ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চৌধুরী শাহজাহান

শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে বাঙালীর স্বরূপ সন্ধান

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে বাঙালীর স্বরূপ সন্ধান

শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮) বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে প্রথম পথিকৃতের দাবিদার, যিনি মাটি ও জনজীবনের সঙ্গে একীভূত হয়ে শিল্প সাধনায় অভিনিবিষ্ট ছিলেন আমৃত্যু। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তিনি জীবনকে যেভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং মর্মে উপলব্ধি করেছেন তারই বাস্তব রূপায়ণ ঘটিয়েছেন তাঁর কথাসাহিত্যে। শওকত ওসমানের স্বাধীনতা-পূর্ব এবং স্বাধীনতা-উত্তর উপন্যাসগুলোকে যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখা যায় যে, তিনি তাঁর উপন্যাসগুলোতে বাংলাদেশের নিরন্ন মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, চাওয়া-পাওয়া, সমকালীন রাজনৈতিক অস্তিরতার ঘটনা, সমাজের বাস্তব করুণ চিত্র প্রভৃতিকে স্থান দিয়েছেন সর্বাগ্রে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি কোথাও জীবনের সঙ্গে আপোস করেননি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, আটান্নর সামরিক শাসন, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ মুদ্রিত হয়েছে তাঁর উপন্যাসগুলোতে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর জাতিসত্তার স্বরূপ নির্ণয়ের জন্য লক্ষ লক্ষ বাঙালীর এক রক্তাক্ত দলিল। দীর্ঘ নয় মাস বাংলার ছাত্র, কৃষক,সাধারণ মানুষ, কুলি,মজুর, ইপিআরসহ লক্ষ বঙ্গ সন্তান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ ও মুক্ত করে স্বদেশকে, অর্জন করে নিজস্ব জাতীয় পতাকা, সম্মান ও বিজয়ের জয়টিকা। তাই মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর জাতীয় জীবনে এক বিরাট অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে রচিত হয়েছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চিত্রকলা ও সঙ্গীত। বিশেষ করে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর্যশিল্পী ও সঙ্গীতশিল্পীরা প্রচ-ভাবে সক্রিয় ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের তারুণ্যকে তাঁদের রং-তুলি-রেখায়-শব্দে ধারণ করতে। আপন মাধুরী মিশিয়ে চিত্রায়িত করেছেন আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শওকত ওসমান গোলাবারুদ বা রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করেননি একথা যেমন সত্য তেমনি যুদ্ধের পক্ষে যে তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল একথাও মিথ্যে নয়। যুদ্ধের সময়গুলোতে তিনি ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যাপক। বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানী সৈন্যদের ধ্বংসলীলার তা-ব নৃত্য চলছে, তখন তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে চলে যান। সেখানে তিনি যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। অধ্যাপক থেকে তিনি হয়ে ওঠেন শব্দ সৈনিক। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি নিয়মিত কবিতা ও কথিকা পাঠ করতেন। সে সময় তাঁর উল্লেখযোগ্য কথিকাগুলোর মধ্যে ’ইয়াহিয়া জবাব দাও প্রথম সওয়াল’, ’ইয়াহিয়া জবাব দাও দ্বিতীয় সওয়াল’, ‘দেশবাসীর সমীপে নিবেদন’ এবং কবিতা, গল্প ইত্যাদি। এগুলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে তেমনি তাদের মনোবলকে করেছে বিনষ্ট। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল লিখেছেন, ”শিক্ষকদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক শওকত ওসমান, ড. মযহারুল ইসলাম, ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবদুল হাফিজ, অধ্যাপক বদরুল হাসান প্রমুখ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিতভাবে কবিতা প্রচার শুরু করলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে তাঁর ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এদেশের মানুষকে তিল তিল করে শোষণ করছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা যে আমাদের অধিকার ভোগ করতে দেয়নি তারই প্রমাণ রয়েছে কথিকাগুলোতে। তাঁর ভাষায়,” ভাই বোনরা আমার, আমরা ভাল মানুষীয়ানার দাম দিচ্ছি। বড় চড়া দাম-বাংলাদেশের পাট চাষীরা ফসলের দাম পায় না। রোদে বৃষ্টিতে অমানুষিক পরিশ্রমের পর তাদের আবাস জীর্ণ কুঁড়ে ঘর, ভরপেট দু’বেলা অন্ন তাদের কাছে স্বপ্ন। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা তারা ভাবে না। যেহেতু কূল কিনারা অসম্ভব। সেই পাটে আদমজী ইস্পাহানীরা শুধু ধনকুবের হয় না। ঐ ফসলজাত বৈদেশিক মুদ্রায় শুধু ধনকুবের হয় না, ওই ফসলজাত বৈদেশিক মুদ্রার কেনা অস্ত্রে সজ্জিত হয় পাঞ্জাবি সেনাবাহিনী। সেই অস্ত্র আজ আমাদের বুকে বিঁধছে। ভাল মানুষীয়ানার দাম এভাবে দিতে হয় নাকি? কেউ কোথায় দিয়েছে ? এভাবেই তিনি ভূমিকা রাখেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সাহসী ব্যক্তিরূপে। শওকত ওসমান ছিলেন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী একজন বাস্তববাদী লেখক। আর সেজন্যই তিনি চিত্রায়িত করতে পেরেছেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোকে সফল ও সুচারুভাবে। শওকত ওসমানের উপন্যাসের বিষয়বস্তু বহু বিচিত্র। সমাজের নিরন্ন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের চালচিত্র যেমন চিত্রায়িত হয়েছে তাঁর উপন্যাসে তেমনি রূপায়িত হয়েছে উচ্চবিত্তের জীবনচিত্র। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শওকত ওসমান চারটি উপন্যাস রচনা করেন। উপন্যাসগুলো হচ্ছে ’জাহান্নাম হইতে বিদায়’ (১৯৭১), ’দুই সৈনিক’ (১৯৭২), ’জলাঙ্গী’ (১৯৭৩) এবং ’নেকড়ে অরণ্য’ (১৯৭৪)। ’জাহান্নাম হইতে বিদায়’ (১৯৭১) শওকত ওসমানের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক উপন্যাস। দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রী সাগরময় ঘোষের অনুরোধে তিনি এই উপন্যাস রচনা করেন এবং ঐ পত্রিকায় এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি সাতটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত।এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখক তাঁর নান্দীপাঠে লিখেছেন - ’ বাংলাদেশের ট্র্যাজেডির প্রকৃত কাহিনীকারের অপেক্ষায় আছি। অল্প পরিসরে ওই সামাজিক ঘূর্ণিঝড়ের সম্যক পরিচয়দান কঠিন। বক্ষ্যমাণ উপন্যাস একটিমাত্র মানসলোকের বিবরণ। সেখানে পরিবেশ মতো যেটুকু ছায়া পড়েছে, তার কোন পটভূমির হদিস হয়নি।’ ’ জাহান্নাম হইতে বিদায়’ উপন্যাসের পটভূমি ১৯৭১ সাল। এই উপন্যাসে শিক্ষক গাজী রহমানের মানসলোকই পুরো উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। গাজী রহমানের মাধ্যমেই আমরা এ উপন্যাসে বিধৃত অন্য চরিত্রগুলোর সন্ধান লাভ করি। বাংলাদেশ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলে মাসদেড়েক পর একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক গাজী রহমান জীবন রক্ষার আদিম তাগিদে শহর ছেড়ে অনিশ্চিত গন্তব্যে রওনা হন। প্রথমে তিনি আশ্্রয় নেন এক প্রত্যন্ত গ্রামে তাঁর এক পুরনো ছাত্রের বাড়িতে। ছাত্রটির নাম ইউসুফ। ইউসুফ সওদাগরী অফিসের কেরানী। ইউসুফের স্ত্রী সখিনা গাজী রহমানকে সেবা যতœ করে। গাজী রহমান হানাদার বাহিনীর কিছু কিছু অত্যাচার দূর থেকে প্রত্যক্ষ করেছে। সে দেখেছে গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কখনও প্রতিবাদ করতে পারেনি। তাদের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন ” তাদের কী আখ্যা দেবে, জন্তু দানব বা আর কিছু,তাও বাঙালী কোনদিন স্থির করতে পারবে না। তেমন ঘৃণা প্রকাশের ভাষা বাঙালীর কাছে এখনও অজ্ঞাত।” এক সময় গাজী রহমান জানতে পারেন ইউসুফের গ্রামও দখলদার মিলিটারি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হবে। তাই তিনি সেখান থেকে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইউসুফের বাসস্থান ছেড়ে তিনি তাঁর পুরনো বন্ধু রেজা আলীর বাড়িতে ওঠেন। সেখানে তিনি এককালের সন্ত্রাসবাদী ও পরবর্তীকালে প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠক কিরণ রায়ের সঙ্গে পরিচিত হলেন। সবাই পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে, এখানে থাকা নিরাপদ নয়। সীমান্তের ওপারে যেতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে এক আধটু ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। রেজা আলীর ব্যবস্থাপনায় সৈয়দ আলী নামের এক তরুণের সহায়তায় গাজী রহমানকে সীমান্তে অতিক্রমের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। সীমান্তে অতিক্রমের পূর্বে আমরা একটি ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হই। গ্রামবাসী কিছু দলছুট পাকিস্তনী সৈন্য দেখতে পায়। তারপর কিভাবে তারা সৈন্যদের মসজিদের ভেতর ঢুকিয়ে মরিচগুঁড়ো দিয়ে অজ্ঞান করে এবং পরে মেরে ফেলে তার কাহিনী শুনতে পাই আমরা আলমের জবানীতে। আলম একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। সব শেষে গাজী রহমানের সীমান্ত অতিক্রমের মধ্য দিযে কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটে। এই হচ্ছে এই উপন্যাসের মোটামুটি কাহিনী। ’ জাহান্নাম হইতে বিদায়’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র প্রবীণ শিক্ষক গাজী রহমান। অন্য চরিত্রগুলোন মধ্যে রেজা আলী, কিরণ রায়, সৈয়দ আলী, মাঝি, আলম, ইউসুফ, বৃদ্ধা, ফালু ইত্যাদি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে যেভাবে নিনাদিত হয়েছে তা গাজী রহমানের মনোজগতে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁর স্কুল বিভিন্ন কাজে ভূমিকা রেখেছে। তাই হানাদার বাহিনীর কালো তালিকায় তাঁর নাম ওঠে। তাঁর জীবন হয়ে ওঠে বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ফলে ফাঁকা শহর ছেড়ে তাকে গোপনে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বের হতে হয়। গাজী রহমান পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে প্রথম তাঁর ছাত্রের বাড়িতে আশ্রয় নেন। তিনি জানেন, তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। আবার এ অত্যাচার তিনি নির্বিচারে মেনেও নিতে পারেন না। তাই তাঁর মধ্যে দোলাচল মানসিকতার জন্ম নেয়। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারার জন্য তাঁর মধ্যে অপরাধবোধ দেখা দেয়। কিরণ রায় গাজী রহমানকে বললেন যে, প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে পারে। আর তখনই গাজী রহমান উপলব্ধি করলেন যে, তিনিও যুদ্ধের সপক্ষে কাজ করতে পারেন। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন ওপারে চলে যাবেন। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় গাজী রহমান পাকিস্তানী বাহিনীর সৈনিকের মুখোমুখি হন। তারা বাসের যাত্রীদের তল্লাশি করেন এবং দুযুবককে ধরে নিয়ে যান। গাজী রহমানসহ বাসের অন্য যাত্রীরা প্রতিবাদমূলক কোন কখা বলতে সাহস পায়নি। তাঁর মধ্যে বিবেকের দংশন শুরু হয়। ”তোমরা কথা বলতে ভয় পাও? তোমরা অশিক্ষিত দরিদ্র আর আমিও বহু ডিগ্রী অর্জনের পর তোমাদের খুঁটিতেই বাঁধা রয়েছি। আমাকে খুন কর গলা টিপে আমাকে খুন কর। মূর্খ আর প-িত সমান ওজন।” এই অনুভূতি প্রকাশের পর গাজী রহমান তাঁর পথের সন্ধান পান। পরিবারের কথা তাঁর মনে থাকে না। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় সৈয়দ আলীর সাথে বিদায়ের পালা শেষ করার আগে তিনি ইউসুফের স্ত্রী সখিনার কাছে একটি চিঠি পৌঁছিয়ে দিতে বলেন। এই চিঠি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর অন্তরে গ্রথিত ধারণার প্রকাশ পেয়েছে। ”অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারে শুধু বীর পুরুষরা। মুক্তিফৌজের ব্রত তাই কঠিন। এমন কঠিনের সাধনা গ্রহণ করিয়াছে আমাদের মুক্তিফৌজবৃন্দ।” এই উপন্যাসে আমরা গাজী রহমানের খাঁটি দেশপ্রেম লক্ষ্য করি। গাজী রহমান যেন শওকত ওসমানের প্রতিমূর্তি। লেখক নিজের জীবনের খ-িত একটি অধ্যায়ের রূপায়ণ করেছেন আলোচ্য উপন্যাসে সুুচারুভাবে। এই উপন্যাসের আরেকটি চরিত্র সৈয়দ আলী। লেখক এই চরিত্রটিকে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। সে নিঃস্বার্থ ও পরোপকারী। সৈয়দ আলী গাজী রহমানকে সীমান্ত অতিক্রমের সময় সহযোগিতা করে। গাজী রহমান তার পরিচয় জানতে চাইলে সে বলে, ”গোলামের কোনো পরিচয় থাকে না। গোলাম গোলামই। স্বাধীন বাংলাদেশই হবে আমার পরিচয়।” ফার্মের কেরানী ইউসুফ গাজী রহমানের একজন প্রাক্তন ছাত্র। তাঁর শিক্ষক গাজী রহমানকে বিপদের সময় তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল। গ্রামে হানাদার দ্বারা আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিলে সে শিক্ষকের নিরাপত্তার কথা ভেবে আকুল হয়। শিক্ষককে নিশ্চিন্তে কোথাও যেতে দিতেও সে ভরসা পায় না, যদি পাছে শিক্ষকের কোন বিপদ ঘটে। স্বল্প পরিসরে লেখক এই চরিত্রকে দরদের সঙ্গে অঙ্কন করেছেন। ইউসুফের স্ত্রী সখিনা স্বল্প পরিসরে উদ্ভাসিত এই উপন্যাসের একটি নারী চরিত্র। সখিনা গ্রাম্য জীবনে অভ্যস্থ সাধারণ বধূ মাতারই প্রতিচ্ছবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সখিনার ভাই। পঁচিশে মার্চের পর থেকে তাঁর কোন খোঁজ-খবর নেই। ভাইয়ের শোকে সখিনা মুহ্যমান হয়ে উঠলে প্রবীণ শিক্ষক গাজী রহমান ছলনার আশ্রয় নিয়ে বলেন, খালেদ মুক্তিফৌজে গিয়েছে। আর সে থেকেই মুক্তিফৌজের প্রতি সখিনার মনে এক ধরনের আগ্রহ জন্মে। এ চরিত্রটি আর বিকাশের সুযোগ দেননি লেখক। লেখক ইচ্ছা করলে এই চরিত্রটিকে আরও সম্প্রসারিত করে একটি আদর্শ চরিত্রের রূপ দিতে পারতেন। ’জাহান্নাম হইতে বিদায়’ উপন্যাসে রূপায়িত উল্লেখিত চরিত্রগুলো তেমন একটা ঘটনাবহুল নয়। তবে গ্রামের বৃদ্ধা মহিলা ও তার ছেলে ফালু চরিত্রের উপস্থাপনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে লেখক উপন্যাসটিকে অত্যন্ত বাস্তবমুখী করে তুলেছেন। সমাজ সচেতন লেখক শওকত ওসমান এই দুটি চরিত্রের মাধ্যমে একদিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতা নিষ্ঠুরতা, অন্যদিকে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে পরস্পরের বিপরীতে স্থান দিয়ে প্রখর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। বৃদ্ধা মহিলা শহুরে রাঁধুনীর কাজ করত। স্বামী করত দিন মজুরের কাজ। পাক সৈন্য বাহিনীরা বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দিলে সব পুড়ে যায় এবং তারা যাকে যেখানে পেয়েছে গুলি করে হত্যা করেছে। কোন রকমে প্রাণে রক্ষা পায় বৃদ্ধা ও তার ছেলে ফালু। লেখকের শিশু মনস্তত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায় ফালুর উক্তিতে- ” তুমি কইলে না ক্যান মা, বাজান আমাগো ধাক্কা দিয়া পাশে ঠেইলা দিছিল হেয়ালা খানকীর পুতেরা যখন গুলি ছোড়ে তাই বাজান মইরা গেলেন-আরা বাঁচলাম। আমিও হালাদের গুলি করমো।” শহর থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে ক্লান্ত বৃদ্ধা ও তার ছেলে ফালু যখন গাজী রহমানের নৌকায় করে কিছুটা পথ যাওয়ার সুযোগ পায় তখন বৃদ্ধার হাতে অন্য জিনিসপত্রের সঙ্গে একটি তারের খাঁচায় ছিল এক হালি বিলেতি ইঁদুর। শহরের বাসা ছেড়ে আসার সময় এই ইঁদুরগুলোকে ফেলে আসতে তাদের মায়া লেগেছে। বৃদ্ধা গাজী রহমানকে একথাটি বর্ণনা করেন এভাবে- ” ভাইজান, অবলা প্রাণী, ভাবলাম থুইয়া আসি। কিন্তু ভাবলাম, এগুলোর কেউ যতœ নিব না। খাওয়া বেগর মইরা যাইব। জান হ¹লের সমান।” ইঁদুরগুলোকে বয়ে আনা খুব কষ্টকর। তবু বৃদ্ধার ছেলে ফালু বলে, ’ মা খাঁচা বইতে আমার জান যায় গা। তবু ইঁদুর রাইখ্যা আসতাম না।’ ইতর প্রাণীর প্রতি ফালুর ও তার মা বৃদ্ধার ভালবাসা প্রমাণ করে হানাদার বাহিনীর বিভীষিকাময় অত্যাচারের মধ্যে কয়েকটি ইতর প্রাণীর প্রাণ বাঁচানোর যে দৃঢ় সঙ্কল্প তার সঙ্গে গণহত্যার মতো নিষ্ঠুরতার ব্যবধান কোথায় ? ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান এই উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণ ও ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শব্দ চয়নের ক্ষেত্রেও লেখক মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। একটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস হিসেবে একে বিচার করলে এতে মুক্তিযুদ্ধের তেমন স্মরণীয় প্রতিচিত্র পাওয়া যায় না। গাজী রহমানের দেশত্যাগের মাধ্যমেই উপন্যাসের কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটে। এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সুনির্দিষ্ট কোন কাহিনীও নেই। এই উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরা কেউ মহৎরূপে চিত্রায়িত হয়নি। তবুও বলা যায় উপন্যাসটিতে মুক্তিযুদ্ধের সমকালীন সাধারণ মানুষের একটি বিশেষ দিক, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মানসিকতা, পাঞ্জাবি সৈনিকদের প্রতি বাঙালীর ঘৃণা এবং যুদ্ধ করে এদেশ এদের কবল থেকে স্বাধীন করার প্রবল ইচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে। বাঙালী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কেউ কেউ প্রগতিপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও তবু কিসের একটা বন্ধন যেন তাদের আটকে রাখে। তারা পিছ ুটানে হঠাৎ থমকে দাঁড়ান। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও তাঁদের ভূমিকা ছিল অনেকটা নিষ্ক্রিয় অথচ আপামর জনসাধারণের ভূমিকাই মুক্তিযুদ্ধকে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। এ সবের বিম্বিত রূপ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোতে উজ্জ্বলভাবে রূপায়িত হয়েছে। মধ্যবিত্তের মানসবৃত্তি দোলাচল থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাদের মাঝেও জাগরূক ছিল। কেউ সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, কেউবা মুক্তিযোদ্ধাদের বিপদের সময় আশ্রয় দিয়ে আবার কেউবা লেখনি শক্তি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে-স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আনোয়ার পাশার ’ রাইফেল রোটি আওরাত’ (১৯৭৩) এর অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীন, শওকত আলীর ‘যাত্রা’র (১৯৭৬) অধ্যাপক রায়হান, রশীদ হায়দারের ’ খাঁচায়’ (১৯৭৫) এর অধ্যাপক তাহের এমনকি শওকত ওসমানের ’ জাহান্নাম হইতে বিদায়’-এর প্রৌঢ় শিক্ষক গাজী রহমান-এঁদের প্রত্যেকের শ্রেণী চরিত্র মধ্যবিত্ত। এঁদের চেতনায় কাজ করেছে মধ্যবিত্তের জীবন মানসিকতা, এঁদের কাছে স্ত্রী-পুত্র নিজের জীবনের জন্য মায়ার মতো মনে হয়েছে। এঁরা যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত ছিলেন তা বলা যাবে না। ’ পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এটাও তাঁরা কামনা করেননি। প্রত্যক্ষ না হলেও যুদ্ধের প্রতি তাঁদের পরোক্ষভাবে তাঁদের সমর্থন ছিল একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আসলে এঁদের চরিত্রটাই যে এরকম কাঠামোর, নিরাপত্তায় সীমায়িত, মূল্যবোধ সম্পর্কে সজাগ এই শ্রেণীটা পুরনো ধ্যান-ধারণাকে ভাঙতে পারে না। আর এই ভাঙতে না পারার কারণেই শিল্পসত্তাতে এর অতিরঞ্জন কোথাও নেই। কেননা আমরা জানি, যে কোন ধারণার ভিত্তি গড়ে উঠতে হলে সুনির্দিষ্ট বাস্তবতার প্রতিফলন দরকার।
×