ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজপথে থেকেই সব চক্রান্ত মোকাবেলার ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫

রাজপথে থেকেই সব চক্রান্ত মোকাবেলার ঘোষণা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ঠিক যেন একাত্তরের মতোই বিজয়ের আনন্দে মেতেছিল আওয়ামী লীগের লাখো নেতাকর্মী, সমর্থক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্তির দিন বুধবার রাজধানীতে মানুষের স্রোত নামিয়ে বড় ধরনের শোডাউন করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দেখিয়েছে সাংগঠনিক শক্তির মহড়াও। মহান বিজয় দিবসে ‘ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ৩২ নম্বর ধানম-ি’Ñ দীর্ঘ প্রায় তিন কিলোমিটার পথে আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য ও মনোলভা বিজয় র‌্যালিতে নেমেছিল লাখো মানুষের ঢল। পুরো রাজধানীই যেন পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। বলা চলে বিজয়ের আল্পনায় বর্ণিল সাজে গোটা রাজধানীই ছিল জয় বাংলা মুখরিত। বিজয় মিছিলপূর্ব বিশাল সমাবেশ থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে থেকেই বিএনপি-জামায়াতের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলার ঘোষণা দেন কেন্দ্রীয় নেতারা। লাখো মানুষের সমাগম। মাথায় লাল-সবুজের পতাকা। বুকে দেশপ্রেম। গালে আঁকা মানচিত্রখচিত পতাকা। সবার চোখে মুখে ছিল বিজয়ের তৃপ্তি। এ যেন একাত্তরের পর আরও একটি বিজয়। চারদিকের মাইকের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই বজ্রনির্ঘোষ স্বাধীনতার ধ্বনি। দূর-দূরান্ত থেকে জয় বাংলা সেøাগান তুলে বাস-ট্রাকে চড়ে মিছিলে এসেছে বিজয়-আনন্দে উচ্ছল মানুষ। কোন ট্রাকে আবার বানানো হয়েছে বিজয় মঞ্চ। আবার মিছিলের সঙ্গে অনেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক বিশাল বিশাল আসল নৌকা, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অসংখ্য কাগজের কামান, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধাস্ত্র হাতে নিয়েও সামিল হয়েছিল বিজয় মিছিলে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রাজাকারের আত্মসমর্পণের ড্যামি দৃশ্যও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মিছিলে। অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত নিষিদ্ধ, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন আর রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধীমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ের এ বিজয় মিছিল শেষ হওয়ার কথা ধানম-ির বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে। যখন সেখানে পৌঁছে একটি মুখ, তখনও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বের হতে পারেনি মিছিলের অন্যপ্রান্ত, হাজারও মুখ। মাঝখানে মিছিলের ব্যাপ্তি ছিল তাবত রাজধানী ঢাকাজুড়েই। ঢাকা মহানগরীর ১৫টি নির্বাচনী এলাকা, ৪১টি থানা এবং শতাধিক ওয়ার্ড থেকে অজস্র মিছিলের স্রোত এসে মিশেছিল ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে। ৪৫ বছর আগে ৪টা ২২ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যেস্থানে পাকহানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছিল, ঠিক সেই সময় বিজয়ী লাখো বাঙালীকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা শিখা চিরন্তনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের মাধ্যমে এ বিজয় র‌্যালির উদ্বোধন করেন। সুশৃঙ্খল-দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল এ বিজয় র‌্যালিতে জাতীয় নেতাদের কণ্ঠেও ছিল একই শপথÑ ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, এখন রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলব।’ নেতাদের এমন দৃপ্ত ঘোষণায় বিজয় র‌্যালিতে আসা হাজার হাজার মানুষের উৎফুল্লতা ও হর্ষধ্বনি সবার দৃষ্টি কাড়ে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিজয় র‌্যালি শুরু হয়ে শাহবাগ, কাঁটাবন, বাটার মোড়, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, মিরপুর রোড হয়ে ধানম-ির ৩২ নম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে এসে শেষ হয়। বিজয় র‌্যালিতে এমনই মানুষের স্রোত নেমেছিল যে, মিছিলের অগ্রভাগ যখন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে পৌঁছায়, পশ্চাৎভাগ তখনও শাহবাগ পার হতে পারেনি। প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই বিজয় র‌্যালিতে অংশ নেয়া সকল মানুষের কণ্ঠেই ছিল একই দাবিÑ ‘মুজিবের বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নাই, জামায়াত-শিবির-রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।’ বিজয় র‌্যালি শুরুর আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে জনস্রোতের সামনে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলছে। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলেছে। কিন্তু তাদের রক্ষা করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা আর সাহসী নেতৃত্বের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, নিজস্ব অর্থায়েই আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি। এ সেতু নির্মাণ নিয়েও অনেক ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্ববাসী এসে দেখে যাও শেখ হাসিনা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন তিনি যা বলেন তা করে দেখান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও পদ্মা সেতুর কাজের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা তা আবারও প্রমাণ করেছেন। তাই বাঙালী জাতিকে কখনও দাবায়ে রাখা যায় না, যাবেও না। একাত্তরেও পারেনি, এখনও পারবে না। যুগ্মসম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। যতদিন পর্যন্ত রাজাকার-আলবদর-স্বাধীনতাবিরোধীরা বাংলার মাটিতে রয়েছে, এদের উৎখাত করতে না পারবÑ ততদিন পর্যন্ত আমাদের আদর্শিক যুদ্ধ ও লড়াই চলবে। এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই সুবিশাল বিজয় র‌্যালিই প্রমাণ করে দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ও আস্থাশীল। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে খোলা ট্রাকের মঞ্চে অনুষ্ঠিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ আজিজ। এতে আরও বক্তব্য রাখেনÑ আওয়ামী লীগ নেতা মুকুল বোস, ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, আহমদ হোসেন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, ডাঃ বদিউজ্জামান ভূঁইয়া ডাবলু, এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, এনামুল হক শামীম, সুজিত রায় নন্দী, স্বেচ্ছাসেবক লীগের পংকজ দেবনাথ এমপি, ছাত্রলীগের সাইফুর রহমান সোহাগ, এস এম জাকির হোসাইনসহ নগর নেতৃবৃন্দ। সমাবেশ পরিচালনা করেন আবদুল হক সবুজ ও শাহে আলম মুরাদ। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে একাত্তরের রণাঙ্গনের সেই অমিততেজী গগণবিদারী ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে বিজয় র‌্যালি শুরু হয়। আয়োজক ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ হলেও এ বিজয় র‌্যালিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। সুবিশাল এ বিজয় র‌্যালিতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী, সমর্থক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার অসংখ্য সাধারণ মানুষকে সুদীর্ঘ এ বিজয় র‌্যালিতে অংশ নিতে দেখা যায়। বিজয় র‌্যালিতে নারীদের অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখ করার মতো। একাত্তরের পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং ৭ মার্চে স্বাধীনতার ডাক দেয়া বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রকঠিন ঐতিহাসিক ভাষণের স্মৃতিবিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে দুপুর থেকেই মানুষের ঢল নামে। রাজধানীর ১০০টি ওয়ার্ড ও ৪১টি থানা থেকে অসংখ্য মিছিল আসতে শুরু করে সেখানে। বিকেল ৩টা বাজার আগেই শাহবাগ থেকে মৎস্যভবন পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তায় মানুষের তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাদ্য-বাজনার তালে তালে নেচে গেয়ে আসা তীব্র জনস্রোতে পুরো এলাকায় রীতিমতো মহাসমাবেশে রূপ নেয়। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর ১৫টি নির্বাচনী এলাকা থেকে দলের সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে বিশাল বিশাল দৃষ্টিনন্দন র‌্যালি সবার দৃষ্টি কাড়ে। এসব বর্ণাঢ্য র‌্যালিতে রং-বেরঙের বেলুন, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ট্রাক, হাতি, ঘোড়ার গাড়ি, নৌকা, দলীয় ও জাতীয় পতাকা, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বিশাল বিশাল প্রতিকৃতিসহ বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে ব্যান্ডের তালে তালে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থক ছাড়াও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নগরীর আপামর জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। বিজয় র‌্যালিতে ডামি রাইফেল, কামান, ট্যাঙ্কসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের রণসজ্জা, পাকহানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের আত্মসমর্পণ, প্রতীকী ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের দ- কার্যকরের দৃশ্য, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় উল্লাসসহ বিভিন্ন ডামি প্রদর্শনী সাধারণ মানুষের বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণ করে। র‌্যালিতে থাকা বিভিন্ন ট্রাকে লাগানো মাইকে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করা হয়। তবে সুবিশাল এ বিজয় র‌্যালির কারণে রাজধানীতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের।
×