ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিজয়ের ৪৪ বছর উদ্্যাপনে আনন্দমুখর রাজধানী

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫

বিজয়ের ৪৪ বছর উদ্্যাপনে আনন্দমুখর রাজধানী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মহান বিজয় দিবস বাঙালীর গর্বের দিন। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে, এদিন বিশ্বের মানচিত্রে সৃষ্টি হয় নতুন একটি সার্বভৌম দেশ- বাংলাদেশ; যা বাঙালী জাতিকে এনে দেয় আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। বীর মুক্তিযোদ্ধারা একটানা নয় মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ বিজয়কে অনিবার্য করে তুলেছিলেন। যেসব কীর্তিমান মানুষের আত্মত্যাগে এ বিজয় সম্ভব হয়েছিল, প্রতিবছর এই দিনে গোটা বাঙালী তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তাই নতুন চেতনায় দেশপ্রেমে শানিত হওয়ার দিন বিজয় দিবস। রাজধানীজুড়ে নানা আনুষ্ঠানিকতায় দিবসটি উদ্যাপন করা হয় বুধবার। বিশিষ্টজনদের আলোচনায়, সেলুলয়েডের পর্দায়, নৃত্য, গান ও কবিতার ছন্দে, নাটকের সংলাপে কিংবা শিল্পীর মনন আশ্রিত শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর মাধ্যমে সূর্যসন্তানদের জানানো হয় হৃদয়ের ভালবাসা। বিজয়ের ৪৪ বছর উদযাপনে রাজধানীর সংস্কৃতি অঙ্গন ছিল আনন্দমুখর। ভোরের কুয়াশা চিরে, লাল-সবুজের পতাকা বুকে ধারণ করে হাজার হাজার মানুষ ছুটে যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সাভারের স্মৃতিসৌধ অভিমুখে। শিশু-কিশোররা ছুটেছে সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। অনেকে ভিড় করেন ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে। জাতীয় জাদুঘরের দ্বার ছিল সবার জন্য উš§ুক্ত। এবারের বিজয় দিবস বাঙালীর জীবনে কিছুটা অন্যভাবে এলো। একটু একটু করে কলঙ্ক মুক্তির পথে দেশ। একের পর এক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর করার ফলে বিজয়ের আনন্দ আরও গভীর হবে, এটাই স্বাভাবিক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ॥ ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথে জঙ্গীবাদকে দাঁড়াও রুখে’ সেøাগানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত আট দিনব্যাপী বিজয় উৎসবের বুধবার ছিল চতুর্থ দিন। সংস্কৃতিকর্মীদের অংশগ্রহণে ছিল শোভাযাত্রা। বিজয়ের আনন্দ ও চেতনা পৌঁছে দিতে নাটক, গান, আবৃত্তি ও নৃত্যাঙ্গনের মানুষেরা বুধবার নিজেদের রাঙিয়েছেন নানা বৈচিত্র্যময়তায়। আঞ্চলিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ, স্বভাবকবি মুকুন্দ দাস, স্বামী বিবেকানন্দসহ দেশের প্রতিশ্রুতিশীল মানুষদের মতো করে নিজেদের সাজিয়ে অনেকে নেমেছে শোভাযাত্রায়। অর্ধশতাধিক সংস্কৃতিকর্মী হাতে নিয়েছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে শুরু করে দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রগামী মানুষের ছবি। আর লোক আঙ্গিকের কস্টিউম পরে উল্লাসে মেতে উঠেছে বেশ কজন নাট্যকর্মী। পোস্টার, ব্যানার, কস্টিউম সবকিছুই যেন বিজয়ের মাহাত্মকে এককাতারে দাঁড় করিয়ে একটি বিষয়কে তুলে ধরেছে। উদ্দেশ্য, যে স্থান থেকে, যাদের হাত ধরে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি, তারপর এগিয়ে চলা। সকালে এ রকম আবহ বিরাজ করছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। শোভাযাত্রার উদ্বোধক রামেন্দু মজুমদার, সংগঠনের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল আকতারুজ্জামান, সহ-সভাপতি ঝুনা চৌধুরী প্রমুখ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণে শোভাযাত্রটি ঢাক-ঢোলসহযোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি, টিএসসি হয়ে এগিয়ে চলে শাহবাগের উদ্দেশে। সেখান থেকে পুনরায় টিএসসিতে এসে শোভাযাত্রাটি শেষ হয়। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিল্পী এসএম মেজবাহ্ উদ্দিনের একক দেশাত্মবোধক গানের মধ্যদিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। পরে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন ঝর্ণা সরকার। বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশন করে কণ্ঠশীলন ও সংবৃতা। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন আশরাফুল আলম। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে ধৃতি নৃত্যালয় ও নৃত্যালোক। পথনাটক পরিবেশন করে মৈত্রী থিয়েটার ও নাট্যতীর্থ। শিশুতোষ পরিবেশনায় অংশ নেয় শিল্পবৃত্ত। মতিঝিল টিএ্যান্ডটি কলোনি, ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবর, মিরপুর, উত্তরাসহ একযোগে ১৪টি মঞ্চে পরিবেশিত হয় বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ॥ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘মানবাধিকার দিবস থেকে বিজয় দিবস’ শীর্ষক অনুষ্ঠামালার বুধবার ছিল সপ্তম দিন। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও সপ্তাহব্যাপী এ উৎসবের আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিশুদের গান, নৃত্য ও আবৃত্তির মধ্যদিয়ে এদিন সকাল থেকে শুরু হয় অনুষ্ঠান। শুরুতে দলীয় আবৃত্তি প্রযোজনা নিয়ে মঞ্চে আসে মৈত্রী শিশুদল। তারা ‘নবান্ন প্রভাত’ নামের আবৃত্তিগুচ্ছ পরিবেশন করে। এরপর সোসাইটি ফর দি ওয়েলফেয়ার অব অটিস্টিক চিল্ড্রেন’র শিক্ষার্থীদের দলীয় পরিবেশনায় ছিল নৃত্য। ‘আমার বাংলাদেশের একতারা সুর কতই ভালবাসি’ গানের সঙ্গে তাদের নৃত্যে সবাই মুগ্ধ হয়। সবশেষে ছিল ইউসেপ স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় দলীয় নৃত্য। সন্ধ্যায় লোকনাট্য গোষ্ঠীর পরিবেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘আনারকলি’ যাত্রাপালা। প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের রচনায় পালাটির নির্দেশনায় ছিলেন তাপস সরকার। শিল্পকলা একাডেমি ॥ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এখানে সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে আওয়ামী শিল্পীগোষ্ঠী, একাডেমির শিশু প্রশিক্ষণার্থী দল, ভাওয়াইয়া প্রশিক্ষণার্থী দল, খেলাঘর, ঋষিজ ও ব্যান্ড দল চিরকুট। সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে লায়লা হাসানের পরিচালনায় নটরাজ, সামীনা হোসেন প্রেমার ‘ভাবনা’, ওয়ার্দা রিহাবে পরিচালনায় ‘ধৃতি নর্তনালয়’, দীপা খন্দকারের দিব্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। ছিল বধির স্কুলের ৬০ শিক্ষার্থীর মুকাভিনয়। একক গান পরিবেশন করেন সমীর বাউল, সাইদুর রহমান বয়াতি, সালমা চৌধুরী, শিবু রায়, শাকিলা জাফর, রফিকুল আলম, আমজাদ দেওয়ান, নবীন কিশোর গৌতম ও রীনা আমিন। বাংলা একাডেমি ॥ মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে বুধবার বিকেলে ছিল আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের স্বাগত বক্তব্যের মধ্যদিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলা একাডেমি’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি পিয়াস মজিদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিশাত জাহান রানা। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। কবি পিয়াস মজিদ বলেন, একাডেমির কর্মীদের কাছে যেমন এই প্রতিষ্ঠান মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার অঙ্গীকারের স্থল ছিল তেমনি একাত্তরে একাডেমি বাংলার স্বাধীনতাকামী কবি-লেখক-সংস্কৃতিকর্মী-বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীর কাছে হয়ে উঠেছিল বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির এক অনন্য অভয়-অঙ্গন। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বিজয় দিবসে আমরা যেমন নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা লাভের আনন্দের প্রতিধ্বনি শুনি তেমনি অসংখ্য মানুষের ক্রন্দন ও শোকেরও প্রতিধ্বনি শুনি। যে মূল্যে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা সামান্য নয় এবং তা চিরকাল গর্বের বিষয় হয়ে থাকবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন হাসান আরিফ ও ঝর্না সরকার। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী আবদুল হালিম খান, মাহমুদুজ্জামান বাবু, সন্দীপন দাস ও তানজিনা করিম স্বরলিপি। জাতীয় জাদুঘর ॥ জাতীয় জাদুঘর দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয় এবং সুবিধাবঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী শিশুদের বিনা টিকেটে জাদুঘর পরিদর্শনের সুযোগ রাখা হয়। জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ‘১৯৭১ ঢাকার গেরিলা অপারেশন’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেনÑদুই মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীক ও এম এ রশিদ। সভাপতিত্ব করেন জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এম আজিজুর রহমান। এর আগে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। স্মৃতিচারণে হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক বলেন, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসর রাজাকারদের হাত থেকে বিশেষ করে ঢাকাকে মুক্ত করার জন্য আমাদের লড়াই ছিল জীবনপণ। এম এ রশিদ বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধে অংশগ্রহণ, প্রশিক্ষণ ও ঢাকা অপারেশনে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। যদিও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিদারুণ কষ্ট ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশমাতৃকার বিজয়ে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছি। বিজয় দিবসে বাঘের পাজল মিলিয়ে পুরস্কার নিল নগরবাসী ॥ পাজলে বাঘের ছবি মিলিয়ে পুরস্কার নিল শিশু, যুব, বৃদ্ধ। ‘ভিজিট বাংলাদেশ ২০১৬’র লোগোতে ছিল এই বাঘের ছবি। আর তা বড় পাজল বানিয়ে টানিয়ে দেয়া হলো নগরীর রাস্তায়। চলতি পথে দাঁড়িয়ে নিজের মেধা খাটিয়ে দ্রুত সময়ে পাজল মিলিয়ে পুরস্কার জিতে নিলেন অনেকে। বিজয় দিবসের আনন্দে যারা রাস্তায় বেরিয়েছেন তাদের অনেকেই এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পেরেছেন। ‘ভিজিট বাংলাদেশ কর আবিষ্কার, জিতে নাও তোমার পুরস্কার’ সেøাগান সামনে রেখে করা হয় এ আয়োজন। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ‘ভিজিট বাংলাদেশ ২০১৬’ এর প্রচারণা উপলক্ষে নগরীর সংসদ ভবনের সামনে, শাহবাগ ও হাতিরঝিলে পাজল মেলানো প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। যিনি পাজল মেলাতে পেরেছেন তাকে দেয়া হয়েছে কলম আর ভিজিট বাংলাদেশের লোগো লাগানো পতাকা। সকাল দশটায় শুরু হয়ে চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। বিরতিহীন চলতে থাকা পাজল মেলানো প্রতিযোগিতায় প্রায় এক হাজার মানুষ অংশ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা ॥ বিজয় দিবস উপলক্ষে বিশেষ আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সেগুনবাগিচার কচি-কাঁচা মিলনায়তনে। কচি-কাঁচার মেলা আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা শোনান মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব) মোহাম্মদ আলী শিকদার।
×