ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

সিরিয়ায় রাশিয়া কি চায়

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২৮ অক্টোবর ২০১৫

সিরিয়ায় রাশিয়া কি চায়

গত ৩০ সেপ্টেম্বর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষ নিয়ে রাশিয়া সে দেশের আইএস-এর অবস্থানগুলোর উপর বোমাবর্ষণ শুরু করেছে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর মধ্যপ্রাচ্যের রঙ্গমঞ্চে রাশিয়ার সদর্প উপস্থিতি ঘটলো। আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়ার লক্ষ্য তার বিপন্ন মিত্র বাশার সরকারকে টিকিয়ে রাখা এবং সিরিয়ার উপকূলে রুশ নৌঘাঁটি যা কিনা ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে তার একমাত্র সংযোগ সেটিকে রক্ষা করা। কিন্তু পাশ্চাত্যের পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যে, সিরিয়ায় রাশিয়ার এই সর্বশেষ পদক্ষেপের পিছনে কিছু অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতাও কাজ করেছে। তারা বলেন, একথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, সিরিয়ায় রুশ বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হলো ৩৫ বছর আগে আফগানিস্তানে ক্রেমলিনের শোচনীয় সামরিক বিপর্যয়ের পর রাশিয়ার সবচেয়ে জটিল সামরিক হস্তক্ষেপ। এই হস্তক্ষেপ পুতিনকে করতে হলো পাশ্চাত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে রাশিয়াকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যে নাজুক অবস্থায় পড়তে হয়েছে তার অবসান ঘটানোর জন্য। পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক অবরোধ এবং বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যহ্রাস রুশ অর্থনীতিকে দারুণ চাপে ফেলেছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে ২.২ শতাংশ। ২০১৪ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা রুশদের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৬১ লাখ, যা জনগোষ্ঠীর ১১.২ শতাংশ। অর্থনীতির দ্রুত পতন ঠেকাতে হলে বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁট করতে হবে এবং তা করতে গেলে আরও নাজুক অবস্থায় পড়বেন পুতিন। ক্রিমিয়া দখলের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে কিছুদিন উগ্র জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে ছিলেন তিনি। সেটা করতে গিয়ে মাসুলও দিতে হয়েছে। অর্থনৈতিক দুর্দশা গ্রাস করেছে রুশদের। ফেডারেল বাজেট নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক মন্দা তীব্রতর রূপ নেয়ায় পুতিনের জনসমর্থনও পড়তির দিকে চলেছে। এই সংকট থেকে পরিত্রাণ চান পুতিন। সিরিয়ার পরিস্থিতি তাকে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। আইসিস ২০১৩ সাল থেকে সিরিয়া ও ইরাকের এক বিশাল ভূখ- দখল করে রেখেছে। তাদের ধ্বংস ও সংহারের হাত থেকে বাঁচতে লাখ লাখ লোক প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। ইউরোপের দেশে দেশে গিয়ে উদ্বাস্তু সংকট সৃষ্টি করেছে। পুতিন এটাকে শাপে-বর হিসেবে দেখেছেন। তিনি কয়েকটি পরিকল্পনা নিয়েছেন। একটা কাজ না করলে আরেকটা নিয়ে এগোবেন। প্রথম পরিকল্পনা ছিল একটা আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন গঠন, যার কাজ হবে আইসিসকে পরাজিত করতে সিরিয়া সরকারকে সাহায্য করা। এক দশকের মধ্যে এবারই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকে যোগ দিয়ে তিনি এক ভাষণে এই প্রস্তাব দেন এবং বলেন, ‘বন্ধুগণ! এ কাজ করা হলে আর উদ্বাস্তু শিবির তৈরি করার প্রয়োজন পড়বে না।’ পুতিন আশা করেছিলেন রুশ, মার্কিন ও অন্যান্য বাহিনী নিয়ে ওই গ্র্যান্ড কোয়ালিশন গঠিত হলে রাশিয়ার উপর মার্কিন অবরোধ আর জারি রাখার প্রয়োজন পরবে না। ফলে অবরোধের সাঁড়াশি চাপ থেকে মুক্ত হবে রাশিয়া। কিন্তু ওবামা পুতিনের প্রস্তাবে রাজি হননি। বাশারকে আগে বিদায় নিতে হবে এই শর্তে তিনি অটল থাকেন। ফলে পুতিনের প্ল্যান ‘এ’ ভেস্তে যায়। এখন পুতিনের সামনে থাকে ঝুঁকিপূর্ণ ‘প্ল্যান বি’। রুশ বিমানবাহিনী আইসিস-সহ বাশারবিরোধী বিদ্রোহী অবস্থানগুলোর উপর বোমাবর্ষণ শুরু করে। বাশার সরকারকে টিকিয়ে রাখা দৃশ্যত লক্ষ্য হলেও রুশ কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের লক্ষ্য আরও বড়। বাশারকে নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। সিরিয়া অভিযানে তাদের আসল লক্ষ্য পাশ্চাত্যকে এ কথা বুঝানো যে, রাশিয়ার সাহায্য ছাড়া তাদের পক্ষে আইসিসকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। আপাতত এই লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে রাশিয়া। রুশ বোমাবর্ষণের মুখে আইসিস তার এতদিনের অর্জন যতটুকু সম্ভব সংরক্ষণ করে সিরিয়ার বৃহত্তম নগরী আলেপ্পোর আরও গভীরে ঢুকে গেছে। রাশিয়া চাইছে বাশারবিরোধী অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রুপকে ধ্বংস করা যাতে করে সিরিয়ার যুদ্ধটা সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও আইসিসের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের রূপ নেয়। সেই লক্ষ্য অর্জিত হলে এই দুটি শক্তির মধ্যে বাশারকে অপেক্ষাকৃত কম বিপজ্জনক হিসেবে দেখানো যাবে এবং সেই যুক্তি দেখিয়ে রাশিয়া জোর গলায় বলতে পারবে অধিক বিপজ্জনক শত্রু আইসিসের মোকাবিলা করার জন্য সব দেশের উচিত বাশার সরকারকে সমর্থন করা। বলাবাহুল্য, আমেরিকা এমন একটা পরিণতি চাইবে না। কিন্তু এটাই পুতিনের লক্ষ্য যাতে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্ভাব্য মিত্র হিসেবে পাশ্চাত্যের সামনে রাশিয়া ও বাশার ছাড়া আর কেউ না থাকে। সে জন্যই বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর উপর বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাশিয়া পাশ্চাত্যকে একটানা এই সাহায্যের আহ্বানও জানিয়ে চলেছে। এর পাশাপাশি সিরিয়ায় উপস্থিতির মাধ্যমে রাশিয়া নিজের একটা শক্তির ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করছে। বলতে চাইছে, অবরোধ আরোপ করে তাকে নতি স্বীকার করানো বা দুর্বল করা যায়নি। পুতিন এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন যে সিরিয়ার সমস্যা সমাধান করতে হলে তাকে লাগবেই, পাশকাটিয়ে যাওয়া যাবে না। সূত্র : টাইম
×