ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ যে কারণে অতিমাত্রায় ভূমিকম্পপ্রবণ

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১ নভেম্বর ২০১৫

বাংলাদেশ যে কারণে অতিমাত্রায় ভূমিকম্পপ্রবণ

শাহীন রহমান ॥ টেকটোনিক প্লেট কাঠামোর কারণই বাংলাদেশের অবস্থান অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ভূমিকম্প কোথায় ঘটবে তা মূলত নির্ভর করে নির্দিষ্ট এলাকার ভূতাত্ত্বিক ও টেকটোনিক কাঠামোর ওপর। মূলত দুটি প্লেটের সংযোগ অঞ্চলে তথা কোন অঞ্চলে ফাটল থাকলে সেখানে ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ ইন্ডিয়ান প্লেটের অংশ এবং উত্তর-পূর্বে তিনটি প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত। এ কারণে ভূমিকম্প নিয়ে শঙ্কাও বেশি। গত এপ্রিল-মে মাসে নেপালে ঘটে যাওয়া প্রলয়ঙ্করি দুটি ভূমিকম্পের কারণ বিশ্লেষণ করে ভূ-বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে ইন্ডিয়ান প্লেট আর ইউরেশিয়ান প্লেট একটি অপরটির অন্যের নিচে ঢুকে যাওয়াতেই ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তি। সোমবার আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের কারণ বিশ্লেষণ করে তারা একমত হয়েছেন যে, এ ভূমিকম্পও দুটি প্লেটের সীমান্তে অবস্থানগত কারণেই হয়েছে। গত সোমবার হিন্দুকুশে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পটি বরং দু’প্লেটের সংঘর্ষের কারণে না হয়ে দুটি প্লেট পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণেই উৎপত্তি হয়েছে। তাদের মতে, ইন্ডিয়ান প্লেটটি যে গতিতে ইউরেশিয়ান প্লেটের দিকে এগোচ্ছিল, একই গতিতে এবার তা ঢুকে গেছে হিন্দুকুশের নিচে। একইভাবে ইউরেশিয়ান প্লেট ঢুকে গেছে পামীর মালভূমির নিচে। দু’য়ের সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ার ফলে এই ভূকম্পের উৎপত্তি। তাদের মতে, বাংলাদেশের অবস্থান এমন এক স্থানে যেখানে ভারত, মিয়ানমার ও ইউরেশিয়া প্লেটের ঠেলাঠেলি রয়েছে একে অন্যের দিকে। বিশ্লেষকদের মতে, সুদূর আফগানিস্তান থেকে সোমবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তি হলেও এর প্রভাব পড়তে পারত বাংলাদেশেও। তবে আশার কথা যে উৎপত্তির দিক দিয়ে ভূমিকম্পটি শক্তিশালী হলেও মাটির অনেক গভীরে হওয়ায় এটি খুব বেশি ভয়াবহ হয়নি। হিন্দুকুশে এ ভূমিকম্পটি মাটির ২শ’ কিলোমিটার গভীর থেকে উৎপত্তি হওয়ায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। এরপরও আফগানিস্তান, ভারত ও পাকিস্তানে এর প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশে হয়েছে মৃদু কম্পন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, রিখটার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পটিতে নির্গত হয়েছে প্রায় পঞ্চাশটি পরমাণু বোমার সমান শক্তি। কিন্তু গত এপ্রিলে নেপাল ভূমিকম্পে মাটির অল্প গভীরে থেকে উৎপত্তি হওয়ায় বাংলাদেশের এ ভূমিকম্প বড় ধরনের আতঙ্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। আর নেপাল হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্লেটগুলোর গতি নির্ণয় করে দেখা গেছে ইন্ডিয়ান প্লেট বছরে ৬ সেন্টিমিটার করে উত্তর পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে। আর বার্মা প্লেট বছরে ২ সেন্টিমিটার করে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে আসছে। ইন্ডিয়ান প্লেট যে পরিমাণ উত্তর পূর্ব দিকে এগোচ্ছে সেই পরিমাণ ইউরেশিয়া ও বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে না। ফলে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়া বার্মা প্লেট বাউন্ডারিতে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের ভেতরের ভূত্বকে প্রচুর পরিমাণ শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিন প্লেটের সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্পন প্রবণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আরব সাগর ও বঙ্গোপসগার জুড়েই হলো ইন্ডিয়ান প্লেটের অবস্থান। এই প্লেটের উত্তরে রয়েছে ইউরেশিয়া প্লেট। পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বে মুজাফফরাবাদ থেকে শুরু হয়ে হিমালয়ের দক্ষিণ পাদদেশ ঘেঁষে ভারতের উত্তর পূর্ব অরুণাচল-চীন সীমান্ত পর্যন্ত ২৫শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। আর পূর্বে বার্মা প্লেটের সঙ্গে রয়েছে এর সংযোগ। এই সংযোগ উত্তরে অরুণাচল-চীন সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে মনিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পশ্চিম দিক দিয়ে আরও দক্ষিণে সুমাত্রা পর্যন্ত ৩ হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত। ইন্ডিয়ান প্লেটে উত্তরে ইউরেশিয়া প্লেটের নিচে এবং পূর্বে বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টি এসব কিছুই করে থাকে প্লেট টেকটোনিক্স। পৃথিবীর উপরিভাগে ৭০ থেকে ১শ’ কিলোমিটার পুরুত্বের লিথোস্ফিয়ার স্তর ছোট বড় ১৩ খ-ে বিভক্ত। এছাড়া আরও অনেক মাইক্রো প্লেট রয়েছে। এই প্লেটগুলো উত্তপ্ত ও নরম এস্থনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসছে এবং গতিশীল। প্লেটগুলো ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পটি কোথায় ঘটবে তা মূলত নির্ভর করে নির্দিষ্ট এলাকার ভূতাত্ত্বিক ও টেকটোনিক কাঠামোর ওপর। দুটি প্লেটের সংযোগ অঞ্চলে ও কোন এলাকায় ফাটল থাকলে সেখানে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ইন্ডিয়ান প্লেটের অংশ এবং উত্তর-পূর্বে তিনটি প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত। ভূতাত্ত্বিক ও টেকটোনিক প্লেট কাঠামোর কারণেই বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ। এ কারণে ভূমিকম্প নিয়ে শঙ্কা বেশি রয়েছে। বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চলসমূহ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশের ভূতাত্ত্বিক ও টেকটোনিক কাঠামো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে একই অঞ্চলে সুদূর অতীতেও ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। বাংলাদেশের ওপর আঘাত হানা প্রাচীনতম ইতিহাসের রেকর্ড পাওয়া যায় স্যার ইউলিয়াম উইলসনের (১৮৭৫ সালে) লেখা স্ট্যাটিস্টিক্যাল এ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল বই থেকে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে ১৫৪৮ সালে একই অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্পটি হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন পৃথিবীর যত ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে মানুষ বেশি পরিচিত তার মধ্যে ভূমিকম্প সৃষ্ট দুর্যোগই সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ। ভূমিকম্প কোটি কোটি বছর ধরে বিদ্যমান একটি চলমান প্রক্রিয়া যা দুটি প্লেটের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হয়। এর প্রলয়ঙ্করি আঘাতে পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ও সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে। গত এপ্রিলে ঘটে যাওয়া নেপাল ভূমিকম্পে সে দেশের মানুষের মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ হাজারের মতো। রিখটার স্কেলে নেপাল ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৮। এর আগে ২০১১ সালের ১১ মার্চে জাপানে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প পরবর্তী সৃষ্ট সুনামির ফলে সে দেশে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৯ হাজারে। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৯। ২০১০ সালে হাইতিতে যে ভূমিকম্প হয়েছিল তার প্রভাবে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩ লাখে। অথচ রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭। ২০০৮ সালের ১২ মে চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে মানুষ মারা গিয়েছিল ৮৭ হাজার। ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবর পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ৭৫ হাজার মানুষ মারা যায়। ২৬ জানুয়ারি ভারতের গুজরাটে সৃষ্ট ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ হাজারে। রিখটার স্কেলে ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৭। ৩০ সেপ্টেম্বর ভারতের মহারাষ্ট্রে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে মানুষ মারা যায় সাড়ে ৭ হাজারের বেশি। আর ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ৯.১ মাত্রায় সৃষ্ট ভূমিকম্প পরবর্তী সুনামির ফলে মানুষ মারা যায় ৩ লাখ ৮৮ হাজার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এসব ভূমিকম্পের ফলে যে প্রলয়ঙ্করি দুর্যোগ সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে বাংলাদেশকে শিক্ষা নেয়া এবং সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
×