ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নৃশংস আইএস

প্রকাশিত: ০৭:১২, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫

নৃশংস আইএস

গাঢ় নীল রঙের প্যান্ট, টকটকে লাল গেঞ্জি পরে সমুদ্র সৈকতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আয়লান কুর্দি। পায়ে ছোট্ট দুজোড়া কালো জুতো। পাঁচ বছরের এই শিশুটির শোওয়ার ভঙ্গি দেখলে যে কেউ ভাববেন, সৈকতে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা-মায়ের সঙ্গে বুঝি বা দুষ্টুমিতে মেতেছে সে। গায়ে মুখে বালি মেখে দুষ্টুমিরত আয়লান নিশ্চয়ই এখনই উঠে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে বাবা-মায়ের কোলে। গণমাধ্যমে আয়লানের উপুড় হয়ে থাকার ছবিটি প্রচারের পর কয়েকদিন অনেকেই এমনটাই ভাবতে চেয়েছিলেন। ভাবতে ভালবাসছিলেন যে, এমনটাই যদি হতো! ছবিটি প্রচারের পর ততক্ষণে সবাই জেনে গেছেন আয়লান বা আয়লানের বাবা-মা এতো সৌভাগ্য নিয়ে জন্মাননি। বিশ্ববাসীর হৃদয় নাড়িয়ে দেয়া আয়লানের ছবিটি যেন নৌকাডুবিতে মৃত কোন শিশুর ক্ষুদ্র দেহ নয়, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধর্মান্ধতা, মানবতার বিরুদ্ধে লড়াই, নির্মমতা, নৃশংসতা, বাঁচার জন্য মানুষের প্রাণান্তকর লড়াইয়ের একখ- চিত্র! বিশ্ব মানবতার মুখে চাবুকের বাড়ি! আয়লান কুর্দির পরিবার সিরিয়ার কোবান শহরে থাকতেন। সেখানে আইএস জঙ্গীদের সঙ্গে সরকারী বাহিনীর লড়াই শুরু হওয়ার পর তারা পালিয়ে তুরস্ক আসে। সেখানে থেকে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে কর্তৃপক্ষ তাদের শরণার্থী আবেদন নাকচ করে দেয়। এরপর তারা সমুদ্রপথে তুরস্ক থেকে গ্রিসে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিল। নৌকাডুবিতে মাসহ পরিবারের ১২ জনের সঙ্গে মৃত্যু ঘটে আয়লানের। যুদ্ধ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে এভাবে আয়লানের পরিবারের মতো ছোট নৌকায় হাজার হাজার ডলারের বিনিময়ে গাদাগাদি করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে মৃত্যু ঘটে হাজারো মানুষের। স্থল সীমান্তেও মৃত্যুর মিছিল কম নয়। ইউরোপের দেশগুলোও লাখ লাখ শরণার্থীর চাপ মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। এরপরও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে যদিও বা তারা নির্দিষ্ট সংখ্যক শরণার্থী ভাগাভাগি করে নিতে চাইছে তখনও মানবতা রক্ষার সুস্পষ্ট চিত্র অর্থাৎ শরণার্থীদের প্রতি তাদের মানবিক আচরণ পুরোপুরি অনুপস্থিত। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, ধনী দেশগুলোর কড়াকড়ি থাকায় তারা প্রাথমিকভাবে প্রবেশ করেন মাল্টা, ইতালি ও গ্রীসের মতো কম ধনী দেশগুলোতে। পরে তারা ইউরোপের অন্যান্য অংশের দিকে পাড়ি জমান। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে নৌকায় করে ইউরোপে প্রবেশ করার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছিলেন সিরিয়ার নাগরিক। ৬৭ হাজার সিরীয় নৌকায় করে ইউরোপে প্রবেশ করেন। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ইরিত্রিয়া ৩৪ হাজার, আফগানিস্তান ১৩ হাজার এবং মালির ১০ হাজার নাগরিক ইউরোপে প্রবেশ করেন। এছাড়া বর্তমানে ৬ লাখ মানুষ লিবিয়া থেকে ইউরোপে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কেন নিজ দেশ ছেড়ে ভিন দেশে অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা এসব মানুষের এর উত্তর এখন কম বেশি প্রায় সকলের জানা। বিশেষ করে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের নাগরিকদের দেশত্যাগের পেছনে কাজ করছে একটি ধর্মান্ধ উগ্রগোষ্ঠীর উন্মুত্ত মাতম এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জোট বাধা কয়েকটি দেশ। যারা নিজেরাই প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই মহাদানব সৃষ্টির জন্য দায়ী। নৃশংস ও বর্বর জঙ্গী সংগঠনের আরেক নাম এখন ইসলামী স্টেট বা আইএস। ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কয়েকটি অঞ্চলজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করছে সুন্নি আরব জঙ্গীদের এই সংগঠন। ধর্মভিত্তিক জঙ্গী সংগঠনগুলো চোরাগোপ্তা হামলা করে এলেও আইএস প্রথমবারের মতো প্রকাশ্য যুদ্ধে জড়াচ্ছে। নিয়মিত সেনাবাহিনীর মতো স্থল অভিযানে অংশ নিয়ে এলাকাও দখল করছে তারা। মূলত আল কায়েদা থেকে বের হয়ে আসা এই কালো দানবের নাম আইএসআইএস বা সংক্ষেপে আইএস। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি। কিছুদিন আগেও সংগঠনটির নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব দি ইরাক এ্যান্ড দ্য লেভান্ট/সিরিয়া বা আইএসআইএল/আইএসআইএস। ইরাকে রাজনৈতিক সংঘাতের সুযোগে প্রকাশ্যে চলে আসা এই জঙ্গীগোষ্ঠী অল্প কয়েক দিনেই আলোচনায় এসেছে তাদের বর্বরতার জন্য। জীবন্ত কবর দেয়া, ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা, লাইনে দাঁড় করে গুলি করে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা। এমনকি শিশুদের হাতেও অস্ত্র তুলে দিয়েছে আইএস। জাতিসংঘ আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে । ইসলামী মতাদর্শে বিশ্বাসী নয়- শুধু তারাই আইএসের নৃশংসতার শিকার হয় এমন নয়, ইসলামের সুন্নিপন্থায় যারা বিশ্বাসী নয় তাদের ওপরই চলে সংগঠনটির ভয়াবহতা। গুলি করে, ত্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করা হয় তাদের। নৃশংসতার দিক দিয়ে আল কায়েদা, বোকো হারাম, লস্কর-ই-তায়েবা, জুমা ইসলামিয়া, ইসলামিক ফ্রন্ট, আল সাবাহ, তালেবানের মতো জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোও হার মানিয়েছে। সাধারণত ইসলামিক জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো আকস্মিক বিমান হামলা বা অতর্কিত হামলা চালিয়ে থাকে। তবে আইএস প্রথমবারের মতো স্থল হামলা শুরু করেছে। জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) একের পর এক হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র-নিরপরাধ মানুষ হত্যা করছে। এসব হামলার পেছনে প্রধান দুটি কারণ কাজ করছেÑ এক. নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য তুলে ধরা এবং দুই. বিরোধীপক্ষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা। সম্প্রতি হামলার মাধ্যমে একটি বার্তা স্পষ্ট যে, বর্বর এ জঙ্গীগোষ্ঠীটি তাদের হামলার পরিধি ক্রমে বাড়াচ্ছে এবং একই সঙ্গে তাদের কৌশল বদলের আভাসও স্পষ্ট। ইরাক ও সিরিয়ার দখলকৃত এলাকায় কঠোর শরিয়া আইন কার্যকর করেছে আইএস। ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে লেবাননেও তৎপর গোষ্ঠীটি। শরিয়া আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে ভিন্ন গোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের ধর্ষণ ও যৌন দাসী হিসেবে ব্যবহারে আইএস যোদ্ধারা তাদের আরেক ভয়াবহ চেহারা তুলে ধরেছে। আইএস যোদ্ধাদের বাড়িতে ও ক্যাম্পে নারীদের নিভৃত কান্না হারিয়ে দিয়েছে সমস্ত মানবতা। এছাড়াও নিজ গোষ্ঠীর কম বয়সী মেধাবী নারীদের সংগঠনের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ দিচ্ছে আইএস। এযাবতকালের জঙ্গী সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে সাংগঠনিক, প্রশাসনিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে আইএসকে বলা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর ও শক্তিশালী। ধর্মের নামে ভিন্ন মতাবলম্বীদের অপহরণ, গণহত্যা, লুটতরাজ ও নারী ধর্ষণের মতো বিষয়গুলো যেখানে ঘটে চলেছে নিত্যদিন। বিশ্বব্যাপী ধর্মের নামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী এই জঙ্গী সংগঠনটির ভয়াবহতা ও নৃশংতার চিত্র তুলে ধরতে হলে এর নেপথ্য দেখাটাও জরুরী। বলা হয়ে থাকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, ইরাকের নেতা নূরী আল-মালিকি, সৌদি আরব, মিসর, লিবিয়াসহ অন্যান্য গালফ দেশ, তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন, ইসরাইলের মতো তাদের মিত্র দেশ, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্সের মতো ন্যাটোভুক্ত দেশ এবং সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন-কেউই বাদ যায় না এই মহাদানব সৃষ্টির নেপথ্য কারিগর হিসেবে। আর এই দানব সৃষ্টির শেকড় সন্ধান করলে অবশ্যই যে নামটি ঘুরে ফিরে আসে তা হচ্ছে- আল কায়েদা। আরেকটু উৎস সন্ধানে পেছনে গেলে আসে আফগানিস্তানের নাম আর দানব সৃষ্টির নেপথ্য দেশগুলোর নাম।
×