ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ

বদলে যাওয়া ক্রীড়া সাংবাদিকতা

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ২৮ অক্টোবর ২০১৫

বদলে যাওয়া ক্রীড়া সাংবাদিকতা

সম্ভবত সতেরো শতকের শেষ দিকে ছাপার অক্ষরে প্রথম দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেটাও বৃটেনে। তখন সে পত্রিকায় কোন স্পোর্টস রিপোর্টার ছিল না। তখন কেন, তার অনেক অনেক বছর পরেও এই পদটি সৃষ্টি হয়নি। ইংরেজরা ভারতবর্ষ শাসন করার সুবাদে দৈনিক পত্রিকার পরিধি বৃটেন থেকে সারা পৃথিবী তথা এ উপমহাদেশেও চলে আসে। প্রথম দিকে সেটা ছিল দিল্লী, আগ্রা, মুস্বাই, কলকাতা কেন্দ্রিক। ১৯৪৭ এ ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানেও অনেকগুলো দৈনিক পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। প্রথমদিকে এসব পত্রিকায় কোন আলাদা খেলার পাতা, ফুলটাইম স্পোর্টস রিপোর্টার না থাকলেও ক্রীড়ানুরাগী পাঠকের খেলার খবরের প্রতি আগ্রহের কারণে এক সময় সব পত্রিকা ফুলটাইম স্পোর্টস রিপোর্টার নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়। এক সময় যেখানে এক কলামও খেলার নিউজ ছাপা হতো না- আজ সেখানে প্রতিদিন এক দুই এমন কী চার পৃষ্ঠাও খেলার খবর ছাপা হচ্ছে। এর সঙ্গে ফিচার পেজ তো আছেই। ক্রীড়া সাংবাদিকতার সেই সব সাতকাহন নিয়েই আজকের আলোচনা। অনেকদিন আগে, বোধ করি নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ক্রীড়াজগতে সে সময়ের প্রথিতযশা ক্রীড়া সাংবাদিক কাজী আলম বাবুর একটা লেখা পড়েছিলাম। শিরোনাম ছিল ‘ক্রীড়া সাংবাদিকতা কী কেবলই থ্যাঙ্কলেস জব!’ লেখাটি বাবুর তথা তখনকার দিনের ক্রীড়ালেখক-সাংবাদিকদের দুঃখ-কষ্ট, রাগ-ক্ষোভ, পাওয়া-না পাওয়া, আনন্দ-বেদনার চালচিত্র অনেকখানি ফুটে উঠেছিল। এরপর সময় অনেকটাই গড়িয়ে গেছে। পার হয়ে গেছে তিন দশক। অর্থাৎ ত্রিশটা বছর। বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। বাবুর মতো অনেক প্রতিভাবান ক্রীড়া সাংবাদিক প্রাচুর্যের আশায় সেই যে বিদেশে গেছে আর ফেরেনি। প্রবাস জীবন শেষে ফজলে রশিদ, শেখ আইনুল, আবদুস শুকুর, নীরুরা ফিরেছে মৃত্যুর বার্তা নিয়ে। সেদিন যে কারণে অনেক ঋদ্ধ ক্রীড়া সাংবাদিক প্রবাস জীবনকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন আজ হয়তো অনেক ক্রীড়া সাংবাদিক সেটা করবেন না। কেননা আজ ক্রীড়া সাংবাদিকতার সেদিনের চেহারার অনেকটাই বদলে গেছে। কেবলমাত্র ক্রীড়া সাংবাদিকতা করে আজ অনেকে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। সে আয়েশি জীবন ছেড়ে অনেকেই অনিশ্চয়তার প্রবাস জীবনের কথা ভাববেন না নিশ্চয়! বদলে যাওয়া আজকের ক্রীড়া সাংবাদিকতা কেবলমাত্র ‘থ্যাঙ্কলেস জব’র গ-িতে আটকে নেই। আজ ক্রীড়া সাংবাদিকরা শ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। অনেকে গাড়ি, বাসস্থানেসহ আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। সেটা ছেড়ে কে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ায়! একটা সময় ক্রীড়া সাংবাদিকতা ছিল ঢাকা কেন্দ্রিক। তখন কোন ক্রীড়া সাংবাদিক খেলা কাভার করতে সিলেট, চিটাগাং, খুলনা বা রাজশাহী যাওয়াকে অনেক বড় ব্যাপার বলে মনে করতেন। অনেক খ্যাতিমান ক্রীড়া সাংবাদিকের জীবনে একবারও বিদেশে খেলা কভার করতে না যাওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। আজ খেলার পরিধি কেবলমাত্র দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সেটা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ক্রীড়াবিশ্বে। আর সে কারণে ক্রীড়া সাংবাদিকরাও আজ ভীষণ ব্যস্ত। আজ দিল্লী তো কাল অস্ট্রেলিয়া অথবা পরশু আমেরিকা। বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার গোড়ার ইতিহাস অনেকেরই জানা। শ্রদ্ধেয় অগ্রজ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ভাই, ইকরামউজ্জমান ভাই, বন্ধু দুলাল মাহমুদ প্রমুখরা এ নিয়ে অনেক লিখেছেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতায় কলকাতা কেন্দ্রিক কিছু বাংলা দৈনিক প্রকাশিত হলেও তাতে খেলার খবর খুব একটা প্রাধান্য পেত না। ১৯৪৭ সালে ব্রটিশ শাসনের অবসান হলে এবং ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হলে কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হওয়া দৈনিক আজাদ ছাড়াও ১৯৪৯ সালে ঢাকা থেকে দৈনিক ইত্তেফাক, ডেইলি মর্নিং নিউজ, ডেইলি অবজারভার এবং ১৯৫১ সালে দৈনিক সংবাদ ও পরে দৈনিক পূর্বদেশসহ আরও কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হলেও সেখানেও যে খেলার খবর খুব বেশি প্রাধান্য পেত তাও নয়। খুব বড় কোন খেলা হলে তার একটা ছোট্ট খবর পত্রিকার এক কোণে এক বা আধ কলামে ঠাঁই পেত। সেটাও করতেন কোন পার্ট-টাইম স্পোর্টস রিপোর্টর। পার্ট-টাইম স্পোর্টস রিপোর্টরের কাজটা প্রথম যিনি শুরু করেন তিনি দৈনিক আজাদের চিফ রিপোর্টার সৈয়দ জাফর আলী। তিনি খেলাকে ভালবাসতেন বলে নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নিজ আগ্রহে এ কাজটি শুরু করেন। তাঁর দেখাদেখি এ বি এম মুসা, আনিসুল মওলা, নুরুল ইসলামসহ আরও অনেকে খেলার প্রতি ভালবাসা থেকেই নিজ কাজের সঙ্গে পার্ট-টাইম স্পোর্টস রিপোর্টিংকে বেছে নেন। তারা যে নিয়মিত স্টেডিয়ামে যেতেন তা নয়। বড় কোন খেলা না থাকলে মাঝেমধ্যে স্টেডিয়ামে ঢুঁ মারতেন। যা খেলার খবর পেতেন তাই লিখে দিতেন। আর খেলার পাঠক গোগ্রাসে সেটাই গিলতো। ফলে অতি অল্প সময়ে পত্রিকা মালিকেরা বুঝতে পারেন, এ দেশের খেলাপাগল পাঠক আরও বেশি খেলার খবর পড়তে চায়। পাঠক যা চাইবে পত্রিকা তো সেটাই দেবে। আর তাই আজাদের তৈরি করা পথে হাঁটতে শুরু করে ইত্তেফাক, অবজারভার, মর্নিং নিউজ, পূর্বদেশসহ অন্যসব পত্রিকা। পাঠকের খেলার খবরের প্রতি ভালবাসা দেখে ডেইলি মনিং নিউজ একজন ফুলটাইম স্পোর্টস রিপোর্টরের নিয়োগ দেয়। সেটা ১৯৫৭ বা ’৫৮ সালের দিকে। প্রথম যিনি ফুলটাইম স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে নিয়োগ পান তিনি হচ্ছেন ডেভিডসন। একই পত্রিকার আনিসুল মওলাকে করা হয় স্পোর্টস এডিটর বা হেড অব স্পোর্টস। মর্নিং নিউজ’র পথ ধরে একে একে অন্য পত্রিকাগুলোও স্পোর্টস রিপোর্টরের নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়। আর এ কাজটিতে আরও খানিকটা এগিয়ে যায় ডেইলি অবজারভার। তারাও ফুলটাইম স্পোর্টস রিপোর্টার নিয়োগ, খেলার পাতার পরিসর বৃদ্ধি ও ফিচার পাতার প্রতি মনোনিবেশ করে। এ সময়ে এবিএম মুসা, রোজিরিও, ওয়াহিদুল হক এবং তাঁর সহোদর রেজাউল হক বাচ্চু, তওফিক আজিজ খান, এস এ মান্নান লাডু, প্রমুখরা ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মূলত তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আজকের ক্রীড়া সাংবাদিকতা। এ তো গেল ইংরেজী পত্রিকার কথা। এবার আসি বাংলা পত্রিকা প্রসঙ্গে। ১৯৪৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হলেও এবং কলকাতা থেকে দৈনিক আজাদ স্থানান্তরিত হয়ে ঢাকায় এলেও বাংলা পত্রিকায় ফুলটাইম স্পোর্টস রিপোর্টার নিয়োগ দেয়া হয় অনেকটা দেরিতেই। ইংরেজী পত্রিকার অনেক পরে তো বটেই। ষাটের দশকে দৈনিক পাকিস্তান (যেটি দেশ স্বাধীন হবার পর দৈনিক বাংলায় রূপান্তরিত হয়।) প্রথিতযশা ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামানকে প্রথম ফুলটাইম স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরপর একে এক অন্য পত্রিকাগুলোও ক্রীড়া সাংবাদিকের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করে। তারই ফলশ্রুতিতে মিজানুর রহমান, মাশির হোসেন, আবদুল আওয়াল খান, রেজাউল হক বাচ্চু (চট্টগ্রাম), মিনু খাদেম, আবদুল হামিদ, বদি উজ্জামান, আতাউল হক মল্লিক, মাসুদ আহমেদ রুমী, বিডি মুখার্জী প্রমুখরা ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন এবং এ পেশাকে সু-প্রতিষ্ঠিত করতে নিরলস কাজ করে যান। একটা পিচ ঢালা মসৃণ হাইওয়ে দেখে আমরা যেমন ভুলে যাই সেখানে একদিন ধূধূ মাঠ ছিল। সে মাঠে কাদামাটির পথ, তারপর ইট-সুড়কির রাস্তার কথা যেমন ভুলে যাই তেমনি আজকে আমরা অনেকেই এসি রুমে দামি চেয়ার-টেবিলে বসে আমাদের অগ্রজদের সে অবদানের কথা বলতে গেলে ভুলেই গেছি। তাঁদের সেই ক্লান্তিহীন পরিশ্রমের ফসল আজকের ক্রীড়া সাংবাদিকতার এই আলোকিত দিন। অথচ আমরা সহজে আমাদের অতীতকে ভুলে যাই। ক্রীড়া সাংবাদিকদের আজকের এই আবস্থা সব সময় ছিল না। টেবিলের এক কোণে ভাঙ্গা চেয়ারে বসেও খেলার রিপোর্ট করতে হয়েছে অনেককে। অনেকের আবার নিজস্ব টেবিল-চেয়ারও ছিল না। ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে তাঁদের। আজ তো দামি চেয়ার-টেবিল, এসি রুম সবই পাচ্ছেন ক্রীড়া সাংবাদিকরা। আর একটা কথা, অনেকে হয়ত জানেন না ক্রীড়া সাংবাদিকতার দুইটি দিক রয়েছে। একটা হচ্ছে, ক্রীড়া সাংবাদিকতা করা। অর্থাৎ নিজে ক্রীড়াসাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। আর একটি দিক হচ্ছে, নিজে ক্রীড়া সাংবাদিকতা করা এবং পাশাপাশি ক্রীড়া সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠিত করা। অর্থাৎ নিজের পেশার পাশাপাশি ক্রীড়ালেখক-সাংবাদিক সৃষ্টি করা। অনেকেই ক্রীড়ালেখক-সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং নিজে বড় মাপের ক্রীড়ালেখক-সাংবাদিক হয়েছেন। তবে নতুন ক্রীড়ালেখক-সাংবাদিক সৃষ্টিতে তাদের অবদান অনেকাংশে কম। আবার অনেকে নিজ পেশার পাশাপাশি নতুন ক্রীড়ালেখক-সাংবাদিক সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এ কাজটি অনেকেই করেছেন বা করে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে দৈনিক বাংলার স্পোর্টস এডিটর মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, দৈনিক ইকিলাবের পরবর্তীতে দৈনিক আমাদের সময়ের স্পোর্টস এডিটর ও কিংবদন্তি ক্রীড়াধারাভাষ্যকার প্রয়াত আবদুল হামিদ, সব্যসাচী ক্রীড়া সাংবাদিক ও অনেক পত্রিকার স্পোর্টস এডিটর প্রয়াত আতাউল হক মল্লিক, দৈনিক বাংলার বাণীর স্পোর্টস এডিটর ও এখন পাক্ষিক ক্রীড়া জগতের সম্পাদক প্রিয়বন্ধু দুলাল মাহমুদ, পাক্ষিক ক্রীড়া লোকের নির্বাহী সম্পাদক প্রয়াত-বন্ধু মাহবুবুল হাসান নীরুর নাম না বললেই নয়। এঁরা ছাড়াও আরও অনেকেই কোন বিনিময়ের কথা না ভেবেই নীরবে এই কাজটি করে যাচ্ছেন তাঁদের এই অবদানের কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। আরও একটা কথা বলা দরকার, ডেইলি মর্নিং নিউজ খেলার খবর প্রকাশের অগ্রপথিক হিসেবে গণ্য হয়ে আছে। তারা প্রথম একজন পেশাদার স্পোর্টস রিপোর্টার ও স্পোর্টস এডিটর নিয়োগ দেয়। এ ছাড়া এ পত্রিকা প্রথম পূর্ণপৃষ্ঠা খেলার খবর ছাপে। এ পত্রিকায়ই প্রথম পূর্ণপৃষ্ঠা খেলার ফিচার পাতা ছাপা হয়। তখন দেশের শীর্ষ ক্রীড়া লেখকরা সে ফিচার পাতায় লিখতে থাকেন। এরপর ডেইলি অবজারভারও এ কাজটি শুরু করে। তারপর ইংরেজী পত্রিকা ছাড়াও আজাদ, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলাসহ অনেক বাংলা পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে ফুলপেজ স্পোর্টস নিউজ ছাপতে শুরু করে। তবে ১৯৯২ সালে দৈনিক আজকের কাগজ প্রকাশিত হবার পর খেলার খবর ভিন্ন মাত্রা পায়। তবে তরুণ স্পোর্টস এডিটর বন্ধু ফরহাদ মান্নান টিটোর নেতৃত্বে একঝাঁক তরুণের খেলার খবরকে সাহিত্যের সংমিশ্রণে সরস পরিবেশনায় ক্রীড়ানুরাগী পাঠক আকৃষ্ট হয়। ফুলপেজ রঙ্গিন এ পাতায় খেলার খবর ছাড়াও দৃষ্টিনন্দন ছবিও পাঠক হৃদয় কাড়ে। আর এখন তো প্রতিদিন দুই বা চার পৃষ্ঠাও খেলার খবর ছাপা হচ্ছে। আর ক্রীড়ামোদী পাঠক তা লুফেও নিচ্ছে। ফলে দিনকে দিন বদলে যাচ্ছে ক্রীড়া সাংবাদিকতার চিত্র। যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। লেখক : ক্রীড়ালেখক, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সংগঠক [email protected]
×