীয় যা করার তাই করা হবে। মেয়র বলেন, আমরা গুলিস্তান এলাকার যানজট কমাতে একটি বাস-বে তৈরি করব। এছাড়া বর্তমানে এ এলাকায় যত্রতত্র বাস মিনিবাস রাখা হয়। এটা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, যা প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মেয়র বলেন, গুলিস্তান পোড়া মার্কেটের সামনে কোন বাস রাখা যাবে না। এখানকার বাসগুলো টিএ্যান্ডটির সামনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেখানে সিঙ্গেল লাইনে বাস দাঁড়াতে পারবে। রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের বাইরে কোন বাস রাখা যাবে না। বর্তমানে রাজধানীতে দূরপাল্লার একটি বাস কোম্পানির এক থেকে ১৭টি পর্যন্ত বাস কাউন্টার রয়েছে। যেগুলো যানজট সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই বাস রাখতে হলে রাস্তার উপর যত্রতত্র রাখা যাবে না। টার্মিনালের ভেতরেই রাখতে হবে। একই সঙ্গে কোন বাস কোম্পানির দুটির বেশি কাউন্টার থাকতে পারবে না। কেউ যদি এ নির্দেশ না মানেন তাহলে সে কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জন্য প্রয়োজনে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া তিনি এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সহায়তা চান। সভায় আনন্দবাজারের ওই জায়গাটি কিভাবে ব্যবহার করা হবে বা বাস টার্মিনাল কিভাবে পরিচালিত হবে, তা নির্ধারণে নৌপরিবহন মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৫ সদস্যের এ কমিটিতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফিরোজ সালাহউদ্দীন, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন, ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী খান মোঃ বিলাল, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। এর আগে নগরীর যানজট এড়াতে বাস ও ট্রাক পার্কিং করার জন্য বঙ্গবাজারের পাশে আনন্দবাজারসংলগ্ন রেল মন্ত্রণালয়ের খালি পড়ে থাকা জমি সাময়িক ব্যবহারের জন্য উপস্থিত সকলের পক্ষ থেকে মন্ত্রী মুজিবুল হকের কাছে আবেদন করেন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। মন্ত্রী ও মেয়রের এমন দাবির প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠানে কিছুটা অভিমানের সূরে বেঁকে বসেন রেলমন্ত্রী। মন্ত্রী বলেন, এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। আমাদের এই জমিতে বহুতলবিশিষ্ট একটি আইকনিক ভবন নির্মাণের ইচ্ছে আছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে সংসদীয় কমিটিতে সিদ্ধান্তও হয়েছে। এটাকে আমরা নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করব। এটা দেয়া যাবে না। তবে সিটি কর্পোরেশনের যে কোন প্রয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা থাকবে। এ সময় বাস মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে মন্ত্রীকে স্মরণ করে দিয়ে তারা বলেন, এ জমিতে একটি অত্যাধুনিক ট্রাক স্ট্যান্ড করার জন্য আপনি ওয়াদা দিয়েছিলেন। তাছাড়া এরশাদ সরকারের আমলে এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। নক্সাও অনুমোদিত ছিল। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি। রেলমন্ত্রীর বর্তমান অবস্থানের কারণে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, মাননীয় মন্ত্রী, আপনার বিল্ডিংয়ের কী অবস্থা? আপনি ডিজাইন করেছেন? ভবন নির্মাণের জন্য অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে? এজন্য আপনাকে ১০-১২টি দফতরের ছাড়পত্র নিতে হবে; তা নিয়েছেন? একটা একদিনেই আপনি করতে পারবেন না। মন্ত্রণালয় চালানোর কারণে আমারও কিছু অভিজ্ঞতা আছে। আপনার কাছে আমরা এই জমি অস্থায়ীভাবে চাই। আপনি দেন। মন্ত্রণালয়ে আপনিও বেশি থাকবেন না। আমিও না। সাঈদ খোকনও থাকবেন না। আমাদের লক্ষ্য মানুষের সেবা করা। যেদিন আপনার প্রয়োজন হবে আমরা তা ফেরত দেব। নৌমন্ত্রী উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমি পদ্মাপারে একটি ট্রাক স্ট্যান্ড করার জন্য তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে আবেদন করি। তিনি আমাকে লিখিতভাবে জানিয়ে দেন এখানে তা করা যাবে না। পদ্মা সেতু হবে। উনি করতেই দিলেন না। আমি জোর করেই করলাম। পরে যখন পদ্ম সেতুর কাজ শুরু হয়েছে আবার ছেড়ে দিলাম। জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, একবার দখলে যেতে পারলে কেউ আর তা ছাড়ে না। এ সময় মেয়র সাঈদ খোকনও রেলমন্ত্রীকে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করেন। পরে মন্ত্রী বলেন, ঠিক আছে, আপনারা লোক ঠিক করে একটা কমিটি করে দেন। যখন আমাদের প্রয়োজন হবে জমি ছেড়ে দেবেন। এ সময় অনেকটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে নৌমন্ত্রী বলেন, এখানে সাংবাদিক ভাইয়েরা আছেন। তারা কোড করে দেবেন। সরকারের জমি কেন দখলমুক্ত হয় না। রোগটা কোথায়? রোগ আমাদের ডিপার্টমেন্টে। এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের ফুটপাথ দখলমুক্ত করার পর তা আবার বেদখল হওয়ার ব্যাপারে মেয়র পুলিশের মতামত জানতে চাইলে ট্রাফিক দক্ষিণ জোনের ডিসি খান মুহাম্মদ রেজোয়ান হকার্সদের পুনর্বাসন না করে উচ্ছেদের বিপক্ষে মত দিয়ে তোপের মুখে পড়েন। এ সময় মেয়র বলেন, অল্প কয়েক হকার্সের জন্য কোটি মানুষের দুর্ভোগ মানা যায় না। ডিসি বলেন, মানবিক দিক বিবেচনায় হকারদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে উচ্ছেদ করা উচিত। এতে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এর উত্তরে নৌমন্ত্রী বলেন, পুলিশ যদি ঠিক হয় রাস্তায় রাস্তায় হকার বসতে পারে না। পুনর্বাসনের মানবিক কথা বলে মূল সমস্যা এড়িয়ে যাবেন না। আনন্দবাজারের ওই জমিতে সিটি কর্পোরেশনের আবদারের বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন বলেন, এর আগে মাত্র ৪ ভাগ লাভের বিনিময়ে আমাদের ২ দশমিক ৮৭ একর জমি সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন সেই চুক্তি মানেনি। বরং তারা আমাদের জমি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ইজারা দিয়ে দিয়েছে। এমনকি ওই স্থানে স্থায়ী আবাসন পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়েছে, যা খুবই কষ্টকর। এসব কর্মকা- থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। সভায় যানজট কমাতে নৌপরিবহনমন্ত্রী বেশ কয়েকটি নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বলেন, রাস্তার পাশে কোন বাস ট্রাক পার্কিং করা যাবে না। নির্দিষ্ট কাউন্টার ছাড়া যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা করানো যাবে না। তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। বাসস্ট্যান্ডে কোন প্রকার গাড়ি মেরামত করা যাবে না। সিটি কর্পোরেশন থেকে রাস্তাগুলো সংস্কার করতে হবে। উন্নত বিশ্বের ন্যায় অল্প স্থানে অধিক বাস রাখার জন্য হাইড্রোলিক কার পার্কিং স্থান নির্মাণ করতে হবে। ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তাকে সম্প্রসারণ করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা যদি ঠিক হই হকাররা রাস্তায় বসতে পারবে না। তাদের মানবিক সমস্যার কথা বলে শহরকে রক্ষা করা যাবে না। আমাদের শহর আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। সভায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লাহ সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ভেতরের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা, অতিরিক্ত বাস রাখার জন্য সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের পাশের ওয়াসা বস্তির স্থান বরাদ্দ, সায়েদাবাদের বাস গুলিস্তান ঢুকতে না দেয়া, গুলিস্তানের ফুটপাথ ও রাস্তা বেদখলের হাত থেকে উদ্ধারের দাবি জানান। সভায় বাস ট্রাক মিনিবাসসহ বিভিন্ন পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
×