ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বগুড়া নগরীর সেই করতোয়া

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫

বগুড়া নগরীর সেই করতোয়া

সমুদ্র হক ॥ নগরীর গর্ব করতোয়াকে নিয়ে কতই না পরিকল্পনা ছিল! আজ তা শুধুই স্বপ্ন। পরিকল্পনার পরী পাখা মেলে উড়ে গিয়ে রেখে গেছে শুধুই কল্পনা। স্বপ্ন আর কল্পনাগুলো হার মেনেছে একদিকে দখলদার আরেক দিকে মিউনিসিপ্যালিটির (পৌরসভা) শহর পরিষ্কার ও ড্রেনের বর্জ্য।ে দুইয়ে মিলে করতোয়ার অস্তিত্ব উপড়ে ফেলছে। দিনে দিনে সেদিনের প্রমত্তা নদী এতটাই শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছে যে নদীকে বাঁচানো না গেলে প্রবীণদের বর্তমান প্রজন্মকে জানাতে হবে ‘একদা করতোয়া নদী ছিল।’ তার পরবর্তী প্রজন্ম হয়ত জানবেও না কোন নদীর কথা। প্রবীণরা বলেন, এই করতোয়া নদীর ওপর দিয়ে দূর-দূরান্তের বড় নৌকা বজরা নৌকা গয়না নৌকা চলত। বড় নদীপথ ছিল করতোয়া। নদীকে ঘিরেই চলত ব্যবসা বাণিজ্য। পণ্যবাহী বড় নৌকা ভিড়ত করতোয়ার তীরে শহরের ফতেহ্ আলী (রঃ) মাজার সংলগ্ন বাজারে। এই বাজারের সঙ্গেই ছিল খেয়াঘাট। ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত খেয়াঘাট ছিল। তারপর রেলব্রিজের পাশেই নির্মিত হয় কনস্ট্রাকশনের ব্রিজ। এই সড়ক সেতু পূর্বের বিরাট এলাকাকে শহরের সঙ্গে একীভূত করে দেয়। বুড়িগঙ্গার তীরে যেমন রাজধানী মহানগরী ঢাকা তেমনই করতোয়ার তীরে উত্তরাঞ্চলের মধ্যনগরী বগুড়া। নগরীর সৌন্দর্য অনেকটা বেড়ে দেয় করতোয়া নদী। মুক্ত বায়ুর সঙ্গে পরিবেশের সংযোগে করতোয়া নদী বগুড়া শহরকে গোছানো নগরীকে পরিণত করে। সেদিনের সেই বগুড়া শহর আজ কত অচেনা! একটি ভুল পরিকল্পনায় করতোয়ার নাব্য কমতে থাকে। গত শতকের ৮৭-৮৮ সালে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালির কাছে একটি অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে বহমান করতোয়ার মধ্যে একটি স্লুইস গেট বানিয়ে পানি প্রবাহ রুদ্ধ করে আরেকদিকে প্রবাহিত করা হয়। চকরহিমপুরে রেগুলেটর বানিয়ে দক্ষিণমুখী সকল প্রবাহ রুদ্ধ করা হয়। এভাবে পানিপ্রবাহ রুদ্ধ হওয়ায় দিনে দিনে গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়ার দিকে পানিপ্রবাহ কমে শুকনো মৌসুমে করতোয়া খালে পরিণত হতে থাকে। বর্ষার বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে প্রবাহ না বেড়ে করতোয়ার পানি কিছুটা বাড়লেও তা মরা গাঙের মতোই হতে থাকে। এক পর্যায়ে তাও আর হয় না। বর্তমানে করতোয়া নদী দেখে কেউ মনে করবে না এটা কোন নদী। মনে হবে শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল। সেদিনের সেই পরিকল্পনা যে ভুুল ছিল তা এ বছরের বন্যার সময় পরিষ্কার হয়ে যায়। গোবিন্দগঞ্জের রেগুলেটরটি তীব্র ¯্রােতে ভেঙ্গে গেলে এপারের করতোয়া ভরে ওঠে। ফের শুকিয়ে যায়। করতোয়ায় প্রবাহ না থাকায় দিনে দিনে ভূমি দখলকারীরা লোলুপ দৃষ্টি দেয় নদীর ওপর। করতোয়া যতই শুকায় ভূমি দখলকারীরা শুকনোর ওপর মাটি ভরাট করে নদীর ভিতরটায় এগোতে থাকে। শীর্ণকায় হতে থাকে নদী। বর্তমানে করতোয়া দখল করে অবকাঠামো গড়ে তোলার মহৎসব শুরু হয়েছে। শহরের নওয়াববাড়ি সড়কের ধারে একটি বড় বেসরকারী সংস্থার বহুতল আধুনিক মার্কেটের ওপর থেকে নদীর দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যায় কিভাবে কতটা দস্যুতার মধ্যে নদীভূমি দখল করা হচ্ছে। এরই মধ্যে পৌরসভার সকল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীর ওপর ব্রিজের নিচে ও আশপাশে। বর্জ্য ফেলায় যা পানি আছে তাও বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই ভাসমান মানুষ গোসল ও কাপড় কাঁচে। কখনও নদীর ভিতরে আবর্জনার ওপর বালু ফেলে পানি অপসারণ করে দখল করা হয়েছে। নদীর উত্তরে ও দক্ষিণে শুকনো ভূমিতে চাষাবাদও শুরু হয়েছে। আরেকদিকে শ্যালো ইঞ্জিনের শক্তিতে নদীর বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। নদী দখল, ময়লা আবর্জনার ভাগারে পরিণত করাসহ কতভাবে যে করতোয়াকে ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করা হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। খোঁজ খবর করে জানা যায় সেটেলমেন্ট অফিসের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভূয়া কাগজপত্র বানিয়ে করতোয়া নদীভূমিকে বেচে দেয়া হচ্ছে প্রভাবশালী চক্রের কাছে। নিয়ম অনুযায়ী নদীভূমি সরকারী খাস জমি। এই ভূমি দখল সম্পূর্ণ বেআইনী। এমন কি নদী শুকিয়ে গেলেও তা সরকারের খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত। নদী ভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসন কয়েকদফা উদ্যোগ নেয়। যারা দখলকারী তাদের একটি তালিকা ওপর মহলে পাঠানো হয়। কোন উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। সূত্র জানায় করতোয়া নদীর পরিমাপ ১৯২০ সালের সিএস রেকর্ড ও ১৯৬২ সালের এমআর রেকর্ডে স্পষ্ট উল্লেখ এবং বর্ণনা করা আছে। ঢাকায় সরকারী কেন্দ্রীয় রেকর্ডরুমে তা সংরক্ষিত আছে। এই রেকর্ড বের করে নদীর দৈর্ঘ্য প্রস্থ হিসাব করলে সহজেই বের হয় আসবে কে কত ভূমি অবৈধভাবে দখল করে আছে। যুগের পর যুগ চলে যায় কেউ এই নদী উদ্ধারে এগিয়ে আসে না। এদিকে করতোয়া নদীকে ঘিরে উন্নয়নের যে বড় পরিকল্পনা হয়েছিল তাও বন্ধ হয়ে গেছে। করতোয়ার ভাগ্যে এখন একটি কথাই বাকি- একদা এখানে একটি নদী ছিল। প্রজন্মের কেউ হয়ত সুর তুলে গাইতেও পারে- আমার একটি নদী ছিল জানল না তো কেউ।
×