অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গুরুতর অনিয়মে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। এসব অনিয়মের বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের সতর্ক করে তিনি বলেছেন, ভবিষ্যতে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অনিয়ম ধরা পড়লে জনগণের আমানত ঝুঁকিমুক্ত রাখার স্বার্থে পর্ষদ, প্রধান নির্বাহী এবং অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে মোটেও পিছপা হবে না। রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে গবর্নরের এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ডেপুটি গবর্নর, নির্বাহী পরিচালক ছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, দেশে কার্যরত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)-এর সাবেক চেয়ারম্যান নিজে, স্ত্রী-কন্যা ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মনোনীত ব্যক্তি এবং প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ৭শ’ কোটি টাকা অনিয়ম করে উত্তোলন করার কারণে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন করে পর্ষদ গঠন করার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে চিঠি প্রদান করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। গবর্নর অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটি সম্বন্ধে বলেন, আর্থিক খাতে সুশাসনের সার্বিক উন্নয়ন ঘটলেও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ পরিদর্শন চালিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গুরুতর অনিয়মের তথ্য উদ্ঘাটন করেছে, যা আর্থিক খাতের সুশাসনের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন চেয়ারম্যান নিজ নামে এবং স্ত্রী-কন্যা, তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মনোনীত ব্যক্তি এবং প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করেছেন। যার বর্তমান স্থিতি সাত শ’ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কতিপয় ঋণ হিসাবকে সিএল বিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত না করা, বিরূপ শ্রেণীকৃত ঋণকে অশ্রেণীকৃত হিসেবে দেখানো, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অনেক ঋণ হিসাবকে সিআইবিতে রিপোর্ট না করা, বিভিন্ন গ্রাহকের অগোচরে তাদের ঋণ হিসাবের বিপরীতে শ্যাডো এ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে পরিচালকরা কর্তৃক অবৈধভাবে অর্থ উত্তোলনের মতো গুরুতর অনিয়ম উদ্ঘাটিত হয়েছে। এমনকি স্বীয় প্রভাব খাটানোর স্বার্থে ওই ব্যক্তি কর্তৃক তার মালিকানাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট লোকজনের সমন্বয়ে পর্ষদ গঠনের বিষয়টিও প্রমাণিত হয়েছে। এসব অনিয়ম উদ্ঘাটিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিতে সুশাসন আনয়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই আমরা অভিযুক্ত পরিচালকদের অপসারণ করেছি। তাদের পর্ষদসহ আরেকটি পর্ষদে আমরা দু’জন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছি। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে ইতোমধ্যে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। আর সুশাসনের অভাবে পিপুলস লিজিংয়ে কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদেও পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গবর্নর বলেন, আমরা দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পর্ষদে দু’জন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছি।
তিনি প্রধান নির্বাহীদের সতর্ক করে বলেন, আজকের সভার মাধ্যমে আমি আপনাদের সতর্ক করে দিতে চাই, অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থান নিয়েছি। এ ধরনের অনিয়মের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে জন্য পরিচালনা পর্ষদ ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে আপনাদেরই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমি জানি আপনাদের ওপরও অনেক চাপ আসে। সেই চাপ যখন আপনারা মোকাবেলা করতে না পারবেন তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা নেবেন। ভবিষ্যতে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অনিয়ম ধরা পড়লে জনগণের আমানত ঝুঁকিমুক্ত রাখার স্বার্থে পর্ষদ, প্রধান নির্বাহী এবং অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে মোটেও পিছপা হবে না বলেও জানান গবর্নর।
বৈঠকে এসব অনিয়মের বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের সতর্ক করেন গবর্নর। তিনি বলেন, অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থান নিয়েছি। এ ধরনের অনিয়মের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে জন্য পরিচালনা পর্ষদ ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে আপনাদেরই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে পরিচালকদের সংশ্লিষ্টতা গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আমরা মালিক পক্ষের সঙ্গে এসব বিষয়ে আলোচনায় বসব। তবে এ ধরনের অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতার দায়ভার সম্পূর্ণরূপে আপনাদের।
তিনি জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্মত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামো ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য সব ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন্স প্রণয়নের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। অচিরেই তা জারি করা হবে। এর পরিপালন ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস করবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রেরিত ঋণ/লিজ শ্রেণীকরণ সংক্রান্ত বিবরণীর অসঙ্গতি চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে একটি ‘স্বয়ংক্রিয় শ্রেণীকরণ মনিটরিং সিস্টেম’ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানান গবর্নর।
কোন প্রতিষ্ঠান ঋণ/লিজ হিসাবের শ্রেণীকরণ সম্পর্কে কোন অসঙ্গতিপূর্ণ বা ভুল তথ্য প্রদান করলে তা এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরূপণ করা যাবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন নিয়ে তিনি বলেন, বরাবরের মতো আমি বন্ড মার্কেট উন্নয়নে আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখতে চাই। এতে আপনাদের তহবিল সঙ্কট দূর হওয়ার পাশাপাশি দেশের বন্ড মার্কেটও শক্তিশালী হবে। এ জন্য এ বিষয়ে সবাইকে আরও উৎসাহী উদ্যোগী হতে হবে। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় একটি শক্তিশালী বন্ড মার্কেট প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলেও জানান গবর্নর।
অনুষ্ঠানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের পাশাপাশি অন্যান্যের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর চৌধুরী, নাজনীন সুলতানা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জিএম শাহ আলমসহ অনেকে।