ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কুড়িগ্রামের গোলাপ খাঁ শিশু সদন

অনাথ ও অসহায় শিশুরা পাচ্ছে মায়ের মমতা শিক্ষার আলো

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫

অনাথ ও অসহায় শিশুরা পাচ্ছে  মায়ের মমতা শিক্ষার আলো

রাজু মোস্তাফিজ অনাথ ও অসহায় শিশুদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন এতিম-অসহায় শিশুদের মধ্যে। অনাহারি শিশুর মুখে নিশ্চিত দুই মুঠো অন্ন তুলে দেয়া, তাদের সামাজিকভাবে পরিচয় প্রদান, এমনকি একাকিত্বের মর্মবেদনা ভুলিয়ে দিয়ে মায়ের মমতা বন্ধনে বেঁধেছেন শিশুদের। পাশাপাশি এসব শিশুদের আধুনিক শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ইতোমধ্যে এসব শিশুদের কল্যাণে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী শহরের বাসিন্দা, বাবা-মা হারা ৫১ জন এতিম শিশুর মা বিলকিস বানু। বিলকিসের প্রতিষ্ঠিত শিশু সদনটির নাম ‘গোলাপ খাঁ শিশু সদন’। গত সাত বছর ধরে এই শিশুদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে আসছেন তিনি। জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে নাগেশ্বরী উপজেলা শহরের নাগেশ্বরী ডিগ্রী মহাবিদ্যালয়ের সীমানা ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে বিলকিছ বানুর আবাসিক ‘গোলাপ খাঁ শিশু সদন।’ ২০০৯ সালে ১৩ জন অনাথ শিশুকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। মোট ১ একর জমির ওপর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৫১ জন বাবা-মা হারা অনাথ শিশু রয়েছে। এর মধ্যে মেয়েশিশু ১৬ ও ছেলেশিশু রয়েছে ৩৫ জন। দুইটি বড় হলরুমে শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা থাকার ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠানের নিজ খরচে ও ব্যবস্থাপনায় শিশুদের ক্যাডেট পদ্ধতিতে লেখাপড়ার পাশাপাশি শরীরচর্চা শিক্ষাও দেয়া হয়। বিলকিছ বানু জানান, নাগেশ্বরী বাজারের রাস্তার পাশে ১৯৯৭ সালে জন্ম নেয় এক নাম পরিচয়হীন শিশু। ওর মাকে সবাই ঝর্না পাগলী নামে জানত। সারাদিন বাজারেই থাকতো সে। কেউ দিলে খেত, না পেলে অনাহারে থাকত। মানসিক ভারসাম্যহীন ওই নারী এক সময় বিকৃত লালসার শিকার হলে ওই শিশুর জন্ম হয়। এই বাজারেই ছিল বিলকিছ বানুর মার্কেট ও বাসা। প্রতিদিন বাইরে যেতে আসতে শিশুটিকে দেখে তার মায়া জন্মে। ঝড়-বৃষ্টি, কনকনে শীতে কষ্টের মধ্যে বেড়ে উঠছিল শিশুটি। না খেতে পেরে হাড্ডিসার হয়ে যায়। মানসিক ভারসাম্যহীন ঝর্না পাগলী শিশুটির যতœ নিতে পারছিল না। নবেম্বরের এক কনকনে ঠা-ায় শিশুটিকে মনে হচ্ছিল মারাই যাবে। বিলকিছ বানু ঘটনাটি দেখে আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলেন। জন্ম পরিচয়হীন শিশুটির বয়স তখন ২ বছর। এ কাজে তার স্বামীরও সমর্থন ছিল। বাড়িতে এনে শিশুটির নাম দেয়া হলো ‘প্রীতিলতা’। এই পরিচয়ে এ বাড়িতেই বেড়ে উঠছিল প্রীতিলতা। এভাবে অনাথ শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে বিলকিছ বানু নিরাপত্তা আর সামাজিক পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করলেন। এ ধরনের কাজে যুক্ত হয়ে তিনি মন থেকে এক ধরনের ভাল লাগা অনুভব করলেন। মনে হল এ অনাথ শিশুর সত্যিকারের মা তিনি। প্রীতিলতার পরিচয় সামাজিকভাবে দেয়ার জন্য তাদের নিজ মার্কেটের নাম বদল করে রাখালেন ‘প্রীতিলতা মার্কেট’। এভাবেই প্রীতিলতার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আর এতে আগ্রহী হয়ে অনেকেই এরকম শিশুর সন্ধান দিতে লাগল। যাতে প্রীতিলতার মতো তারাও এ পরিবারে আশ্রয় পায়। এভাবে ৯টি শিশু এ বাড়িতে আশ্রয় পেল। শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় থাকা ও খাওয়ার সমস্য হচ্ছিল। তখন বিলকিছ বানু প্রীতিলতা মার্কেটের ৪০টি দোকানঘর থেকে যে ভাড়া আদায় হতো তা এতিম শিশুদের পিছনে খরচ করতে লাগলেন। এ শিশুদের নিশ্চিন্তে বেড়ে ওঠার জন্য শ্বশুরের ১ একর জমিতে গড়ে তুললেন নতুন ভবন। এভাবে প্রীতিলতা থেকে যাত্রা শুরু হলো ‘গোলাপ খাঁ শিশু সদন’ এর। জানা যায়, গোলাপ খাঁ শিশু সদনে শিশু শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা দেয়া হয়। এখানে ৮ শিক্ষক ও ৫ জন সাপোর্ট কর্মী রয়েছে।
×