ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দীপন হত্যা সম্পর্কে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য

একই জিহাদী গুপ্ত ঘাতকচক্র এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:০১, ৪ নভেম্বর ২০১৫

একই জিহাদী গুপ্ত ঘাতকচক্র এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে

শংকর কুমার দে ॥ প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে যেই জিহাদী গুপ্ত ঘাতক গ্রুপটি হত্যা করেছে, সেই গ্রুপটির দিকেই প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন খুন ও অপর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, ব্লগার তারেক রহিম ও লেখক রণদীপম বসুকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় আবার সন্দেহের তীর। এই গ্রুপটি মাদ্রাসা ভিত্তিক উগ্র জিহাদী গুপ্ত ঘাতক চক্র। তারপরও জিহাদী গুপ্তঘাতক বিষয়ক নানা প্রশ্নের হিসাব-নিকাশ মেলাতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে নানা প্রশ্ন তোলা হয়েছে যার মধ্যে আছে, জিহাদী গুপ্ত ঘাতক দলের সদস্য নিয়ে। তারা সংখ্যায় কত? তাদের প্রকৃত পরিচয় ও পরিচালনায় আছে কারা ? হত্যাকা-ের পর তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে কিভাবে? হত্যাকা-ের আগে ও পরে তারা অবস্থান করে কোথায়? তাদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না কেন? দু’একজন ধরা পড়লেও তাদের সহযোগীদের শনাক্ত করে ধরতে বাধা কোথায়? তাদের অর্থায়নই বা করছে কারা? এসব প্রশ্নের সঠিক সমাধান করতে না পারায় তদন্তের গভীরে যেতে পারছেন না তদন্তকারীরা। মাঝ পথেই তদন্ত থেমে যাচ্ছে। মাঝখানে বিরতি দিয়ে একের পর এক প্রগতিশীল প্রকাশক, লেখক ও ব্লগার খুন করে যাচ্ছে জিহাদী গুপ্ত ঘাতকরা। গোয়েন্দা সংস্থার যে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুর দুই খুনী জিকরুল্লাহ ও আরিফুল খুনে ব্যবহৃত চাপাতিসহ হাতে নাতে ধরা পড়ে ঘটনাস্থলেই। তাদের একজন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা ও অপর একজন মিরপুর মাদ্রাসার ছাত্র বলে পরিচয় দেয় তারা। রাজধানীর তেজগাঁও দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে বাবুকে খুনের পর খুনীরা যখন দৌড়ে পালাচ্ছে তখন লাবন্য নামের এক হিজড়া জীবন বাজি রেখে দুই খুনীকে ঝাপটে ধরে ফেলে। দুই খুনী আটক হলেও তাদের সহযোগী আবু তাহের পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারপর দুই খুনীকে পুলিশে সোপর্দ করা হলে তাদেরকে কয়েক দফায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে মাছুম নামের একজন তাদের নির্দেশদাতা আছেন। গত ৩০ মার্চ বাবু খুন হওয়ার পর দীর্ঘ সাত মাসেও হাতে নাতে ধরা পড়া দুই খুনীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী অনুযায়ী সহযোগী আবু তাহের ও মাছুমকে গ্রেফতার করা যায়নি। শুধু তাই নয়, ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যার জন্য প্রথম দফায় চেষ্টা করেন গত ২৪ মার্চ। পাঁচজনে মিলে যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে তেজগাঁওয়ের উদেশে রওনা দেয় তারা। কিন্তু যাত্রাবাড়ীর পুলিশ চেকপোস্টে চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ ধরা পড়ে সাইফুল নামের এক সহযোগী। তারপর তারা ফিরে যায় যাত্রাবাড়ী এলাকার কাজলার বাসায়। তারপর ৩০ মার্চে দলনেতা মাসুম (বড় ভাই), আবু তাহের, জিকরুল্লাহ ও আরিফ-এই চারজনে যায় তেজগাঁও বেগুনবাড়িতে। খুন করে ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। এর মধ্যে সরাসরি খুনে অংশ গ্রহণকারী দুই জন জিকরুল্লাহ ও আরিফ ধরা পড়ে। পালিয়ে যায় আবু তাহের। দলনেতা বড় ভাই মাসুমও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ধরা পড়া দুই জন জিকরুল্লাহ ও আরিফকে রিমান্ডে এনে তাদের নাম ঠিকানা জানা সত্ত্বেও ধরা সম্ভব হয়নি। প্রগতিশীল প্রকাশক, লেখক ও ব্লগার খুনের জন্য হাতে নাতে ধরা পড়া দুই খুনী জিকরুল্লাহ ও আরিফুলের সঙ্গে আরও কত জন জিহাদী গুপ্ত ঘাতক আছে, তাদের পরিচয় কি, কিভাবে তাদের রিক্রুট করেছে কারা ইত্যাদি নানা প্রশ্নের বিষয়ে বিস্তারিত ও ব্যাপক তদন্তের গভীরে যেতে পারেনি তদন্তকারীরা। গোয়েন্দা সূত্র বলেছেন, ওয়াশিকুর হত্যাকা-ের একমাস আগে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মোড়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি দুর্বৃত্তরা পেছন থেকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিত রায়কে। এ সময় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন। এই হত্যাকা-ের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় ফারাবীকে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের জানাজা পড়ানোয় ইমামকে হত্যার হুমকি দিয়েও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ফারাবী। ফারাবি ‘নাস্তিকদের’ হত্যাকা-ের বিষয়ে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলা হয়, ‘আমার দৃষ্টিতে নাস্তিকরা হচ্ছে, পোকামাকড় আর পোকামাকড়দের মরে যাওয়াই ভাল।’ অভিজিত রায় হত্যায় গ্রেফতার হয়ে সে এখন কারাবন্দী। অভিজিত রায় হত্যাকা-ের তদন্তে সহায়তা করতে এফবিআইয়ের (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) একটি দলও বাংলাদেশে আসে। তারাও এখন পর্যন্ত খুনীদের শনাক্ত করতে পারেনি। সন্দেহ করা হচ্ছে, ওয়াশিকুর ও রহমান বাবুকে যেই জিহাদী গুপ্ত ঘাতক চক্রটি হত্যা করেছে, তারাই এর আগে অভিজিত রায়কেও হত্যা করেছে। তারাও মাদ্রাসা ভিত্তিক উগ্র জিহাদী গ্রুপের গুপ্ত ঘাতক চক্রের সদস্য। গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১২ মে সকালে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যাকারী দুর্বৃত্তরাও মাদ্রাসা ভিত্তিক উগ্র জিহাদী গুপ্ত ঘাতক চক্রের সদস্য। এই হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে মোট চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে হত্যায় তিনজনের সম্পৃক্ততা ছিল। তারা দু’জন ছাত্র মজলিশ ও একজন ছাত্রশিবিরের সদস্য। এ ঘটনায় জড়িত আরও তিনজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদেরও তদন্তকারীরা গ্রেফতার করতে পারছেন না। কারণ একটাই যারা জিহাদী গুপ্ত ঘাতক গ্রুপের সদস্য তাদের পরিসংখ্যান, প্রকৃত পরিচয়, অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল হতে পারছে না তদন্তকারীরা। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে গোপনে বিচরণ করছে জিহাদী গুপ্ত ঘাতকরা। মুক্তমন প্রগতিশীল প্রকাশক, লেখক, ব্লগারদের টার্গেট করে হত্যা করে যাচ্ছে তারা। তাদের সংখ্যা কত সেই পরিসংখ্যান, সাংগঠনিক কাঠামোর কোন ধারণাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে অস্পষ্ট।
×