ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চরজুড়ে লাশ আর কঙ্কাল

ব্রহ্মপুত্র ছিল বধ্যভূমি

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫

ব্রহ্মপুত্র ছিল বধ্যভূমি

একাত্তরে টর্চার সেল ও কিলিং সেন্টার ছিল ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। প্রত্যক্ষদর্শী এ্যাডভোকেট আবুল কাশেম জানান, অবাঙালী কিলার গ্রুপ ও স্থানীয় রাজাকার আলবদররা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালীদের ধরে এনে ডাকবাংলোয় গুলি করে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দিত পেছনের ব্রহ্মপুত্র নদীতে। শেয়াল কুকুর খেয়ে ফেলার পরও দেশ স্বাধীন হলে ব্রহ্মপুত্র পাড় ও চরজুড়ে পড়েছিল শত শত লাশ আর কঙ্কাল। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল জানান, একাত্তরের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহ শহরের পতন হলে ২৩ এপ্রিল শুক্রবার পাক সেনারা ঢুকে পড়ে। গঠন করা হয় শান্তি কমিটি। ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর সাইন বোর্ড সরিয়ে সেখানে মে মাসে ঝোলানো হয় ‘জিলা শান্তি কমিটির কার্যালয়, মোমেনশাহী’ সাইন বোর্ড। শান্তি কমিটির সাইন বোর্ড ঝোলানো হলেও এর নেপথ্যে ছিল মূলত ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্য নিয়ে গঠিত আলবদর বাহিনীর টর্চার সেল। ইসলামী ছাত্রসংঘ বৃহত্তর ময়মনসিংহের তৎকালীন সভাপতি আশরাফ হোসেন (যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক), সহ-সভাপতি মজিবুর রহমান ঘাটাইল, সাধারণ সম্পাদক শেরপুরের কামারুজ্জামান গৌরীপুরের এ্যাডভোকেট সারোয়ারসহ ১১ সদস্যের কমিটি ছিল জেলা পর্যায়ে। আলবদর বাহিনীর জন্ম হয়েছিল জামালপুরের আরামনগর মাদ্রাসায়। হেড কোয়ার্টার ছিল এই ডাকবাংলোয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে আলবদর বাহিনীর অপারেশনাল কমান্ডার ছিল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান। শহরের চকবাজার বড়মসজিদ ও সংলগ্ন মাদ্রাসা ছিল রাজাকারদের আস্তানা। বড়মসজিদের ইমাম শান্তি কমিটি প্রধান মাওলানা ফয়েজুর রহমানের ছেলে মৃত মফিজুর রহমান তৈয়ব ছিল অস্ত্রধারী রাজাকার কমান্ডার। তার সহযোগী ছিল রাইফেলধারী রফিক ও মানিক। অবাঙালী কিলার ইয়াসিন ও নজর আব্বাসসহ অস্ত্রধারী রাজাকাররা বাঙালীদের ধরে এনে তুলে দিত আলবদর বাহিনীর হাতে। এ্যাডভোকেট আবুল কাশেম মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে ময়মনসিংহের ডাকবাংলোয় সেদিনের হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। বর্তমান সরকার মেয়াদে ডাকবাংলোর পেছনে এই বধ্যভূমিটি চিহ্নিত করা হয়েছে। একাত্তরে শহীদ রতন খন্দকারকে স্থানীয় রাজাকার ও আলবদররা শহরের গাঙিনাপাড় ট্রাফিক মোড় থেকে ধরে নিয়ে যায় জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে। হাত পা বেঁধে নির্যাতনের পর হত্যা করে রতনের লাশ ফেলে দেয়া হয় ব্রহ্মপুত্র নদীতে। পরিবারের অপর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার অপরাধেই রতনকে সেদিন ধরে নিয়ে ডাকবাংলোর ভেতরে হত্যা করা হয়ল। কাচিঝুলি এলাকা থেকে রাজাকার ও আলবদর জেলা পরিষদের এই ডাকবাংলোয় ধরে নিয়ে যায় টেপা মিয়া ও শহীদ জহিরুল ইসলাম দারাকে। ডাকবাংলোর ভেতরে অনেকের সঙ্গে আটক টেপা মিয়া ও ছেলে দারাকে নির্যাতনের পর পেছনে দু’হাত বেঁধে রাতের বেলায় লাইনে দাঁড় করানো হয় গুলির জন্য। গুলির শব্দ শুনেই কিছুটা পেছনে থাকা টেপা মিয়া মাটিতে পড়ে যান। ওই দিন দারা শহীদ হলেও লাশের স্তূপের নিচে পড়ে থাকা টেপা মিয়া কৌশলে ডাকবাংলোর পেছনের ভাঙা দেয়ালের নিচ দিয়ে হামাগুড়ি করে লাফিয়ে পড়েন ব্রহ্মপুত্রে। পরে সাঁতরে কাটাখালি এলাকার বাসিন্দা জেলা পরিষদের অবসরপ্রাপ্ত ওভারশিয়ার আবদুর রহিমের বাসায় উঠে প্রাণ বাঁচান। ময়মনসিংহ মুক্ত হওয়ার পর টেপা মিয়া পরনের লুঙ্গি দেখে ব্রহ্মপুত্র তীরে শহীদ দারার কঙ্কাল শনাক্ত করেন। শহীদ রতন, শহীদ দারা, শহরের চামড়াগুদাম এলাকার বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ শহীদ শাহেদ আলী, আকুয়া এলাকার শহীদ আনোয়ার হোসেন সুরুজসহ অসংখ্য বাঙালীকে ধরে নিয়ে ডাকবাংলোর ভেতরে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে এসব লাশ ফেলে দেয়া হয় ব্রহ্মপুত্র নদীতে। শহরের মহারাজা রোডের মধু বাবুর গলি থেকে ধরা হয় জাফর মিয়াকে। আটদিন বন্দী থাকার পর অনেক ধরাধরি করে জাফরকে সেদিন ছাড়িয়ে আনতে পেরেছিলেন স্ত্রী রমিসা। তবে ছেড়ে দেয়ার আগে পাক সেনা জাফরের শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে এক ব্যাগ রক্ত রেখে দেয়। ডা. এমএ হাসান সম্পাদিত যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ গ্রন্থে এই কাহিনীর উল্লেখ রয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্ট হাউস ছিল পাক সেনাদের ৯৩ ব্রিগেড কমান্ডের হেড কোয়ার্টার। এই কমান্ডের কমান্ডার ইন চীফ ছিল ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদির খান। লে. কর্নেল আফতাব আহমদ কোরেশী ছিল তার সহযোগী। এই কমান্ডের অধীন ৩১ বেলুচ জামালপুর ও শেরপুর নিয়ন্ত্রণ করত। আর শহরের সার্কিট হাউসে ছিল জিসিও ৩৩ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন। ডা. এমএ হাসান সম্পাদিত যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ গ্রন্থে এসবের উল্লেখ রয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রেস্ট হাউস নির্মম নির্যাতনের শিকার ও এখানে বন্দী দশায় অন্তত ১০ হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী মুকুল নিকেতন স্কুলের রেক্টর আমির আহমদ চৌধুরী রতন জানান, বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালীদের ধরে এনে এখানে হাত পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতনের পর কখনও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে, কখন ব্লেড-চাকু দিয়ে কাটাছেঁড়া করে আধমরা করার পর গুলি করে হত্যা করা হতো। পরে এসব লাশ ফেলে কিংবা ভাসিয়ে দেয়া হতো ব্রহ্মপুত্র নদীতে। চোখের সামনেই হাবিলদার আলাউদ্দিন চাকু দিয়ে জবাই করে হত্যা করে ভালুকা থেকে ধরে আনা আব্দুল হেকিমকে। এরকম ১০টি হত্যাকা- প্রত্যক্ষ করেন সেদিন রতন। এসব হত্যাকা-ের বাইরে এখানে বন্দী অবস্থায় তিনি অনেক নারীর কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন বলে জানান। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক বিমল পাল জানান, একাত্তরে ডাকবাংলো ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দু’টি টর্চারসেল ও কিলিং সেন্টারে কতজনকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. শাহ মোহাম্মদ ফারুকের উদ্যোগে রেস্ট হাউসের পেছনের বধ্যভূমিটি শনাক্ত ও চিহ্নিত করা হয়। পরে বর্তমান সরকার মেয়াদে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতৃত্বে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্ট হাউস, ডাকবাংলো, সার্কিট হাউস সংলগ্ন পার্কের বধ্যভূমিসহ কয়েকটি বধ্যভূমি শনাক্ত করে সংরক্ষিত করা হয়েছে। এর বাইরে গফরগাঁওয়ের চরআলগী, মুক্তাগাছার মানকোন, ফুলপুরের সরচাপুরসহ বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সেখানে নির্মিত করা হয়েছে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ। Ñবাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ থেকে
×