ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবেগের তরঙ্গ ডাকবাক্স

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫

আবেগের তরঙ্গ ডাকবাক্স

ড. মধুশ্রী ভদ্র বেশিদিন আগের কথা নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা পরীক্ষণ শেষে নিউমার্কেট পোস্ট অফিসে এসেছি খাতার পার্সেল পোস্ট করতে। পোস্ট অফিসের কক্ষের অভ্যন্তরের দৃশ্য দেখে বিস্মিত হলাম। একই হাল চিরচেনা, কর্মমুখর, প্রাণচঞ্চল, গম্্গমে, কোলাহলপূর্ণ পোস্ট অফিসের! এমন নিরিবিলি, কোলাহলমুক্ত, কোন ভিড়-বাট্টাও নেই! গ্রাহক সেবা দিতে প্রস্তুত দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ। আর গ্রাহক আমি একাই, আর কোন গ্রাহক নেই। অথচ বছর কয়েক আগেও কমপক্ষে তিরিশমিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে খাতা পোস্ট করতে হয়েছে। আজ আমি কাউন্টারে একাই দাঁড়িয়ে। স্বল্প সময়ে আজ আমার গ্রাহকসেবা পেতে অসুবিধা হলো না। কাজটা দ্রুত সম্পন্ন হলেও আজ আমার চিত্ত প্রসন্ন নয়। বিষণ্ণ চিত্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে প্রায় জনমানবশূন্য এই পোস্ট অফিস আমার হৃদয়ে তোলপাড় ঘটায়। যান্ত্রিক সভ্যতা ও ই-মেইলের যুগে আর কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে কি আমার আবেগের তরঙ্গ ডাকঘর? আমার খুব কষ্ট হয়। অনেক শহরে এখনও চোখে পড়ে ল্যাম্পপোস্ট বা দেয়ালে ঝোলানো, রাস্তার পাশে লাল ডাকবাক্স, যা দেখে মনটা আলোড়িত হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন : “প্রত্যহ ঘুম হইতে উঠিবা মাত্র আমার কেমন যেন মনে হইত, যেন দিনটাকে একখানি সোনালী পাড় দেওয়া নতুন চিঠির মত পাইলাম, লেফাফা খুলিয়া যেন কী অপূর্ব খবর পাওয়া যাইবে।” সত্যিই তো, এই ডাকঘরের মাধ্যমে আসে ডাক, আসে আশা-ভালোবাসার, দুঃখ-বেদনায় ভরা কিংবা অনির্বচনীয় আনন্দে পরিপূর্ণ চিঠি! চিঠির মোহ, চিঠির আকর্ষণ, চিঠির রহস্য, চিঠি পাওয়ার সুখ যে খুশি- আনন্দের আকররূপে স্বীকৃত। আজও কি কোন নববধূ বা প্রেমিকা-কিংবা স্ত্রী ছলছল বা জলভরা চোখে জানালার পাশে, দাঁড়িয়ে দু’হাতে শিক ধরে মধুর প্রতীক্ষায় থাকে ডাকপিয়নের? যে ডাকপিয়ন বা ডাক-হরকরার ডানহাতে থাকবে লাঠি বা বর্শা, বাম হাতে লণ্ঠন, কাঁধে চিঠির থলি আর বর্শার ফলকে বাঁধা একটি ছোট ঘণ্টা! কতদিন, কত রাত পার করে ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা, জোর কদমে এগিয়ে চলে আর ঝুমঝুম করে বাজে ছোট ঘণ্টাটি এমন ডাক হরকরাকে বলে রানার। রানার দায়িত্ব ও কর্তব্য নিজের কাঁধে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে যায় স্বামী বা প্রেমিকের প্রেমময় পত্র বা কারও জরুরী বার্তা। কি এক রোমাঞ্চ আর আশা-আনন্দে চিঠিখানি খাম থেকে বের করে, তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ভাঁজ খুলে পড়ে আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করে ভালবাসার পরশ! এমন রোমাঞ্চ, আবেগ অনুভূতির ছোঁয়া, হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো পাওয়া যাবে কাঠ-খোট্টা ই-মেইলের টাইপ করা অক্ষরের মাঝে? এমন সূক্ষ্ম অনুভূতি, অনুভবের ব্যাপারগুলো আর ভাললাগা ও ভালোবাসার আবেগ বুঝি চিঠি আদান-প্রদানেই সম্ভব! প্রকৃত অর্থেই চিঠির ব্যবহারিক তাৎপর্য যে অতি মূল্যবান ব্যবহার সামগ্রীর মতোই! আর তাই কাব্যে ও সাহিত্যে কবি-সাহিত্যিকরা তাদের ব্যক্তিগত বা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাই ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিগুরু ‘পোস্টমাস্টার’ ছোটগল্পটি লিখেন শাহজাদপুরের কুঠিবাড়িতে গ্রামের এক পোস্টমাস্টারের আগমন উপলক্ষে ১৮৯১ সালে। “... তখন আমাদের কুঠিবাড়ির এক তলাতেই পোস্ট অফিস ছিল, তখন আমি একে প্রতিদিন দেখতে পেতুম, ...তখনি আমি একদিন দুপুর বেলায় এই দুতলায় বসে সেই পোস্টমাস্টারের গল্পটি লিখেছিলুম । ... এই লোকটিকে আমার বেশ লাগে।” ...এটি কবির কথা আর এই ‘বেশ লাগা’ থেকেই পোস্টমাস্টার গল্পের সৃষ্টি। বিদায় বেলা বালিকা রতনের জন্যে পোস্টমাস্টারের মনের ব্যথা ও কষ্ট পাঠককেও ব্যথিত করে। রবিঠাকুরের প্রতীকী নাটক ‘ডাকঘর’-এও ফুটে উঠেছে তাঁর মিশ্র উপলদ্ধি; যেমন বাইরে যাবার ডাক, ছেলে বেলা, ঘরের মাঝে বন্দীজীবন, ডাকঘরে চিঠি বিলি করা- এসব মিলিয়ে অপূর্ব শিল্পরসে রূপায়িত করেছেন। ডাক ঘরের স্বাধীনচেতা বালক ‘অমল’ রাজার ‘ডাকহরকরা’ হতে পারাকেই জীবনে কাম্য বলে জেনেছে। আমার শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় ময়মনসিংহের সরকারী আনন্দমোহন কলেজে। নতুন নিয়োগ, নতুন চাকরি, নতুন পেশা- তাই আনন্দ মোহন কলেজে কর্মরত থাকাকালে ঢাকায় মা-বাবার সঙ্গে আমার সর্বদাই চিঠি পত্রের আদান-প্রদান ছিল। আমার শিক্ষাবিদ মা আমার শিক্ষকতা পেশাকে মহিমান্বিত করার লক্ষ্যে পাঠদানের কৌশল বাকশৈলী ও পাঠদান সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে সপ্তাহে দুটি করে চিঠি লিখতেন। আমিও কোন সমস্যা হলে চিঠি লিখতাম, কারণ শিক্ষকতাকে ‘মহান পেশা’ হিসেবেই গণ্য করেছিলাম। জানি, এই আধুনিক ও অন্তর্জালে যুগে পোস্ট অফিস বা ডাকঘরের যুগোপযোগিতা হয়ত বা নেই! যন্ত্রসভ্যতা ও ই-মেইল দিয়েছে বেগ; কেড়ে নিয়েছে আবেগ, আবেগের তরঙ্গ। কিন্তু আমার কানে যেন এখনও বেজে চলেছে কবি সুকান্তের লেখা ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই কালজয়ী গানখানি- দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার রানার রানার! রানার। মিরপুর, ঢাকা থেকে
×