ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সন্ত্রাসবিরোধী সৌদি জোটে যোগদান ইতিবাচক

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫

সন্ত্রাসবিরোধী সৌদি জোটে যোগদান ইতিবাচক

তৌহিদুর রহমান ॥ সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোটে অংশগ্রহণে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবে না বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে এই জোটে যোগ দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের কথা মাথায় রেখে এই জোটে যোগ দেয়াটাকে যৌক্তিক বলেই মনে করছেন তারা। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান জোরালো করতেই এই জোটে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে এই জোট সামরিক জোট হবে কি-না সেটা এখনও চূড়ান্ত নয়। এদিকে শুরুতে পাকিস্তান এই জোটে নেই বললেও বৃহস্পতিবার দেশটি অবস্থান বদলে সৌদি জোটে থাকবে বলে নিশ্চিত করেছে। সৌদি আরবের সন্ত্রাসবিরোধী জোটে যোগ দেয়ার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ড. দেলোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে রয়েছে। সে কারণে সৌদি আরব থেকে কোন উদ্যোগ নিলে বেশিরভাগ মুসলিম দেশ তাতে সম্মতি জানিয়ে থাকে। এবারই প্রথম নয়, এর আগে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহ দমনেও সৌদি আরবকে সমর্থন জানিয়েছিল বাংলাদেশ। তিনি বলেন, সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোও মনে রাখতে হবে। এছাড়া সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান জোরালো করতেই বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দিয়েছে। এই জোটে বাংলাদেশের যোগ দেয়াকে তিনি ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আইএসবিরোধী লড়াই জোরদার করতেই মূলত এই সৌদি জোট কাজ করবে। বাংলাদেশও আইএসবিরোধী লড়াইয়ে রয়েছে। এই জোটে যোগ দেয়ার ফলে বাংলাদেশের আইএসবিরোধী অবস্থান আরও জোরদার হবে বলে উল্লেখ করেন ড. দেলোয়ার হোসেন। সৌদি জোটে যোগ দেয়ার বিষয়ে যৌক্তিকতা জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকার সব সময়ই জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। সে কারণে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন এই জোটে আমরা যোগ দিয়েছি। এছাড়া এই জোট শুধু যে আইএসবিরোধী লড়াই চালিয়ে যাবে, তা নয়। যে কোন ধরনের জঙ্গীবাদবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাবে এই জোট। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সৌদি আরবের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী যে জোট হচ্ছে তা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সৌদি আরব এই জোটের বিষয়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এই জোট মূলত জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। তবে এই জোট সামরিক জোট হবে কি-না সেটা এখনও চূড়ান্ত নয়। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে সামরিক সহযোগিতা দেয়া হবে। সৌদি আরব বলছে, তারা একটি জঙ্গীবাদবিরোধী সেন্টার প্রতিষ্ঠা করবে। জঙ্গীবাদ নিরসনে সদস্য দেশগুলো তথ্য আদান-প্রদান, সহযোগিতা, অভিজ্ঞতা বিনিময় ইত্যাদি কার্যক্রম চালানো হবে। এছাড়া এই সেন্টার থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সহযোগিতাও করা হবে। কূটনৈতিক সূত্রমতে, সৌদি আরবের পক্ষ থেকে এই জোটে যোগ দেয়ার জন্য বিভিন্ন মুসলিম দেশের কাছে যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, সেখানে সামরিক সহযোগিতার কথা বলা হলেও এটি যে সামরিক জোট হবে, সেটা বলা নেই। সৌদি আরব বলেছে, রিয়াদে একটি জঙ্গীবাদবিরোধী মুসলিম সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি হবে মুসলিম দেশগুলোর সন্ত্রাসবিরোধী জোট। তবে প্রয়োজনে সামরিক সহযোগিতার বিষয়টিও আসবে এই জোটে। এদিকে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে জোটের বিষয়ে যে ঘোষণা দেয়া হয়- সেখানে বলা হয়, এটি হবে একটি সামরিক জোট। সে কারণে সৌদি আরবের ঘোষণা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তবে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য রিয়াদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। মুসলিম দেশের এই জোটের তালিকায় পাকিস্তানের নাম দেখে দেশটি শুরুতে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল। তবে দু’দিন পর বৃহস্পতিবার পাকিস্তান এই জোটে যোগ দেবে বলে নিশ্চিত করেছে। বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের ডন পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার সৌদি আরবের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী জোটে থাকবে বলে নিশ্চিত করেছে। জোটে যোগ দেয়ার জন্য রিয়াদের কাছ থেকে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়েছে পাকিস্তান। এদিকে সৌদি আরবের এই সন্ত্রাসবিরোধী জোটের বাইরে রয়েছে জনসংখ্যার দিক থেকে একক বৃহত্তর মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। সৌদি আরব ইতোমধ্যেই দু’বার ইন্দোনেশিয়াকে এই জোটে থাকার আহ্বান জানিয়েছে। সৌদি আরবের প্রস্তাব এখনও স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছে জাকার্তা। সৌদি আরবের এই প্রস্তাব ভাল করে জেনে-বুঝেই জাকার্তা সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরমন্ত নাসির। সৌদি আরবের নেতৃত্বে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদবিরোধী ৩৪ মুসলিম দেশের এই জোটে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ এই জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে জোটে যোগ দেয়ার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠান সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল বিন আহমেদ আল জুবাইর। সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির আলোকে অন্যান্য মুসলিম দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সৌদি আরব ও বাংলাদেশ ছাড়াও বাহরাইন, বেনিন, শাদ, কোমোরোস, আইভরিকোস্ট, জিবুতি, মিসর, গ্যাবন, গায়ানা, জর্দান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মালি, মরক্কো, মৌরিতানিয়া, নাইজার, নাইজিরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, কাতার, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, সুদান, টোগো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, আরব আমিরাত ও ইয়েমেন থাকছে এই জোটে। এছাড়া আরও কয়েকটি মুসলিম দেশ এই জোটকে সমর্থন জানিয়েছে। জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে এসব দেশের সঙ্গে সৌদি আরব আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান ও সিরিয়াকে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। মুসলিম দেশের নতুন এই জোটের বিষয়ে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান জানিয়েছেন, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, মিসর ও আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে নতুন করে সমন্বয় ঘটাবে এই জোট। ইসলামিক উগ্রপন্থা নামক রোগের সঙ্গে লড়াই করার বিষয়ে ইসলামী বিশ্বের নজরদারি থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইসলামিক উগ্রপন্থা নামক রোগ ইসলামী বিশ্বকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বর্তমানে প্রতিটি মুসলিম দেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাই এসব অভিযানে সমন্বয় ঘটানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, এই জোটে যোগ দেয়ার আগে এই দেশগুলোকে কিছু পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আসতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী জোটে ৬৫ দেশ রয়েছে। যদিও খুব কম দেশই সক্রিয়ভাবে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ার আইএসের বিরুদ্ধে সক্রিয় সামরিক ভূমিকা নেয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রবল চাপ রয়েছে। তবে সকল দেশই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটে অংশগ্রহণ করেনি। এখন সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে অনেক দেশই যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর আগে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীগোষ্ঠী দমনে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল বাংলাদেশ।
×