ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২২ ডিসেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ছাত্রজীবনের অবসান (২১ ডিসেম্বরের পর) আমি আগেই বলেছি যে, ১৯৫৫ সালই ছিল আমার ছাত্রজীবনের শেষ বর্ষ। তবে নতুন জীবন শুরু করতে আরও বেশ কিছুদিন লেগে গেল। সেই সময়টাকেই আমি আমার স্মৃতিকথার বর্তমান খণ্ডে উপস্থাপন করছি। ১৯৫৫ সালেই হল ইউনিয়নের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মোটামুটি শেষ হয়ে গেল। ডিসেম্বর মাসেই আমার অবস্থান হলো নির্বাহী পরিষদে পদাধিকারবলে সদস্য। হল ইউনিয়নের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সহ-সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক দু’জনের পদাধিকারবলে হল ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদের সদস্য থাকতেন। আমাদের সময় কেউই এই অধিকারের সুযোগ নিতেন না। কারণ, সকলেই তখন কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে যেতেন অথবা অবতীর্ণ হতে সচেষ্ট থাকতেন। আমি যেহেতু সিএসএস পরীক্ষা দিয়ে তার ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলাম, সুতরাং আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র এবং প্রাক্তন সহ-সভাপতি হিসেবে হলে এক বছর থাকবার অধিকার পাই। অবশ্য এমএ পরীক্ষা দেয়ার পর আমি আর আমার পিতার ওপর আর্থিক নির্ভরশীলতা রাখতে প্রস্তুত ছিলাম না। তাই আমি এমএ পরীক্ষা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রোজগারের রাস্তা খুঁজছিলাম। ঢাকার বিভিন্ন কলেজে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখলাম, কোথাও ইংরেজী অধ্যাপকের পদ খালি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন সুযোগ পেলাম না একটি বিশেষ কারণে। আগের বছর আমাদের বিভাগের বিখ্যাত ভাল ছাত্র আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খানকে এমএ পরীক্ষা দেয়ার পরে বিভাগ প্রধান মি. টার্নার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নিযুক্ত করেন। সেই নিযুক্তির বিরুদ্ধে ড. সাজ্জাদ হোসেন উপাচার্যের কাছে তার আপত্তি জানান। সেই কারণে অধ্যাপক টার্নার সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আর কখনও এমএ পাস না করা পর্যন্ত কাউকে অধ্যাপক বানাবেন না। আমার প্রিয় শিক্ষক জ্যোতির্ময় বাবু আমাকে একদিন ডেকে বললেন, তুমি কি প্রাইভেট টিউশনি করবে? তাতে কম সময় ব্যয় করে ভালই রোজগার করতে পারবে। তিনি আমাকে একটি টিউশনি গ্রহণ করার জন্য কোথায় তা করতে হবে তার নাম-ঠিকানা দিয়ে দিলেন। আমি তাৎক্ষণিকভাবে মাসিক ১২৫ টাকা বেতনে একজন উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রী কামরুন্নেসাকে পড়াতে শুরু করলাম। সেই ছাত্রী ছিলেন গোলাম মোর্শেদী নামক অবসরপ্রাপ্ত শ্রম কমিশনারের মেয়ে এবং তিনি থাকতেন স্বামীবাগে। আমি এই কাজে লিপ্ত থাকাকালে জ্যোতির্ময় বাবু আমাকে হরগঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আহমদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আহমদুল্লাহ সাহেব বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই আমাকে খুঁজছিলেন। তার সঙ্গে আলোচনা করে সাব্যস্ত হলো, আগামী মাসে আমি হরগঙ্গা কলেজের ইংরেজী বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেব। আমি জেনে নিলাম, সলিমুলাহ হল থেকে হরগঙ্গা কলেজে যেতে সাইকেল, ট্যাক্সি, জাহাজ অথবা লঞ্চ এবং রিক্সা ব্যবহার করতে হবে এবং তাতে আমার সময় লাগবে প্রায় দুই/আড়াই ঘণ্টা। আমি সপ্তাহে দু’দিন মুন্সীগঞ্জ যাব বলে রাজি হলাম। এ বছরের সর্বশেষ যে বিষয়টি আমার মনে আছে তা হলো কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা। যা শুরু হয় ১৪ নবেম্বর এবং শেষ হয় ৩ ডিসেম্বর। ১৫ অক্টোবর আমার এমএ পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই আমি কুমিল্লায় যাই শিক্ষা সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য। কুমিল্লা থেকে ফিরে এসেই আমাকে আমার হল ইউনিয়নের অনেক কাজ সমাপ্ত করতে হয়। যেমনÑ বার্ষিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, একোয়াটিক স্পোর্টস এবং আর একটি বিষয় যে সম্বন্ধে কিছুই এখন পর্যন্ত বলিনি। আমরা সলিমুল্লাহ হল রেস্তরাঁর জন্য সব সময় ঠিকাদার নিয়োগ করতাম। আমি ঠিক করলাম, এই ব্যবস্থাটি কাজ করছে না এবং রেস্তরাঁটি আমরা উপযুক্ত লোক নিয়োগ দিয়ে নিজেরাই পরিচালনা করতে পারি। এই সিদ্ধান্তটি নেয়ার পেছনে আর একটি উপাদান ছিল। সেই সময়ে রেস্তরাঁটিকে সংস্কার করা হয় এবং তার আয়তনও বাড়ানো হয়। এই কাজেও আমার যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হয়। এই উদ্যোগটি আমার সময়ে সফলভাবে পরিচালিত হয়। কিন্তু তারপর বোধ হয় বাদ দেয়া হয়। এসব কাজের চাপে আমি সিএসএস পরীক্ষার প্রস্তুতিতে তেমন সময় দিতে পারিনি। পরীক্ষার জন্য আমার ঐচ্ছিক বিষয় ছিল ইংরেজী সাহিত্য, আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাস এবং দর্শন। পরীক্ষার তৃতীয় দিনে আমার পরীক্ষা হলে যেতে প্রায় ৪৫ মিনিট নষ্ট হয়। সে ব্যাপারে আগেই বলেছি, আমি বিষয়টি ভুলেই গিয়েছিলাম। পরীক্ষাটাও তেমন ভাল হলো না। কারণ আমি একটি প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয় সংযোজন করি। বিকেলে হলে প্রত্যাবর্তন করার পর আমি ঠিক করলাম, আমি আর পরীক্ষা দেব না। এরকম যখন প্রস্তুতি ও মানসিক অবস্থা তখন আমার ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী আমার কামরায় এসে হাজির। এই দলে ছিল বন্ধু নুরুল হক এবং ভ্রাতাসম এক ভক্তের দল- মোকাম্মেল হক, শহীদুল হক মোর্শেদ, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ এবং আরও কয়েকজন। তাদের বক্তব্য হলো, আপনি ভাল না করতে পারেন; কিন্তু প্রবন্ধ রচনায় ফেল করবেন না। সুতরাং পরীক্ষাটি বাদ দেয়া ঠিক হবে না। আমি বললাম, আমার পরীক্ষার প্রস্তুতি এমনিতেই খারাপ। আগামী বছর আমি পরীক্ষা দেব। সেখানে তাদের যুক্তি হলো, তাদের বিশ্বাস আমি পরীক্ষা দিলে পাস করব এবং ভালও করব, যদিও প্রথমদিকে নাও থাকতে পারি। বলতে দ্বিধা নেই যে, আমার একটি সুপ্ত বাসনা ছিল, এই পরীক্ষায় আমি প্রথম হব; কিন্তু বাস্তবে তা কোনদিনই হলো না। তারা যুক্তি দেখালো যে, পরীক্ষাটা যদি আমি দিই এবং আমার মনমতো চাকরি পাই তাহলে পরীক্ষায় প্রথম হতে না পারলেও চাকরিতে আমি এক বছরের জ্যেষ্ঠতা পাব। পরবর্তী বছরে আমি প্রথম হলেও আরও কর্মকর্তা ইতোমধ্যে আমার অনেক উপরে চলে যাবেন, যা আমার চাকরিজীবনের জন্য ভাল হবে না। অবশেষে আমি তাদের যুক্তিটি গ্রহণ করলাম এবং প্রস্তুতিতে আবার মনোযোগ দেব বলে অঙ্গীকার করলাম। আমাকে পড়ালেখায় বিশেষ সুযোগ দেয়ার জন্য মোকাম্মেল হক তার সিঙ্গেল কামরাটি আমার জন্য খালি করে দেয়ার ব্যবস্থা নিল। আমার মনে হয়, এই সিদ্ধান্তটি আমার জন্য ভালই হয়। আমি ২২ বছর পূর্ণ করেই আমার কাক্সিক্ষত চাকরিটি পাই এবং ৪৮ বছরে পদার্পণের আগেই অবসর নিতে সক্ষম হই। যাহোক, ১৯৫৫ সাল আমার শেষ হলো জীবনের দুই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা দিয়ে। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হলো অক্টোবরের ১৫ তারিখে আর সিএসএস পরীক্ষা শেষ হলো ডিসেম্বরের ৩ তারিখে। মোটামুটিভাবে অন্য পরীক্ষাগুলো বেশ ভালই হলো। আমি আমার সময়ে বাধ্যতামূলক ইংরেজী, ঐচ্ছিক ইংরেজী, ঐচ্ছিক দর্শন ও ঐচ্ছিক ইউরোপীয় ইতিহাসে সর্বোচ্চ নম্বর পাই। কিন্তু প্রবন্ধ রচনায় পাই পাস মার্কের সামান্য বেশি ৪৭ নম্বর। চলবে...
×