ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সশস্ত্রবাহিনীর বর্ণিল ফ্লাইপাস্ট, এ্যারোবেটিক ডিসপ্লে

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫

সশস্ত্রবাহিনীর বর্ণিল  ফ্লাইপাস্ট, এ্যারোবেটিক ডিসপ্লে

ফিরোজ মান্না ॥ ‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা, যুদ্ধ মানে আমার প্রতি তোমার অবহেলা।’ পাকিরা আজ থেকে ৪৪ বছর আগে বাঙালীদের ওপর নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রম লুটে নিয়েছিল। বীর বাঙালী মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বর্বর পাকিদের হটিয়ে দিয়েছিল। ৪৪ বছর আগে আজকের এই দিনে ৯৩ হাজার সৈনিক নিয়ে আত্মসর্মপণের পর পাকি জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি মাথা নত করে পাকিস্তানে ফিরে যান। পাকিদের পক্ষে সেদিন বিশ্বের কয়েকটি পরাশক্তি থাকলেও বীর বাঙালীর কাছে তাদেরও মাথা নত করতে হয়েছে। পাকিদের সেই গ্লানি আজও তাদের তাড়া করে। নানাভাবে প্রতিহিংসা চালানোর চেষ্টায় বাংলার মানুষের ওপর। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বিবৃতি দেয়। তাদের রক্ষা করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর বাঙালী জাতির চেতনায় পাকিদের ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হচ্ছে পাকি দোস্তদের। গোটা জাতি এখন পাকিদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করার দাবি তুলেছে। এই চেতনাকে ধারণ করে সশস্ত্র বাহিনী নানা কর্মসূচী পালন করেছে। পাকিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রসহ আধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম প্রদর্শনীও হয়েছে। জনসাধারণের জন্য এগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল। প্রদর্শনীতে আশা দর্শনার্থীদের মুখে ফিরছিল ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা-কারো দানে পাওয়া নয়’। অনেক রক্তের বিনিময়ে এ বাংলা এখন বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একটি লাল সবুজের পতাকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওড়ছে। সশস্ত্র বাহিনীর সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল। বিজয় সরণীর পাশে সামরিক যাদুঘরে ট্যাঙ্ক, কামান, যুদ্ধ বিমানসহ নানা ধরনের অস্ত্রের প্রদর্শনী জনসাধারণের জন্য সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুর ওপর ছবি প্রদর্শনীও হয়েছে। পাকিদের বর্বরতার ছবিও সেখানে স্থান পেয়েছিল। প্রদর্শনীতে আসা মানুষের কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ জাতীয় সঙ্গীত শোনা যাচ্ছিল। আকাশে বাতাসে মুক্তির স্বাদ নিয়ে মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করে দিয়েছে বহু মূল্যে কেনা স্বাধীনতার প্রদীপখানি অনন্ত জ্বলছে। প্রভাত আলোর মিলনমেলা থেকে বিকেল পর্যন্ত মানুষের এ ঢল স্বাধীনতার চেতনার মানুষের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে তুলেছে। সামরিক অস্ত্রের পাশে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ‘সেলফিও’ তুলেছে। পাকিদের হটিয়ে দেয়া অস্ত্রের গায়ে হাত রেখে অনেকে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। বাংলার মানুষ যে পরাধীন নয় সেই চেতনাই প্রতিফলিত হয়েছে মহান বিজয় দিবসে। কোটি কোটি মানুষের মাঝেও কিছু পাকিপন্থীর বুকে এ দিবসটি বুকে জ্বালা ধরালেও তারা যে পরাজিত শক্র সেই কথাও উঠে এসেছে প্রাণে প্রাণে। গোটা দেশজুড়েই বিভিন্ন সামরিক ঘাটিতে সমরাস্ত্র প্রদর্শনী হয়েছে। দেশের সব অঞ্চলেই মানুষের স্রোত ছিল চোখে পড়ার মতো। মহান বিজয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদা ও উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে উদ্যাপিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ঢাকা পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় একত্রিশ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হয়। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এই অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক তাদের গার্ড অব অনার দেয়া হয়। সকাল সাড়ে দশটায় জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে বিজয় দিবস কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন। কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও তিন বাহিনী প্রধানগণ উপস্থিত থেকে রাষ্ট্রপতিকে অভ্যর্থনা জানান। কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ, সংসদ সদস্যগণ, উর্ধতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং বৈদেশিক কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। এবারের বিজয় দিবস কুচকাওয়াজে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর লে. জেনারেল ভিষ্ণু কান্ত চতুরভেদীর (অব) নেতৃত্বে ২৭ বীরযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন। এই মহান বীরসেনানীরা স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে দেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিলেন। সেই বীরদের সম্মান জানানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশনের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত বিজয় দিবস কুচকাওয়াজে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ, সশস্ত্রবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অংশগ্রহণ করে। এবারের কুচকাওয়াজে নতুনভাবে সংযোজিত ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মহিলা কন্টিনজেন্ট। কুচকাওয়াজে ২০০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১২০ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট একটি বৃহৎ জাতীয় পতাকা প্রদর্শিত হয়। বিজয় দিবস প্যারেড-২০১৫ এর অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৯ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং এবং এরিয়া কমান্ডার, সাভার এরিয়া, মেজর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। কুচকাওয়াজের যান্ত্রিক বহরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সংবলিত সুসজ্জিত গাড়িবহর প্রদর্শিত হয়। এছাড়া সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপারগণ আকাশ থেকে অবতরণ করে কুচকাওয়াজ আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। বিভিন্ন যান্ত্রিক বহরের প্রদর্শনীর পরই শুরু হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর মনোজ্ঞ ফ্লাইপাস্ট ও এ্যারোবেটিক ডিসপ্লে। কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ অন্যান্য বেসরকারী টেলিভিশন এবং রেডিও চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করেছে। এবারের প্যারেড বিভিন্ন আঙ্গিকে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন ও প্যারেডকে উপভোগ্য করতে সার্বিক সাজসজ্জায় নতুন মাত্রা যোগ করা হয়েছিল। বিজয় দিবস কুচকাওয়াজ উপলক্ষে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারসহ প্যারেড গ্রাউন্ডে আসার পথে সড়কগুলোতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় দিবসের চেতনা সংবলিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যানার ও বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়। মহান বিজয় দিবস কুচকাওয়াজ সুষ্ঠু ও সার্থক করতে গণপূর্ত অধিদফতর, পিডিবি, ঢাকা ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন, টিএ্যান্ডটি, ডেসকো, জনস্বাস্থ্য অধিদফতর, পিডব্লিউডি, গণযোগাযোগ অধিদফতর ও স্থাপত্য অধিদফতর নিরলসভাবে কাজ করে। কুচকাওয়াজ শেষে রাষ্ট্রপতি প্যারেডে অংশগ্রহণকারী সকল কন্টিনজেন্ট কমান্ডারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। মহান বিজয় বিদস উপলক্ষে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সেনাবাহিনী, সদরঘাট এলাকায় নৌবাহিনী এবং মিরপুর ২নং স্টেডিয়ামে বিমানবাহিনীর বাদক দল দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বাদ্য পরিবেশন করেন। এছাড়াও সেনাসদরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ২টা হতে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বাদক দল বাদ্য পরিবেশন করে। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে নৌবাহিনীর নির্ধারিত জাহাজসমূহ ঢাকার সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জের পাগলা নেভাল জেটি, চট্টগ্রামের নিউমুরিং-এর নেভাল জেটি, খুলনার বিআইডব্লিউটিএ রকেট ঘাঁট, বাগেরহাট মংলার দিগরাজ নেভাল বার্থ এবং বরিশালের বিআইডব্লিউটিএ জেটি রকেট ঘাঁট-এ সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য বেলা ২টা হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উন্মুক্ত রাখা হয়।
×