ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রক্ষা পাবে বসতভিটা আবাদি জমি

যমুনার ভাঙ্গন রোধে ॥ এবার বড় প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৬ নভেম্বর ২০১৫

যমুনার ভাঙ্গন রোধে ॥ এবার বড় প্রকল্প

সমুদ্র হক ॥ উজান থেকে ভাটি পর্যন্ত যমুনার ভাঙ্গন রোধে দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নদীর তীর সংরক্ষণের ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি এলাকায় যমুনার ডান তীরে যে জায়গাগুলোতে যমুনা নিত্য বছর তেড়ে এসে বসতভিটা, জমি-জিরাত কেড়ে নেয়, সেসব এলাকার ওপর দিয়ে শক্ত কাঠামো গড়ে তোলা হবে। এ জন্য ব্যয় হবে ৩শ’ কোটি টাকারও বেশি। এ বছর আগস্টে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বিশেষ এই প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছে। আশা করা হয়েছে চলতি অর্থবছরেই যমুনা তীরের সারিয়াকান্দিতে বৃহৎ এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। সূত্র জানায়, ১২ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দিনের বগুড়া সফরে শহরের আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে জনসভায় এই প্রকল্প কাজের ভিত্তিফলক উন্মোচন করবেন। প্রসঙ্গত তীব্র ভাঙ্গনপ্রবণ যমুনা তীর ভেঙ্গে ক্রমেই পশ্চিমে বাঙালীর নদীর কাছে ঠেকছে। দুই নদী একত্রিত হলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের মতোই হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে যমুনা তীরের কয়েক লাখ মানুষের বসতভিটা, জমি-জিরাত রক্ষা পাবে। উল্লেখ করা যায়, বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় ১৯৯৮ সালে ভাঙ্গন রোধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে ৫শ’ ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে হার্ড পয়েন্ট ও প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রিভেটমেন্ট নির্মিত হয়। বলা হয়, এই শক্ত কাঠামোর ক্ষতি হবে না। তারপরও ধসে যায়। ভাঙ্গন রোধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ না হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডিজাইনে ত্রুটি মেলে। বলা হয়, যমুনা একমাত্র নদী যার স্রোতের গতি কখন, কোন্ দিকে যায় তা অনুমানও করা যায় না। যমুনাকে বশেও আনা যায় না সহজে। মেয়েদের চুলের বেণির মতো এঁকেবেঁকে চলা এই নদীকে বশে এনে ভাঙ্গন প্রতিরোধে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। ক’বছর ধরে তীর সংরক্ষণের নকশাবিদ স্যাটেলাইট ইমেজ প্রকৌশলীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে এনেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই অঞ্চল সম্পর্কে অবহিত থাকায় প্রকল্পটি অগ্রাধিকার পেয়ে অনুমোদিত হয়েছে। এখন তা বাস্তবায়নের পালা। সূত্র জানায়, কর্নিবাড়ি কুতুবপুর রহদহ কামালপুর এলাকায় যমুনার ডান তীরে ব্রহ্মপুত্র রিভার ইমব্যাঙ্কমেন্ট (বিআরই) বিকল্প বাঁধ নির্মাণ, অন্তরপাড়া দড়িপাড়া এবং পার্শ¦বর্তী এলাকায় যমুনা ডান তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংরক্ষণ কাজ, কর্নিবাড়ি থেকে চন্দনবাইশা পর্যন্ত যমুনার ডান তীর সংরক্ষণ কাজ বিকল্প বাঁধ নির্মাণ এই প্রকল্পের মধ্যে আলাদাভাবে রয়েছে। ফলে প্রকল্পটি শক্ত কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের খবরে নদী তীর ও চরগ্রাম এলাকার মানুষ আশান্বিত হয়েছে। সূত্র জানায়, কয়েকটি গবেষণার ফলাফল নিয়ে নদী তীর সংরক্ষণের এই প্রকল্পটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে স্রোতের গতি মাঝপথেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। যমুনার স্রোত সামান্যতেই ব্যাকফ্লো করে তীব্র গতিতে সম্মুখপানে যায়। প্রকৌশলীরা স্যাটেলাইট ইমেজে গভীরতা ও বেড লেভেল (নদী শয্যা) পর্যালোচনা করে নক্সা বানিয়েছেন যাতে মূল জায়গাটিতে প্রোটেকশন দেয়া যায়। এভাবেই সারিয়াকান্দির কর্নিবাড়ি থেকে চন্দনবাইশা পর্যন্ত ৫ দশমিক ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ রিভেটমেন্টের আদলে শক্ত কাঠামো নির্মিত হবে। ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩শ’ ২ কোটি টাকা। দু’বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ২০১৭ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ মূল বাঁধকে সংযুক্ত করে জিও ব্যাগ ও সিসি ব্লক থেকেও উন্নত আধুনিক নির্মাণ শৈলীতে তীর সংরক্ষণ করা হবে। পূর্বের রিভার ব্যাংক প্রোটেকশন প্রজেক্টের (আরবিপিপি) ভুলত্রুটিগুলো চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করে প্রকল্প সফলের কাঠামো তৈরি করা হয়েছে যাতে ভাঙ্গন প্রতিরোধ চিরস্থায়ী হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রের খবর- প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। তবে ভূমি অধিগ্রহণে যাতে বেশি ক্ষতি না হয় সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখা হবে। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের গুচ্ছগ্রাম বানিয়ে যেভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল এ ক্ষেত্রেও প্রয়োজনে তাই করা হবে। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে উপযুক্ত মূল্য পায় সেদিকেই আগে দৃষ্টি দেয়া হবে। সূত্র জানায়, দীর্ঘ সময় পর এ অঞ্চলে ভাঙ্গন প্রতিরোধে এটাই বড় প্রকল্প। এ অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও যমুনার ভাঙ্গন প্রতিরোধে ষাটের দশক থেকেই একের পর এক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। পঞ্চশের দশকে প্রথমে ব্রিটিশ ক্রুগ মিশন জরিপ করে রিপোর্ট দেয়। তা বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীর বরাবর উজানের রংপুরের কাউনিয়া থেকে ভাটির পাবনার বেড়া পর্যন্ত ২শ’ ২০ কিলোমিটার মাটির বাঁধ নির্মিত হয়। স্থানীয়ভাবে তা ওয়াপদা (তৎকালীন ওয়াটার এ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) বাঁধ নামে পরিচিতি পায়। আজও প্রবীণরা এই নামেই ডাকে। মূল এই বাঁধ ভাঙতে ভাঙতে এমন পর্যায়ে এসেছে যে, সেদিনের সেই বাঁধের অস্তিত্ব আর নেই। একের পর এক রিং বাঁধ, নতুন বাঁধ, স্পারসহ নানা কাঠামো তৈরি হয়ে সবই বিফলে যায়। যমুনাকে নিয়ন্ত্রণ করাই যায় না। এদিকে নদী ভাঙ্গনের থাবা বেড়ে গিয়ে এমনই অবস্থা বসতভিটা, জমি-জিরাত হারিয়ে কত গৃহস্থ ও বড় কৃষক দিনমজুরে পরিণত হয়েছে তার হিসাব নেই। নিত্য বছর গ্রাম-গঞ্জ অবকাঠামো ফসলের মাঠ যমুনা গর্ভে যাচ্ছে। ভিটে হারিয়ে কত মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে ভিন গাঁয়ে। হয়ে পড়ছে ভূমিহীন বাস্তুহারা। সুদূরপ্রসারী ভাবনায় সবকিছুই বিশ্লেষণ করে বিরাট এক এলাকাকে রক্ষা করতে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকার বড় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
×