ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এ.এস.এম মোহসিউজ্জামান শাকিল

আসা শুরু করেছে শীতের অতিথি পাখিরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২ নভেম্বর ২০১৫

আসা শুরু করেছে শীতের অতিথি  পাখিরা

শীত এসে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আসা শুরু করেছে অতিথি পাখিরাও। হাওড়, বাঁওড়, দীঘি, বিল, লেকসহ অসংখ্য জলাশয় অতিথি পাখির আগমনে নবরূপে সাজা শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। শীতের হাত থেকে বাঁচতেই তাদের এই আগমন। কী অদ্ভুত ঠেকল কথাটা? শীত প্রধান দেশ রাশিয়ার সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীনের জিনিজিয়াং ও ভারত মহাসাগরে যখন তীব্র শীত পড়ে তখন সেসব অঞ্চলে দেখা দেয় তীব্র খাদ্যসংকট। একদিকে তুষারপাত আর অন্যদিকে খাদ্যসংকট এই দুইয়ে পাখিদের টিকে থাকাটাই দায় হয়ে পড়ে। তখন বাঁচার তাগিদে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম শীতের সহনশীল এই দেশটিকে অতিথি পাখিরা সাময়িক আবাসভূমি হিসেবে বেছে নেয়। নানা রং বেরংয়ের অতিথি পাখিতে মুখরিত হয়ে যায় প্রকৃতি। শীতের নিষ্প্রাণ প্রকৃতির মাঝে সৃষ্টি হয় প্রাণের দ্যোতনা। কল-কাকলিতে তৈরি হয় যেন সুরের মূর্ছনা। পাখনার ঝাপটার নান্দনিক ছন্দ গেয়ে যায় জীবনের গান। গুঞ্জনে-কুজনে আর বাহারি রঙে রূপসী বাংলার প্রকৃতি সাজে অপরূপ সাজে। বিশেষ করে জলাশয়গুলো। অতিথি পাখির বিচরণে জলাশয়গুলো যেন সৌন্দর্যের আধারে পরিণত হয়। অতিথি পাখিরা প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় দেড় শতাধিক প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বালি হাঁস, খয়রা চখাচখি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস পাখি, বড় সারস পাখি, হেরন, নিশাচর হেরন, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন পাখি, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচার্ড, প্যালাস ফিস ঈগল, ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, বালি হাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল, নীলশীর পিয়াং, চীনা, পান্তামুখি, রাঙ্গামুড়ি, কালোহাঁস, পেড়িভুতি, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল, শামুক খোলা, গো-বক, সাদা বক, জল ময়ূর, হটটিটি, দলপিপি, গঙ্গা কবুতর, পানকৌড়ি, কোম্বাডাক, রাঙ্গামুড়ি, পাস্তমুখী, ফ্লাইফেচার, মুরহেন, সুবেলার, গার্গেনি ইত্যাদি। অবদান অতিথি পাখি সৌর্ন্দযের প্রতীক। ঝাঁকে ঝাঁকে বাহারি রঙের অতিথি পাখি যখন একসাথে বিচিত্র স্বরে ডাকতে ডাকতে আকাশে উড়ে বেড়ায় তখন মনোরম স্নিœগ্ধ সৌন্দর্যের দেখা পাওয়া যায়। বিষণœœ মনও সেই সৌন্দর্যের জাদুবলে নিমেষেই প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। অতিথি পাখিদের অনাবিল সেই সৌন্দর্য দেখতে পাখি প্রেমীরা ভিড় করে জলাশয়গুলোতে। মিরপুরের চিড়িয়াখানা ও জাতীয় উদ্যান, মিরপুর সিরামিক লেক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জলাশয়, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পুটিয়ার পচামাড়িয়া, হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওড়, দিনাজপুরের রামসাগর, বরিশালের দুর্গাসাগর ইত্যাদি জায়গায় পাখিপ্রেমীদের সমাগমে সরগরম পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়। এই সব এলাকার মানুষের আয়ও সেই সময়টায় স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায় পর্যটকদের কল্যাণে। অতিথি পাখি শুধু প্রকৃতির শোভা বর্ধন আর পাখি প্রেমীদের মনের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে ব্যাপারটি কিন্তু এমন নয়। এগুলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ফুল ও শস্যের পরাগায়নে সহায়তা করে। ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। পোকামাকড় খেয়ে এগুলোর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। অতিরিক্ত জলজ উদ্ভিদ জলাশয়ে জন্মালে জলজ পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তখন জলজ উদ্ভিদ শ্বসনের সময় পানি থেকে অক্সিজেন নেয়। ফলে পানিতে বসবাসকারী মাছ বা অন্যান্য প্রাণী অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। এ ক্ষেত্রে অতিথি পাখিরা জলজ উদ্ভিদ খেয়ে জলজ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। অতিথি পাখির মল জলাশয়ের মাছের খাদ্য। ফিরে যাওয়া ক্ষণকালের অতিথি পাখিরা শীতের সময়টুকু এদেশের জলাভূমিতে কাটিয়ে দেয়। তারপর বসন্তের শুরুতে যখন শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোর বরফ গলতে শুরু করে তখন সদলবলে ঝাঁকে ঝাঁকে নিজেদের আসল ডেরায় ফিরে যায়। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এদেশে যেভাবে যে পথে এসেছে সে পথেই ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। পথ ভুল হয় না। পাখিদের এই ক্ষমতা রীতিমতো বিজ্ঞানীদের কাছে বিস্ময়কর। এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। একদিন হয়ত পাখিদের এই নির্ভুলভাবে পথ চলার রহস্য উন্মোচন হবে আর তা বিজ্ঞানকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। অস্তিত্ব সঙ্কট এই দেশের জলাশয়গুলো অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও দিন দিন অতিথি পাখিদের আগমন কমে যাচ্ছে। এর কারণ বহুবিধ। কিছু অসাধু লোভী মানুষ নির্বিচারে অতিথি পাখি হত্যা করে বাজারে বিক্রি করে থাকে। এরা জালের ফাঁদ পেতে, বিষটোপ কিংবা ছররা গুলি দিয়ে পাখিদের নির্মমভাবে হত্যা করছে। এদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শৌখিন শিকারিরাও মেতে ওঠে অতিথি পাখি নিধনযজ্ঞে। এদের নিষ্ঠুরতার বলি হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য দুর্লভ প্রজাতির অতিথি পাখি। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুসারে অতিথি পাখি শিকার ও বিক্রি করা দ-নীয় অপরাধ হলেও আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই এরা যেন অতিথি পাখি শিকারের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এছাড়া আরও কিছু কারণেও অতিথি পাখির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। অতিথি পাখিদের বিচরণ ভূমি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বন জঙ্গল কেটে উজাড় করে ফেলায় পাখিরা হারাচ্ছে তাদের নিরাপদ আশ্রয়। আবার ফসলী জমিতে কৃত্রিম সার এবং মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে অতিথি পাখিরা বিষে আক্রান্ত কীট পতঙ্গ খেয়ে মারা যাচ্ছে। আবহাওয়ার আকস্মিক গতি পরিবর্তন এবং মাত্রাতিরিক্ত শব্দ ও বায়ু দূষণের কারণে অসংখ্য অতিথি পাখি এদেশ ছেড়ে চলে যায়। ইতোমধ্যে অনেক অতিথি পাখি নির্বিচারে হত্যার কারণে বিপন্ন হয়ে গেছে। অনেকগুলো অস্তিত্ব সংকটে। আবার কিছু পাখি চিরতরে এই দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে এখন আগের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি তেমন একটা দেখা যায় না।
×