ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হত্যাকারীরা দীর্ঘদিন ধরে দীপনের চলাচলের ওপর নজর রাখছিল

দীপন হত্যাকারী শনাক্তে অর্ধশত ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৩ নভেম্বর ২০১৫

দীপন হত্যাকারী শনাক্তে অর্ধশত ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা হচ্ছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে ৮টি সিসি ক্যামেরার অন্তত অর্ধশত ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা চলছে। হত্যার দিন ও আগের ৪ দিনসহ মোট ৫ দিনের ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরাগুলো মার্কেটে প্রবেশের পথগুলোতে বসানো। তবে যেখানে ফয়সালকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে কোন সিসি ক্যামেরা ছিল না। মার্কেটের যে সারিতে জাগৃতি প্রকাশনীর অবস্থান, সে সারিতেও কোন সিসি ক্যামেরা পাওয়া যায়নি। তদন্তকারীরা বলছেন, হামলার পর দরজা বা গেট বা সাঁটার লাগিয়ে তাতে ভারী তালা লাগিয়ে দেয়া হামলাকারীদের নতুন কৌশল। নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে এবং আহতদের সম্পর্কে সহজেই তথ্য প্রকাশ না পেতে এবং আহতদের মৃত্যু নিশ্চিত হতেই এমন কৌশল নিয়েছে হামলাকারীরা। এদিকে প্রকাশক হত্যা, আরেক প্রকাশকসহ দুই লেখক ও ব্লগারকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। দুটি মামলার আসামিরাই অজ্ঞাত। শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন হত্যায় নিহতের স্ত্রী ডাঃ রাজিয়া রহমান এবং শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, লেখক ও ব্লগার রন দীপম বসু এবং প্রকৌশলী তারেক রহিম হত্যাচেষ্টার ঘটনায় শুদ্ধস্বরের প্রকাশক নিজেই বাদী হয়ে অপর মামলাটি দায়ের করেন। প্রকাশকদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হোগো সোয়ার। ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঘটনার দুটির সঙ্গে জড়িত কেউ শনাক্ত বা আটক হয়নি বলে দাবি করেছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো। তবে অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। শুদ্ধস্বরে হামলাকারীদের শনাক্ত করতে হামলাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য রাস্তার আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের কাজ চলছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আজিজ সুপার মার্কেটে প্রবেশের পথগুলোতে মোট ৮টি সিসি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। ৮টি সিসি ক্যামেরাই ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা চলছে। ঘটনার সঙ্গে আজিজ সুপার মার্কেটের ওপরে আবাসিক এলাকায় বসবাসরত কারও যোগসূত্র আছে কিনা সে বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান চলছে। তদন্তে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বিষয়টিকে। মোট ৫ দিনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা চলছে। ঘটনার দিন ও হত্যাকা-ের আগের ৪ দিনের ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে। ভিডিও ফুটেজের পরিমাণ অন্তত অর্ধশত। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এত ফুটেজ পর্যালোচনা করে প্রকৃত হত্যাকারীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফুটেজ ছাড়াও বিভিন্ন পন্থায় হত্যাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। দীপনকে যেখানে হত্যা করা হয় সেখানে এবং যে সারিতে তার প্রকাশনা সংস্থাটি অবস্থিত সেখানে কোন সিসি ক্যামেরা নেই। যদি থাকত তাহলে হত্যাকারীদের শনাক্ত করা সহজ হতো। সার্বিক পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে দীপনের ওপর নজরদারি করা হচ্ছিল। দীপনের চলাফেরা এবং অফিসে যাতায়াতের ওপর দীর্ঘদিনের নজরদারি ছিল হত্যাকারীদের। এ জন্যই তারা এমন একটি সময়কে বেছে নিয়েছে, যখন অপেক্ষাকৃত বেশি নিরিবিলি থাকে। আর মোহাম্মদপুরে হামলার ঘটনায় কোন কিনারা হয়নি। যে বাড়িতে ঘটনাটি ঘটে সেখানে কোন সিসি ক্যামেরা ছিল না। এমনকি বাড়ির দুটি গেটই সব সময় খোলা থাকত। ঘটনাস্থলের আশপাশের কোন বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে কোন সিসি ক্যামেরা নেই। হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে নানাভাবে চেষ্টা চলছে। হত্যাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য রাস্তায় থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে দুটি তাজা বুলেট ও ১টি বুলেটের খোসা উদ্ধার হয়েছে। ঘটনাটি সুদূরপ্র্রসারী পরিকল্পনার অংশ। হত্যাকারী ও তাদের সহযোগী হিসেবে ঘটনাস্থলসহ আশপাশে অন্তত ৭-৮ জন ছিল বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, মূল হামলায় অংশ নেয়া তিনজন বাসার সামনে পশ্চিম দিক করে রাখা একটি মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায়। যে রাস্তা ও তার আশপাশের কোন ভবনে বা বাড়িতে কোন সিসি ক্যামেরার অস্তিত্ব খোঁজে পাওয়া যায়নি। তদন্তকারীরা বলছেন, হত্যাকা-ের পর দরজা বা গেট বা সাঁটার ফেলে ভারি তালা লাগিয়ে দেয়া হত্যাকারীদের নতুন কৌশল। হত্যাকারীরা নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে, হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তি সম্পর্কে সহজেই তথ্য প্রকাশ না পাওয়া এবং আহত ব্যক্তির মৃত্যু দ্রুত নিশ্চিত করতেই এমন কৌশল নিয়েছে হামলাকারীরা। ইতোপূর্বে হত্যাকারীরা হামলার পর আহত ব্যক্তির শরীরে দ্রুত বিশেষ ইনজেকশন দিয়ে দিত। যে ইনজেকশন মানুষের রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। রক্ত জমাট বাঁধতে না পারলে দ্রুত শরীর থেকে রক্ত পড়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু নিশ্চিত হয়। অভিজিত রায় হত্যার পর হত্যাকারীদের ফেলে যাওয়া ব্যাগ থেকে এ ধরনের একটি ইনজেকশন উদ্ধার হয়েছিল। অভিজিতকে জখম করার পর তার শরীরে এ ধরনের বিশেষ ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। টিএসসি থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে অভিজিতকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। ধারণা করা হয়, বিশেষ ওই জাতীয় ইনজেকশন দেয়ার কারণে দ্রুত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে অভিজিতের মৃত্যু হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, হত্যাকা-ের সঙ্গে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত বলে তাদের সন্দেহ। দুটি হত্যাকা-ে অংশ নেয়ারা একই জায়গা থেকে এবং একই ব্যক্তির কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়াও বিচিত্র নয়। কারণ হামলার ধরন, ব্যবহৃত অস্ত্র ও জব্দকৃত আলামত পর্যালোচনা তেমন আভাসই দিচ্ছে। দুটি ঘটনা এক সময়ে করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দুটি হামলা যে একসূত্রে গাঁথা তাতে ন্যূনতম কোন সন্দেহ নেই। শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলার ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় দায়েরকৃত মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ঘটনার সময় ৩০-৪০ বছর বয়সী প্রথমে একজন বই কেনার কথা বলে সেখানে প্রবেশ করে। এরপর ২০-৩০ বছর বয়সী আরও দুজন প্রবেশ করে। তারা ব্যাগ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে প্রথমে অফিস সহকারী রাসেলকে (২৮) জিম্মি করে অফিসের ভেতরে দেয়ালঘেরা বারান্দায় আটকে রাখে। এরপর তারা চাপাতি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের কোপাতে থাকে। এরপর টুটুলের মাথায়, কপালে, হাতে শরীরে, তারেকের সারা শরীরে কুপিয়ে জখম করার পাশাপাশি তার দুই হাত কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে ও ডান পাঁজরে গুলি করে। রণদীপম বসুর হাত-পা কুপিয়ে জখম করে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, সোমবার দুপুর ২টায় নিহত দীপনের স্ত্রীর অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করছেন শাহবাগ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহীন ফকির। আর মোহাম্মদপুর থানায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনী সংস্থার প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলের দায়ের করা মামলাটির তদন্ত করছেন মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক তদন্ত আফজাল হোসেন। মামলা দুটির ছায়া তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। প্রসঙ্গত, গত ৩১ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় ১৩১ নম্বর জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপনের (৪০) লাশ উদ্ধার হয়। ঘাড় ও গলা কেটে হত্যা করা হয় তাকে। হত্যার পর খুনীরা সাঁটারে তালা লাগিয়ে যায়। রক্ত পড়ে সাঁটারের নিচ দিয়ে সামনের ফ্লোর ভিজে লেগে ম্যানেজার ও স্থানীয়দের চোখে পড়ে। এর পরই উদ্ধার করা হয় দীপনের লাশ। উদ্ধারকালে দীপনের মাথাটি কম্পিউটারের কী-বোর্ডের ওপর উপুড় করা অবস্থায় পড়ে ছিল। জাগৃতি প্রকাশনী থেকে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে হত্যাকা-ের শিকার হওয়া মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞান মনস্ক লেখক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক প্রকৌশলী ড. অভিজিত রায়ের লেখা ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ও ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামের দুটি বই প্রকাশিত হয়। আর একই দিন দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন লালমাটিয়া সি ব্লকের ৮/১৩ নম্বর ৫ তলা বাড়ির চতুর্থ তলায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ে হামলায় আহত হন প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল (৫০), লেখক এবং ব্লগার প্রকৌশলী তারেক রহিম (৪২) ও রণদীপম বসু (৪০)। এ প্রকাশনী সংস্থাটি থেকে নিহত অভিজিত রায়ের লেখা ‘সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ ও ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ নামে দুটি বই প্রকাশিত হয়।
×