ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তার বেতারবার্তায় জাতি প্রথম রাজারবাগে পুলিশের ওপর আক্রমণের খবর জানতে পেরেছিল

ওয়্যারলেস অপারেটর শাহজাহানের যুদ্ধদিনের কথা ॥ একাত্তরে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

ওয়্যারলেস অপারেটর শাহজাহানের যুদ্ধদিনের কথা ॥ একাত্তরে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ। ভয়াল কালরাত্রি। সেদিন আক্রমণের খবর আসে আগে ভাগেই। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সদস্যরাও তখন প্রতিরোধের নিশানা তৈরি করছিল। পাকসেনাদের অস্ত্রসজ্জিত একটি গাড়ি শান্তিনগর পেরিয়ে সামনে এগোচ্ছিল। চামেলীবাগের ‘ডন’ হাইস্কুলের ছাদে ওঁৎ পেতে ছিল সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা। বর্তমানে এখানটাই ইস্টার্ন প্লাস মার্কেট। স্কুলের সামনে একটি ব্যারিকেড দেয়া ছিল। তা ভেঙে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় বাঙালী পুলিশ সদস্যের ছুঁড়ে দেয়া প্রথম বুলেটটি আঘাত করে এক পাকি সৈনিকের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সৈনিকটি। আহত হন কয়েকজন। ... ওপর থেকে ছোঁড়া সেই বুলেটটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ বুলেট। জবাবে গর্জে ওঠে পাকসেনাদের ট্যাংক। মুহূর্তের মধ্যে রাজারবাগ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশ স্টেশনের ওয়্যারলেস কক্ষে বসে তখন অপারেটর শাহজাহান উত্তেজনায় কাঁপছিলেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ রাজধানী ঢাকা আক্রান্ত হওয়া এবং বাঙালী পুলিশ সদস্যদের প্রতিরোধের বার্তা বেতার মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দেন তিনি। ওয়্যারলেসে জরুরী বার্তা পেয়ে সারাদেশে পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলে প্রতিরোধ। রাজারবাগের সেই যুদ্ধে ১৫০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য শহীদ হন। সেদিনের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একজন শাহজাহান মিয়া এখনও বেঁচে আছেন। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে খবর ছড়িয়ে দেয়ার অপরাধে পাকিস্তানী সেনাদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। বারবার তাঁকে রক্তাক্ত করা হয়েছে। তবুও প্রাণে বেঁচে গেছেন তিনি। পরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। এখন একদিকে বয়সের চাপ, অর্থকষ্ট আর শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও দেশ নিয়ে ভাবেন তিনি। শেষ জীবনে সহযোদ্ধা ৩১ জনের মধ্যে জীবিত ২৪ জন বীরত্বের রাষ্ট্রীয় খেতাব দেখে যেতে চান এই মুক্তিযোদ্ধা। জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, জীবনে চাওয়া-পাওয়ার আর তেমনি কিছুই নেই। একটি শিক্ষিত ও উন্নত জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব এখন সেই স্বপ্ন দেখি। তাঁর প্রত্যাশা, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যেন কখনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ঘায়েল করতে না পারে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশে তাঁরা যেন রাজনৈতিকভাবে কোন দিনই প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে। তাদের গাড়িতে আর না ওঠে লাল-সবুজের পতাকা। মায়ের মতো করেই সবাই যেন দেশকে ভালবাসেন এই আহ্বান মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান মিয়ার। বিজয়ের গল্প বলতে গিয়ে শাহজাহান মিয়া বলেন, ’২৫ মার্চ রাত আনুমানিক দশটার সময় আমরা তেজগাঁও শিল্পনগরী এলাকা থেকে একটি ওয়্যারলেস মেসেজে প্রথম জানতে পারি পাকসেনারা এদিকে আসছে। বলল, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পাক আর্মি ঢাকা আক্রমণ করবে। এই মেসেজ পাওয়ার পরপরই আমাদের সিপাহী আবদুল আলী পাগলা ঘণ্টা বাজালো। সেই ঘণ্টা শুনে যে যেখানে ছিল ছুটে আসতে থাকে অস্ত্রাগারের দিকে। শতাধিক পুলিশ সদস্য অস্ত্রাগারের সামনে জড়ো হন। প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করতে তারা অস্ত্রের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। অস্ত্রাগার তালাবদ্ধ দেখে কয়েকজন চাবির জন্য ছুটে যান রিজার্ভ ইন্সপেক্টর মফিজুদ্দিনের বাসায়। সেখানে গিয়ে দেখেন মফিজুদ্দিন আগেই পরিবার নিয়ে পালিয়ে গেছেন। প্রথমে দায়িত্বরত সেন্ট্রির কাছে থাকা রাইফেল দিয়ে গুলি করে তালা ভাঙার চেষ্টা চলে। শেষপর্যন্ত শাবল দিয়ে তালা ভেঙে সবাই অস্ত্র আর গুলি নিয়ে একত্র হন ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডের সামনে। এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন মর্তুজাসহ বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে নিয়ম অনুযায়ী স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকাকে স্যালুট করে পুলিশ সদস্যরা ছুটে যান। অবস্থান নেন সুবিধাজনক স্থানে। শাহজাহান মিয়া বলেন, রাত আটটার দিকে আমরা বিভিন্ন সোর্স থেকে আক্রমণের খবর পেতে থাকি। প্রথম সংবাদটা পেয়েছিলাম আমি। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলের কাছে। তিনিই প্রথম আমাকে খবর দেন। দ্বিতীয় সংবাদটি বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের কাছে পাই। তিনি সেদিন রাজারবাগ এসেছিলেন মোটরসাইকেল নিয়ে। পাকবাহিনীর আক্রমণের খবর দিতে। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যেসব স্থানে প্রথম আক্রমণ চালায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন তারই একটি। আর এখান থেকেই প্রায় ছয় শতাধিক বাঙালী পুলিশ সদস্যরা প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন প্রায় এক হাজার ২০০ পাকিস্তানী সেনা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ রাজধানীর বিভিন্নস্থানে হামলা চালায়, তখন শাহজাহান সেখানে দায়িত্বরত ছিলেন। বিলম্ব না করে এ বর্বর হামলার খবর সারাদেশে বেতার বার্তার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। শাহজাহান মিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাত্র এক বছর আগে তিনি কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বেতার অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। হামলার সংবাদ বেতারের মাধ্যমে সারাদেশের পুলিশ স্টেশনগুলোতে জানিয়ে দেয়ায় কয়েক ঘণ্টা পর ২৬ মার্চ ভোর পাঁচটার দিকে চারতলা ভবনের ছাদ থেকে তাঁকে আটক করে এবং ২৮ মার্চ পর্যন্ত বন্দী করে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। বন্দী অবস্থায় রাজারবাগের বয়-বাবুর্চিরাও ছিলেন। তাদের একজন অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে পানির জন্য চিৎকার করছিলেন। কিন্তু পাষাণ পাকসেনাদের মন গলেনি। এক পর্যায়ে সবার দাবির মুখে ছেলেটিকে আড়ালে নিয়ে পানির পরিবর্তে মুখে প্রস্রাব করে দেয় এক পাকি সৈনিক। কেউ নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাননি। তিনি জানান, বেলুচ ও পাঞ্জাব রেজিমেন্টের পাকিস্তানী সেনারা ট্যাংক, কামান, মর্টার শেল, মেশিনগানসহ ভারি অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করেছিল। আমাদের প্রতিরোধের একমাত্র অস্ত্র ছিল থ্রি নট থি রাইফেল। তিনি জানান, রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পুরো পূর্বপাকিস্তানের সকল বিভাগ ও জেলা শহরের পুলিশ স্টেশনগুলোতে পাঠানো বার্তায় ছিল, ‘বেস ফর অল স্টেশন্স অব ইস্টপাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেনিং ওয়াচ, উই আর অলরেডি এ্যাটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেল্ভস, ওভার।’ তিনি জানান, ১১ থেকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত পাকবাহিনী পুলিশ লাইন দখল নিতে পারেনি। তারপর আরও অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সৈন্য আনে তারা। এক পর্যায়ে পুলিশ লাইনের টিনশেডের ঘর গানপাউডারে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ লাইনের উত্তর ও দক্ষিণের দুটি গেট ট্যাংকের সাহায্যে ভেঙে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করে পুলিশ সদস্যদের ওপর। তখন সবাই আস্তে আস্তে পিছু হটতে থাকে। শাহজাহান মিয়া বলেন, ২৮ মার্চ বিকেল তিনটার দিকে তাকে পাকিস্তানী বাহিনী ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে ২৯ মার্চ মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনে যান। সেখানে যাওয়ার পথে সূত্রাপুর লোহারপুলের পাশের খালে নারী-পুরুষসহ অসংখ্য মানুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে শহীদ এসব মানুষের অনেকের লাশই তখন পচে ফুলে উঠেছিল। মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনে গেলেও সেখানকার পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তারা তার নিরাপত্তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে পরদিন ৩০ মার্চ বন্ধু কনস্টেবল শেখ আশেক আলীসহ গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার উদ্দেশে তিনি বের হয়ে পড়েন। হেঁটে নেত্রকোনা পৌঁছাতে তাদের সময় লেগেছিল চারদিন। বাড়িতে গিয়ে নিজের চিকিৎসা করান শাহজাহান মিয়া। পাঁচ-ছয়দিন বাড়িতে থেকে ছোট ভাই নুরুল ইসলাম নুরুসহ ভারতে চলে যান। ভারতে গিয়ে কয়েক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার দেশে এসে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এ সেক্টরের অধীন ধর্মপাশা, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও হালুয়াঘাট এলাকায় অসংখ্য সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তিনি। মিত্র বাহিনীর মেজর প্রীতের নেতৃত্বে ৬ ডিসেম্বর দুর্গাপুর থানার বিজয়পুর বিওপি আক্রমণের সময় মাইন বিস্ফোরণে তিনি গুরুতর আহত হন। তার ছোট ভাই নুরুর মুখম-ল সম্পূর্ণ ঝলসে যায়। সহযোদ্ধা ওসমান গনির একটি পা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর ২১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে তখনকার ইপিআর সদর দফতরে গিয়ে তাদের কাছে থাকা অস্ত্র জমা দেন শাহজাহান মিয়া। এর দুদিন পর ২৩ ডিসেম্বর আবার চাকরিতে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য শাহজাহান মিয়াকে পরে বিভাগীয় সাব-ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পুলিশ বাহিনী ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট থেকে তাকে আজীবন সম্মাননা দেয়া হয়। পুলিশের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়ার শেষ আবদার রাষ্ট্রীয় খেতাব পাওয়া। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার বাট্টা বড়বাড়ি গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান মিয়ার জন্ম। বর্তমানে তিনি একই উপজেলার চিংড়া বাজারে বসবাস করছেন। হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন তিনি। আর্থিক অনটনে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও হচ্ছে না। একাত্তরের বীরত্বগাঁথা তুলে ধরতে মাঝে মাঝে সংবাদ মাধ্যম ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে রাজধানীতে আসেন। কিন্তু অর্থ সঙ্কটে ভাল ডাক্তার দেখাতে পারছেন না। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য অনেকেই রাষ্ট্রীয় খেতাব পেয়েছেন। সেদিনের যুদ্ধে অংশ নেয়া তিনিসহ জীবিত ২৪ জনকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করলে জীবনে চাওয়া- পাওয়ার আর তেমন কিছুই থাকবে না। শাহজাহান মিয়াসহ পুলিশের আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধার ঐকান্তিক আগ্রহ মূল্যায়ন করে ২০১৩ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। ’৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে পুলিশের প্রথম প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সাহসিকতা আর ত্যাগের কথাই এখন এই জাদুঘরের মাধ্যমে জানছে বর্তমান প্রজন্ম।
×