ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের এক শ’ বছর

প্রকাশিত: ১৬:৫৩, ২২ ডিসেম্বর ২০১৫

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের এক শ’ বছর

স্বনামধন্য বিজ্ঞানী এলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কারের এক শ’ বছর পূর্ণ হলো। ১৯১৫ সালের নবেম্বর তিনি প্রুশিয়ান বিজ্ঞান একাডেমিতে চারটি লেকচারের আকারে এই তত্ত্ব তুলে ধরেন এবং সে বছরের ২ ডিসেম্বর তা প্রকাশিত হয়। এই আপেক্ষিক তত্ত্ব আমাদের বিশ্বজগতকে দেখার পদ্ধতি পাল্টে দিয়েছে এবং এখনও তা নতুন নতুন অন্তর্দৃষ্টি যুগিয়ে চলছে। আপেক্ষিক তত্ত্বকে বলা যেতে পারে বিজ্ঞানের সবচেয়ে সৌন্দর্যময় তত্ত্ব। তত্ত্বটি উপস্থাপিত হওয়ার পর অতি দ্রুত ও ব্যাপক পরিসরে তা গৃহীত হওয়ার একটা কারণ এর গাণিতিক প্রকাশের সৌন্দর্য। আজ এক শ’ বছর পরও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে নান্দনিক সৌন্দর্যের ভূমিকা নিয়ে কোন আলোচনা আপেক্ষিক তত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত না করে সম্পূর্ণ হতে পারে না। আপেক্ষিক তত্ত্বকে বলা হয় মানুষের সর্বোচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জনগুলোর একটি। এই তত্ত্ব আমাদের বাস্তব জগতের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর যুগিয়েছে এবং এখনও যুগিয়ে চলেছে। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ থেকে শুরু করে ব্ল্যাকহোলের মতো ভুতুড়ে বিষয় পর্যন্ত সৃষ্টিতত্ত্বের অনেক রহস্যের সমাধানের তাত্ত্বিক ভিত্তি যুগিয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বজগতকে পরম স্থান-কালের হিসাবে বর্ণনা করে আসা হচ্ছিল। আইনস্টাইনের তত্ত্ব তা নাটকীয়ভাবে বর্জন করে চতুর্মাত্রিক স্থান-কালের হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এই নতুন স্থান-কালে ভিন্ন ভিন্ন গতিতে চলমান পর্যবেক্ষকরা দৈর্ঘ্য ও স্থিতিকাল পরিমাপ করতে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পেয়েছেন। যেমন স্থির অবস্থায় থাকা একজন পর্যবেক্ষকের বেলায় দ্রুত স্থানান্তরিত একটি ঘড়ি নিশ্চল থাকা একটি ঘড়ির তুলনায় অধিকতর মন্থরভাবে সময় দেবে। একমাত্র যে জিনিসটা স্থির অবস্থায় থাকে তাহলো আলোর গতি। এটি হলো ধ্রুব। নিউটনের সঙ্গে আইনস্টাইনের পার্থক্য হলো নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব পরম স্থানের (ধনংড়ষঁঃব ংঃধঃব) উপর নির্ভরশীল। সেখানে সময়ের সুস্পষ্ট কোন উল্লেখই নেই। আলোর গতির কথা বলা নেই। আইনস্টাইনের তত্ত্ব বলে কেউ ছাদ থেকে পড়লে তাঁর নিজস্ব ওজন অনুভব করবে না। পড়ন্ত বস্তু মাধ্যাকর্ষণ টের পায় না। তবে গলফ বলের হোক আর এই উপগ্রহের হোক, সেগুলোর যাত্রাপথ বক্র হয় এবং হওয়ার কারণ এর পেছনে কোন ধরনের টানাটানি বা ঠেলাঠেলি কাজ করে। ছাদ থেকে লোকের পড়ে যাওয়ার মতো গলফ বল এবং গ্রহ-উপগগ্রহ যদি কোন টান বা ধাক্কা অনুভব না করে তাহলে সেগুলো সরল রেখায় বা সোজাসুজি পড়ে না কেন? আইনস্টাইনের পরবর্তী উক্তি সেগুলো সোজাসুজিই পড়ে এবং এখানেই রয়েছে তার আপেক্ষিক তত্ত্বের চমৎকারিত্ব। তিনি বলেন যে, বাধাগ্রস্ত না হয়ে পড়ে যাওয়া বস্তু আলোর রশ্মির মতো সরল রেখা অনুসরণ করে। কিন্তু সেই স্থান-কালটাই তো বক্র। আর যে জিনিসটা স্থান-কালকে বক্রতা দিয়েছে তা হলো ভর। মাধ্যাকর্ষণ কোন শক্তি নয় এটা হলো স্থান-কালের বিকৃতি। স্থান-কাল পদার্থকে বলে কিভাবে স্থানান্তরিত হতে হবে। আর পদার্থ স্থান-কালকে বলে কিভাবে বক্র হতে হবে। চতুর্মাত্রিক স্থান-কালের মোড়ায় জড়ানো এই বিষয়গুলো ব্যাখ্যার জন্য আইনস্টাইনের উচ্চতর গাণিতিক সূত্রের প্রয়োজন হয়েছিল। নিউটন ব্যবহার করেছিলেন ইউক্লিডের জ্যামিতি। কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্বের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অনেক বেশি চ্যালেঞ্জময় গণিত। কোয়ান্টাম বিপ্লবের জনক মার্ক্স প্ল্যাঙ্ক তাই ১৯১৩ সালে আইনস্টাইনকে লিখেছিলেন : ‘প্রথমত আপনি সফল হবেন না। এবং যদি সফল হনও বা কেউ আপনার কথা বিশ্বাস করবে না।’ সৌভাগ্যবশত আইনস্টাইন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ মার্সেল গ্রসম্যান কর্তৃক বিকশিত রাইম্যানিয়ান জ্যামিতি দ্বারা তাঁর চতুর্মাত্রিক বক্র পৃষ্ঠতন ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হন। এই ব্যাখ্যা অনেক রহস্যের সমাধান এনে দেয়। যেমন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অনেক আগে থেকেই জানা ছিল যে বুধগ্রহের কক্ষপথের যে বিন্দুটা সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি সেটি কালক্রমে এমনভাবে বদলে যায় যে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব দিয়েও তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ১৮৪০ এর দশকে ইউরেনাসের কক্ষপথে অস্বাভাবিকতা বা অসঙ্গতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল এইভাবে যে এটা আরও দূরের কোন গ্রহের মাধ্যাকর্ষণের ফল। পরবর্তীকালে ইউরেনাস গ্রহটি আবিষ্কৃত হওয়ায় নিউটনের সূত্রের নির্ভুলতা দারুণভাবে প্রমাণিত হয়। কিন্তু বুধের ঐ ত্রুটিপূর্ণ আচরণের পেছনে অনাবিষ্কৃত কোন গ্রহের প্রভাব প্রমাণিত হয়নি। সেই ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছিল আইনস্টাইনের তত্ত্বে। তিনি দেখিয়েছিলেন যে সূর্যের কাছে স্থান-কালের বক্রতার জন্য বুধের কক্ষপথে এই আচরণ ঘটছে। আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার পর আইনস্টাইন পর্যবেক্ষণের দ্বারা সেটির যথার্থতা পরীক্ষা করার উপায় সন্ধান করতে শুরু করেন। একটি উপায় ছিল সূর্য আকাশের যে জায়গায় আছে সেই একই জায়গায় থাকা নক্ষত্রগুলোর বাহ্যত অবস্থান সূর্যগ্রহণের সময় কি থাকে এবং অন্য সময় কি থাকে তা দেখা। আলোর রশ্মি স্থান-কালে সরল রেখায় গমন করে। সূর্যের ভর যেহেতু সেই স্থান-কালকে মোচরে বা বাঁকিয়ে দেয় তাই আলোকরশ্মি সূর্যের পাস দিয়ে গেলে নক্ষত্রগুলোর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে বলে দৃশ্যত মনে হয়। ১৯১৯ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন আটলান্টিক থেকে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণকালে আইনস্টাইনের ব্যাখ্যার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। অবশ্য আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা যে ছিল না তা নয়। যেমন তিনি মহাবিশ্বকে প্রথমে সুস্থির বলে মনে করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন স্থান-কালের মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত প্রসারণ প্রবণতা আছে এবং এই প্রবণতাকে মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থের মহাকর্ষীয় শক্তি মিলে নাকচ করে নির্ভুল ভারসাম্য রচনা করে। এজন্য তিনি তার সমীকরণে মহাবিশ্বের সৃষ্টিতাত্ত্বিক ধ্রুবক (ঈড়ংসড়ষড়মরপধষ ঈড়হংঃধহঃ) ব্যবহার করেছিলেন যাতে মহাবিশ্বকে একটা স্থির অবস্থায়, একটা নির্দিষ্ট আকারে ধরে রাখা যায়। কিন্তু ১৯২৯ সালে মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল দূরের নীহারিকাগুলোর আলোর রং বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা করে নির্ভুলভাবে প্রমাণ করেন যে, নীহারিকাগুলো পরস্পর থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়ে চলেছে। এই আবিষ্কারের পর আইনস্টাইন তার ঈড়ংসড়ষড়মরপধষ ঈড়হংঃধহঃ বা মহাজাগতিক সৃষ্টি তত্ত্বীয় ধ্রুবক পরিত্যাগ করেন এবং এটাকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি বলে উল্লেখ করেন। আইনস্টাইনের তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৩০-এর দশকে পরমাণু পদার্থবিজ্ঞানীরা উপসংহারে পৌঁছান যে, পারমাণবিক বিক্রিয়াই নক্ষত্রগুলোকে শক্তি যোগায় এবং এই বিক্রিয়ার জ্বালানি যখন ফুরিয়ে যাবে নক্ষত্রগুলোও তখন চুপসে আসবে। এমনিভাবে সূর্যও এক সময়ে চুপসে গিয়ে পৃথিবীর সাইজের শ্বেত বামন তারায় পরিণত হবে। এর চেয়ে বড় নক্ষত্রগুলো চুপসে আরও বেশি ঘনত্বসম্পন্ন তারায় পরিবণত হবে যা ২০ কিলোমিটারের মতো চওড়া হবে। আর সবচেয়ে বড় তারাগুলো এমনভাবে চুপসে যাবে যে সেগুলোর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতা কিছুই থাকবে না। সেগুলো হবে অসীম ঘনত্বসম্পন্ন। অর্থাৎ তা অনন্যতায় (ঝরহমঁষধৎরঃু) পরিণত হবে। তবে কোন তত্ত্বে অনন্যতার সন্ধান পাওয়া গণিতমনস্ক ব্যক্তিদের কাছে অতিমাত্রায় অপছন্দের। সাধারণত তারা এগুলোকে ভ্রান্তির লক্ষণ হিসেবে দেখেন। আইনস্টাইনও তার মহাবিশ্বে কোন অনন্যতা চাননি। তাই ১৯৩৯ সালে এক গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে বৃহৎ নক্ষত্রগুলো চুপসে এসে অনন্যতায় পরিণত হওয়ার আগেই সেই চুপসানো থেমে যাবে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ভিত্তিতে মহাজাগতিক অনেক নাটকের যবনিকা উন্মোচিত হয়েছে। তার একটি হলো ব্ল্যাকহোল। এর ভর, ঘনত্ব ও পাক খাওয়ার গতি এত প্রচ- যে, কোন কিছু এমনকি আলো পর্যন্ত সেখানে গেলে আর ফিরে আসতে পারে না। আপেক্ষিক তত্ত্ব দিয়ে বিশ্বজগতের নতুন ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কিছু কিছু তরুণ বিজ্ঞানী নতুন নতুন সূত্রও নিয়ে এসেছেন। যেমন তারা স্থান-কালে ‘ওয়ার্মহোল’ বা পোকায় কাটা গর্তের কথাও বলছেন যেগুলোর মাধ্যমে মহাবিশ্বের অনেক দূরের অংশগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যাবে। তাছাড়া রুদ্ধ সময় অনুরূপ বক্ররেখার কথাও শোনা গেছে যেগুলোর মধ্য দিয়ে অতীতে চলে যাওয়াও সম্ভব হতে পারে। এইভাবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব বিজ্ঞানের ধারণার পরিধিকে ক্রমাগত বিস্তৃত করে চলেছে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছেন, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণগুলো তার শ্রেষ্ঠ এপিটাফ ও স্মারক। যতদিন বিশ্বজগতের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন এগুলোরও অস্তিত্ব থাকা উচিত। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×