ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

১৯৫ যুদ্ধাপরাধী বনাম আটকে পড়া বাঙালী

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫

১৯৫ যুদ্ধাপরাধী বনাম  আটকে পড়া বাঙালী

(২২ ডিসেম্বর চতুরঙ্গ পাতার পর) ভুট্টোর এসব বাগাড়ম্বরের প্রতিবাদ করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৩ সালের ৭ জুন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ভোলা সম্ভব নয়। এই হত্যা, ধর্ষণ, লুটের কথা জানতে হবে। যুদ্ধ শেষের মাত্র তিন দিন আগে তারা আমার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। তারা প্রায় ২ লাখ নারীকে নির্যাতন করেছে, এমনকি ১৩ বছরের মেয়েকেও। আমি এই বিচার প্রতিশোধের জন্য করছি না। আমি এটা করছি মানবতার জন্য। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে বাঙালীদের বিচারের হুমকির প্রতিবাদ করে বলেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য। এই মানুষগুলো চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, সরকারী ও সামরিক কর্মকর্তা; যারা বাংলাদেশে ফেরত আসতে চায়, ওরা কী অপরাধ করেছে? এটা ভুট্টোর কী ধরনের প্রতিহিংসাপরায়ণতা।’ কিন্তু ভুট্টোর কুমন্ত্রণা তার আদ্যোপান্ত জীবনজুড়ে। তিনি ষড়যন্ত্রের জাল ছড়াতে থাকেন। পাকিস্তান সে দেশে আটক ১৯৫ শীর্ষ বাঙালী কর্মকর্তাকে বিচারের জন্য গ্রেফতার করে বলে ১৯৭৩ সালের ২৬ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে রাষ্ট্রীয় সফরে যান যুগোশ্লাভাকিয়ায়। এ সময় পাকিস্তানী নোবেল জয়ী পরমাণু বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম এক পত্রে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. এম ওয়াজেদ মিয়াকে জানান, তিনি বেলগ্রেডে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভুট্টোর একটা বৈঠকের আয়োজন করতে চান। পাকিস্তান তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ায় বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব নাকচ করে দেন। প্রফেসর সালাম বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে পত্রে অনুরোধ জানান, ‘শেখ সাহেবের কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ যে, তিনি যেন ৯৩ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীর মধ্যে শুধুমাত্র ১৯৫ কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে বাকিদের বিনা শর্তে মুক্তি দেন। পরবর্তীতে ১৯৫ জনের বিচার করে ওদের থেকে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ফাঁসি দেয়া যেতে পারে।’ বাংলাদেশ ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দেশীয় সহযোগীদের বিচারের জন্য আইন প্রণয়ন করে। রাজাকার, আলবদর, আলশামস, দালালদের বিচারের জন্য ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’ জারি করে। ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশের নয়া সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আনা হয়। এতে ৪৭(৩) ধারা সংযুক্ত করা হয়। যাতে ‘গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্রবাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারিত্বে সোপর্দ কিংবা দ-দান করার বিধান’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০ জুলাই জারি করা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩। এর ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাদের জন্য পাকিস্তানী সেনা এবং দেশীয় যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদরদের বিচারের ব্যবস্থা নেয়ার পথ সহজ হয়। বাংলাদেশও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে অনড় অবস্থানে থাকে। তবে ভারতের শিবিরে থাকা অন্য যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে অনাগ্রহী ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। পাশাপাশি পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের বিপরীতে চীনের অবস্থান ভারতকে বিপাকে ফেলে। চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে ভারত তখন আগ্রহী নয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণেই। আন্তর্জাতিকভাবে যেমন, তেমনি অভ্যন্তরীণভাবেও ইন্দিরা সরকারের ওপর চাপ তৈরি হতে থাকে। যাতে ভারত দ্রুত সব যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সিমলা চুক্তির সূত্র ধরে ভারত-পাকিস্তান দু’দফা বৈঠকে বসে। ১৯৭৩-এর জুলাইয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে এবং আগস্টে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইন্দিরার বিশেষ উপদেষ্টা পিএন হাকসার এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনার পর একটি চুক্তি সই হয়। ভারতে আটক থাকা পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী, পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালী এবং বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানী নাগরিকদের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এই লোক বিনিময় শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বাকি ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিষয় চূড়ান্ত করবে। কিন্তু বাংলাদেশকে আলোচনায় না রাখায় দুটি বৈঠকে চুক্তি জোরালো হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, একমাত্র সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ এ ধরনের কোন আলোচনায় বসতে পারে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এই চুক্তি সই হওয়ায় স্বভাবতই আশা করা হয়েছিল যে, অতঃপর পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু বাস্তবে স্বীকৃতিদান দূরের কথা, জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ঠেকিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তান ধর্ণা দেয় গণচীনের দরবারে। পাকিস্তানের প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহম্মদ পিকিং (বেজিং) ছুটে যান এবং বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে চীনা নেতাদের সঙ্গে দেনদরবার করেন। অতঃপর আজিজ আহমদ এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন, ‘পাকিস্তানী ১৯৫ যুদ্ধবন্দীর বিচারের সিদ্ধান্ত বাতিল না করা পর্যন্ত পাকিস্তান ও চীন বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্য প্রাপ্তির বিরোধিতা করে যাবে।’ ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট যে দিল্লী চুক্তি সই হয়, তাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বাংলাদেশকে ছাড় দিতে হয়। চুক্তিতে বলা হয়, পাকিস্তান বাঙালী ‘গুপ্তচরদের’ বিচার করবে না। আর যে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ চিহ্নিত করেছে তাদের বিচার হবে এবং বাংলাদেশেই হবে। তবে এ ব্যাপারে যদি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে, তবেই তা হবে। বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে তাদের দৃঢ় অবস্থানের কথা এরপরও উল্লেখ করতে থাকে। কিন্তু, এই চুক্তির ফলে একতরফাভাবে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ আর থাকেনি। দিল্লী চুক্তি স্পষ্ট করেছিল, যুদ্ধাপরাধীদের আর বিচার হচ্ছে না। কারণ, পাকিস্তান এ প্রশ্নে কখনই বাংলাদেশের সঙ্গে সহমত ঘোষণা করতে চায় না। দিল্লী চুক্তিকে পাকিস্তানী সংবাদপত্রে উপমহাদেশে নতুন সম্পর্কের সূচনা করবে বলে অভিমত জানায়। নিউইয়র্ক টাইমসের ২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় বলা হয়, নতুন সম্পর্ক হয়ত এখনই শুরু হচ্ছে না। কিন্তু এ কথায় কোন ভুল নেই যে, এই তিন দেশের মধ্যে সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে। ১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আলজিরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনকালে সৌদি বাদশাহর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বৈঠক করেন। বাদশাহ ফয়সল দাম্ভিকতার সঙ্গে শর্তারোপ করেন যে, বাংলাদেশকে সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে দেশটির নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ রাখতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত হলো, অবিলম্বে সমস্ত পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু বাদশাহকে কড়া জবাব দিয়ে যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে বলেন, ‘এটা তো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিষয়। এই দু’টো দেশের মধ্যে এ ধরনের অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। যেমন ধরুন, বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ পাকিস্তানী নাগরিককে সে দেশে ফেরত নেয়া এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া ৫ লক্ষাধিক বাঙালীকে বাংলাদেশে পাঠানো এবং বাংলাদেশের প্রাপ্য অর্থ সম্পদ পরিশোধ করা। এমন বেশকিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। আর এ সবের মীমাংসা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শুধু বিনা শর্তে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে না। আর সৌদি আরবই বা এত উদগ্রীব কেন?’ বঙ্গবন্ধুর কড়া ভাষ্য শুনে সৌদি বাদশা একটু রূঢ়স্বরে বলেন, ‘শুধু এটুকু জেনে রাখুন, সৌদি আরব আর পাকিস্তান একই কথা। পাকিস্তান আমাদের সবচেয়ে অকৃত্রিম বন্ধু। যা হোক, আমার শর্ত দুটি বিবেচনা করে দেখবেন। একটা হচ্ছে, বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা ও অপরটি বিনা শর্তে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি। আশা করি, এরপর বাংলাদেশের জন্য সাহায্যের কোন কমতি হবে না।’ সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং পশ্চিমা অনেক দেশই যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিপরীতে অবস্থান নেয়। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের বিচারের বিষয়ে তখনও অনড় অবস্থানে। বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধী ছাড়া বাকি যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যাবাসনে আপত্তি তোলেনি। কিন্তু পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধীদের ছাড়া যুদ্ধবন্দীদের ফেরত নিতে আপত্তি বজায় রাখে। ভুট্টো জানতেন, যুদ্ধবন্দীদের ভারত এমনিতে ফেরত দিতে বাধ্য হবে। কারণ বেশিদিন ভরণ-পোষণ দিতে পারবে না। আর পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালীদের নিরাপত্তা বা সুরক্ষার দায়িত্ব তার নেই। যদিও বেশিরভাগ বাঙালীই যুদ্ধের সময় থেকেই চাকরি হারাতে থাকেন। বেকারত্বের কারণে তারা সহায়-সম্পদ সবই বিক্রি করতে বাধ্য হন। এসব তথ্য জেনে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৮ মার্চ জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে এই করুণ অবস্থার অবসানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ১৯৭৩-এর ২৮ আগস্ট দিল্লীতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈঠকটি হয় বাংলাদেশের সম্মতিতেই। বৈঠকে উভয় দেশ, ‘দিল্লী চুক্তি’ সই করে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে যুগপৎ প্রত্যাবাসন নিয়ে উভয়পক্ষ সম্মত হয়। অপরদিকে শর্তারোপ করা হয়, পাকিস্তান গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে আটক বাঙালীদের বিচার করবে না। তবে বাংলাদেশ সেদেশে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর যে বিচার করতে চায় সে বিষয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ঐকমত্য হলেই তবে বিচার হবে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তার সরকারের দৃঢ়তার কথা বিভিন্ন পর্যায়ে তখনও বিবৃত করেছেন। কিন্তু এই চুক্তির ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। ১৯৭৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার নামে প্রথম সপ্তাহেই ১৪৬৮ বাঙালী এবং ১ হাজার ৩শ’ ৮ পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীর প্রত্যাবাসন ঘটে। বাংলাদেশ ১৯৫ যুদ্ধাপরাধী ফেরত না দেয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় পাকিস্তান দুই শতাধিক বাঙালীকে পণবন্দী হিসেবে জিম্মি করে রাখে। এসব সিদ্ধান্তের আগে ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে ভুট্টো একটি নতুন প্রস্তাবও রেখেছিল। এতে বলা হয়েছিল, ‘পাকিস্তান তার যে কোন যুদ্ধবন্দীর বিচার ঢাকায় অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে, কারণ অভিযুক্ত অপরাধ পাকিস্তানের একটি অংশেই ঘটেছে। সুতরাং পাকিস্তান নিজে বিচার বিভাগীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এদের বিচারে আগ্রহী। যা আন্তর্জাতিক আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে।’ (পাকিস্তান এ্যাফেয়ার্স, ১ মে ১৯৭৩)। কিন্তু টিক্কা খান পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রধান থাকাবস্থায় এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচারে পাকিস্তানী প্রস্তাবে সন্দেহ পোষণ করে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশে যে বিচার করা সম্ভব হবে না তা বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ তখন আটকেপড়া নির্যাতিতসহ সাধারণ বাঙালীদের দেশে ফেরত আনা জরুরী হয়ে পড়েছে অথচ এই বাঙালীদের ভাগ্য জড়িয়ে গেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে। এক দোটানায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। তথাপি যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার আগে পাকিস্তানের কাছে চারটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায়। প্রথমত, যুদ্ধাপরাধের জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে পাকিস্তানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ খোলা রাখা এবং তৃতীয়ত, সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য, চীনসহ অন্যান্য দেশে পাকিস্তানের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা বন্ধ করা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রশ্নে শর্তসাপেক্ষে ভুট্টোকে একক ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়। ভুট্টো সংসদে বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের দাবি পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত কোন স্বীকৃতি নয়।’ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ভাষণে বলেন, ‘১৯৫ যুদ্ধবন্দীর মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানে ফেরত না পাঠানো পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের শর্ত অপূর্ণই থেকে যাবে। আর জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের প্রশ্নই ওঠে না।’ এর ১২ দিন পর ৩ অক্টোবর চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী চিয়ান জিয়ান হুয়া অধিবেশনে বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রস্তাব কার্যকরী করার পরেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে পারে। তার আগে কোনক্রমেই নয়।’ দিল্লীতে ১৯৭৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক বসে। বৈঠক শেষে তিন দেশীয় প্রতিনিধিরা এক যুক্ত ঘোষণায় বলেন, উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তোলার স্বার্থে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাতিল করে দেয়া হবে। অবশ্য এই যুক্ত ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক রেডক্রসের তত্ত্বাবধানে পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের প্রথম দলটি ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা পৌঁছে। কিন্তু এরপর প্রত্যাবাসন থেমে যায়। পাকিস্তান এ ব্যাপারে টালবাহানা শুরু করে অথচ যুক্ত ঘোষণায় ত্রিমুখী লোক বিনিময় যুগপৎ পরিচালিত হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ২২ অক্টোবর টোকিওতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে প্রতিটি বাঙালী ফেরত নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী নাগরিকদের বিপুলসংখ্যককেই পাকিস্তান নিচ্ছে না।’ এর ক’দিন পরই ভুট্টো ঘোষণা করেন যে, ‘পাকিস্তান বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিক বিহারিদের ফেরত নেবে না।’ অথচ প্রায় পাঁচ লাখ বিহারির মধ্যে অধিকাংশই পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সে দেশে ফেরত যেতে আগ্রহী। বাংলাদেশের পক্ষে এদের ভরণ-পোষণ ভারবাহী হয়ে দাঁড়ায় গোড়াতেই। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনকালে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী ও আটকেপড়া বাঙালীদের সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টোর মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধু বৈঠক চলাকালে সাংবাদিকদের জানান, ‘পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বাঙালীদের দেশে ফেরাসহ অনেক বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন হবে। এই সম্মেলন শুরুর আগে অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছি। আল্লাহর নামে এবং দেশের জনগণের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা করছি।... আমি বলছি না যে, এটি আমি পছন্দ করছি। আমি বলছি না আমার হৃদয় আনন্দিত। এটি আমার জন্য একটি আনন্দের দিন নয়, কিন্তু বাস্তবতাকে আমরা বদলাতে পারব না।’ ভুট্টোর ঘোষণার আগের রাত অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সৌদি আরব, মিসর, ইন্দোনেশিয়াসহ ৩৭টি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে উভয় দেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোন প্রতিশ্রুতি ছাড়াই পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়ে সমর্থন হয়। তবে বাংলাদেশ তখনও ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচার থেকে সরে আসার কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। লাহোর সম্মেলন থেকে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু জানালেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি আপাতঃ স্থগিত রেখেছেন। তবে বিষয়টি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান শীঘ্রই আলোচনায় বসবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। চলবে...
×