ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ আবদুল কুদ্দুস

বাঙালীর বিজয় দিবস

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫

বাঙালীর বিজয় দিবস

বিজয় শব্দটি বেশ মধুর। খাঁটি সোনার চাইতেও খাঁটি। বিজয় শব্দটি কানে প্রবেশ করলে আনন্দে মাতোয়ারা হয় না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। বিজয়ের সংবাদ হৃদয়হীনের হৃদয়ও স্পর্শ করে। দুর্বল মানুষের মনেও জাগ্রত করে শিহরণ। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালী পেয়েছে এমনই এক মহান বিজয়ের স্বাদ। লাখো প্রাণ ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাঙালী জাতির মহান স্বাধীনতা এখন স্থান করে নিয়েছে দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে-ঘরে। কৃষকের চাষাবাদে, কৃষাণীর নকশীকাঁথার ফোঁড়ে, কবির কবিতায়, চিত্রশিল্পীর রং তুলিতে, কণ্ঠশিল্পীর গানের সুরে, অভিনয় শিল্পীর অভিনয়ে, অফিসে কর্মকর্তা কর্মচারীদের ব্যস্ততম সূক্ষ্ম কাজে সব জায়গায় আজ বিজয়ের একচ্ছত্র অধিকার। বিজয় দিবস এখন বাঙালী তথা সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের একটি প্রাণের উৎসবের দিন। বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আজ দেশের সমস্ত মানুষ তাদের ঘরে-ঘরে আয়োজন করে নতুন নতুন বাহারি খাবার। পরিধান করে লাল সবুজের পতাকা সমেত শাড়ি-পাঞ্জাবি। এদিন কোন কারণে কারও মন খারাপ থাকলে বাঙালী একে অপরকে স্মরণ করে দেয় যে, আজ মন খারাপ করতে নেই, আজ আমাদের বিজয় দিবস। আনন্দ উল্লাস আজ আমাদের উৎসব। শিশু থেকে শুরু করে তরুণ এমনকি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তাদের গালে লাল সবুজের পতাকা এঁকে পুষ্পস্তবক অর্পণের জন্য শহীদ মিনারে যায়। শ্রদ্ধাভারে বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীরা বিকেলে যান পার্কের বিজয় মেলায়, আনন্দে বিনোদন উৎসবে যোগ দেন সবান্ধবে। বিজয় দিবসের সকালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত চৌকস দল মাঠে-মাঠে প্যারেডে অংশগ্রহণ করে। রাস্তাঘাটে নানা সেøাগান লিখিত ব্যানার ধরে র‌্যালি, খেলার মাঠে শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের জন্য বৈচিত্র্যময় নানান খেলার আসরে মনের আনন্দে বেজে উঠে বাদ্য ও বাজনার সুর। মাইকে মাইকে বাজানো হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। আয়োজন করা হয় নানা সভা সেমিনার। সভা সেমিনার শেষে দেশাত্মবোধক গানের সুরে মেতে উঠে তরুণ-তরুণীরা। পুলকিত হয় বাংলার আকাশ বাতাস। বিজয়ের আনন্দের স্বাদে মনকে রাঙিয়ে দিতে এখন দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে মঞ্চ সাজিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন যেন চোখে পড়ার মতো। সার্বিক বিচারে তাই বলা চলে, বিজয় আমাদের অহঙ্কার। তরুণদের অনুপ্রেরণার প্রতীক। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়ার এক শক্ত হাতিয়ার। মহান বিজয় দিবসের মাহাত্ম তুলে ধরে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে শিরোনাম করা হয়েছিল ‘রাহুমুক্ত বাংলাদেশ’। তাতে বিজয়ের তাৎপর্য তুলে ধরা ধরা হয়েছিল এভাবে- ‘বাংলাদেশ শান্ত। তার সব রণাঙ্গন স্তব্ধ। জওয়ানদের শাণিত অসি কোস বদ্ধ। তাদের কামানের মুখ থেকে আর মৃত্যু বেরিয়ে আসবে না। মুক্তি বাহিনীর রণ-হুঙ্কারে আর পাক দুশমনদের বুক কেঁপে উঠবে না। নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করেছে লে. নিয়াজী। যারা এতদিন বাংলাদেশে চালিয়েছেন গণহত্যা এবং নারী ধর্ষণ, তারা ভুলণ্ঠিত। মার্কিন সপ্তম নৌবহর রক্ষা করতে পারেনি তাদের। জওয়ান এবং মুক্তিযোদ্ধারা মানুষমারা যন্ত্র নয়। গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠায় নেমেছিল তারা লড়াইয়ের ময়দানে। তাদের বিজয় সম্পূর্ণ। দখলদার বাহিনীর হৃদপিন্ড ঢাকা আজ রাহুমুক্ত।... কোথায় আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান? ইসলামাবাদের নিষ্ঠুর করাগারে বসে তুমি কি দেখতে পাচ্ছ তোমার সাধের বাংলাদেশে নব সূর্যোদয়? যে ঢাকা থেকে ইয়াহিয়া সৈন্যরা তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। সে ঢাকা আজ স্বাধীন। তার প্রাসাদগুলোর শীর্ষে উড়ছে জয় বাংলার পতাকা। তোমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য গোটা বাংলাদেশ আজ পাগল।’( বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস, চতুর্থ খ- তৃতীয় পর্ব, পৃ.নং-৪০৫) সত্যিই বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। এদেশের প্রতিটি প্রাসাদে সত্যি সত্যিই উড়ছে আজ জয় বাংলার পতাকা। শুধু প্রসাদে নয়, বৃষ্টি-বাদলে নুয়ে পড়া জীর্ণ কুটিরেও পতপত করে উড়ছে বাঙালীর স্বপ্নের পতাকা। বিজয়ের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বাংলার তরুণ দামাল ছেলেরা ঘরে-ঘরে গড়ে তুলছেন তথ্যপ্রযুক্তির দুর্গ। আমার দেশের তুরুণরা লাখো কণ্ঠে গেয়েছেন সোনার বাংলার জাতীয় সঙ্গীত। এবার অপেক্ষায় আছেন তারা বিজয়ের সেই সোনালি লগ্ন বিকেল ৪.৩১ মিনিটের দিকে। এবারে অপেক্ষা কোটি কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজী ঢাকায় তাঁর সৈন্যদের নিয়ে উপযুক্ত সময়েই বিজয়ের পতাকা বাঙালীর হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বাধীন দেশের মানুষ নিজেদের ইচ্ছা আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়নও করছে স্বাধীনভাবে। লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে গঠিত এই বাংলাদেশে মানুষ তাদের ধর্মকর্মও পালন করছে স্বাধীনভাবে। এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ির এই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রসদে ভরপুর। এদেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা ও সেবা এখন দূর গ্রামে বসে অনায়াসে ভোগ করা যায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে নিজস্ব অর্থায়নে আজ তৈরি হচ্ছে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ও অত্যাধুনিক পদ্মা বহুমুখী সেতু। এদেশের বিজ্ঞানীরা দেশে-বিদেশে রেখে চলেছেন অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর। বাংলার তরুণ সমাজ আজ নাম লিখিয়েছেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ সাতটি পর্বত জয়ের জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে। বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন সারা ক্রিকেট দুনিয়ার বিস্ময়। বর্ষসেরা ক্রিকেটার, আইসিসি অল রাউন্ডার ও বিশ্ব চিন্তাবিদের শীর্ষদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন আমার দেশেরই কৃতী সন্তানরা। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বিদেশে শান্তি রক্ষা মিশনে শ্রেষ্ঠত্বের স্থান করে নিয়েছেন। বাংলার ধুলোবালি সঙ্গী করে বেড়ে উঠা আমার দেশের নারীরা বিশ্বের নানা রাষ্ট্রের আইন সভার নির্বাচিত সদস্য হয়ে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছেন। বাঙালীর শ্রেষ্ঠত্বের এ উৎসব যেন বিজয়ের মহোৎসব। বাঙালী এ বিজয় উৎসসবের স্রোতে অচিরেই ভেসে যাবে দেশী-বিদেশী সব ষড়যন্ত্র। বিজয়ের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে এদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে জঙ্গীবাদের শেকড় চিরতরে উপড়ে ফেলবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কোটি বাঙালীর বিজয় উৎসবের শামিল হয়ে ২০২১ সালে এদেশ সোনার বাংলাদেশ নামক উচ্চ মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। জয় হোক শান্তি কামনা সব মানুষের। লেখক : শিক্ষাবিদ
×