ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ নুরুজ্জামান

অবসরে বিরেন্দর শেবাগ

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ২৮ অক্টোবর ২০১৫

অবসরে বিরেন্দর শেবাগ

শেষ পর্যন্ত ‘বিদায়’ বললেন শেবাগ। সমাপ্তি ঘটল ভারতীয় ক্রিকেটের ‘রোমাঞ্চকর’ এক ব্যাটিং অধ্যায়ের। ২০ অক্টোবর মঙ্গলবার ছিল বীরেন্দর শেবাগের ৩৭তম জন্ম দিন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর জন্য এ দিনটিকেই বেছে নেন তুখোড় ভারতীয় ওপেনার। অবশ্য তার দুদিন আগে থেকেই গুঞ্জন চলছিল। কি হয়েছিল দুবাইয়ে এমসিএলের অনুষ্ঠানে? শেবাগের অন্যতম সতীর্থ জহির খান ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন। জহির প্রসঙ্গেই এমসিএলের ওই অনুষ্ঠানে শেবাগ প্রসঙ্গ উঠে আসে। তখন তিনি বলেন, ‘দেশে ফিরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের কথা জানাব।’ সেখানে খোদ আইসিসির নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে আগ বাড়িয়ে তিনিই শেবাগের অবসর নিয়ে মন্তব্য করে বসেন! তারপরই ঝড়ের বেগে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর গুঞ্জন সত্যি করে দেশে ফিরে ইন্ডিয়ান বোর্ডের (বিসিসিআই) কাছে লিখিত বক্তব্যে অবসরের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। গ্রেট শচীন টেন্ডুলকর-শেন ওয়ার্নের উদ্যাগে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এমসিএলে সুযোগ পেতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়া বাধ্যতামূলক। অবসরে যাওয়া এক ঝাঁক রথী-মহারথীকে নিয়ে আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে এমসিএল। টুর্নামেন্টের অফিসিয়াল হোম পেজে কয়েকটি জার্সির ছবি দিয়ে সেগুলোর পেছনে এ্যাডাম গিলক্রিস্ট, কুমার সাঙ্গাকারা, ব্রায়ান লারা, ওয়াসিম আকরাম, জ্যাক ক্যালিস ও মাহেলা জয়াবর্ধনের নাম লেখা ছিল। একটি জার্সিতে ছিল কেবল ‘প্রশ্নবোধক’ চিহ্ন! দুই বছর আগে ২০১৩ সালের মার্চে হায়দরাবাদে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্ট এবং একই বছর জানুয়ারিতে কলকাতায় পাকিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেন শেবাগ। ২০১২-এর অক্টোবরের পর আর টি২০তে জায়াগ হয়নি। মাত্র ১০৪ টেস্টে ৮,৫৮৬ রান নিয়ে ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় পঞ্চম স্থানে শেবাগ। দেশটির হয়ে দু-দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকানো একমাত্র ব্যাটসম্যানও তিনি। ২৫১ ওয়ানডেতে শেবাগের রান সংখ্যা ৮,২৭৩। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ২১৯, যা তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে। এছাড়া ডানহাতি অফস্পিনে টেস্টে ৪০ ও ওয়ানডেতে শিকার করেছেন ৯৬ উইকেট। ১৯৯৯ সালে অভিষেকের পর মূলত রঙিন পোশাকের সীমিত ওভারের ম্যাচেই খেলতেন। কিন্তু ২০০১ সালে সুযোগ পেয়ে টেস্টে ব্যাটিংয়ের ধারণাটাই পাল্টে দেন। ২০০২ সালে তৎকালীন কোচ জন রাইট ও অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীর হাত ধরে দিল্লীর এই ব্যাটসম্যানের সাদা পোশাকে ওপেনিংয়ের সুযোগ ঘটে। ৮৪ রান করে পাওয়া সুযোগটাকে কাজে লাগান। ওপেনার হিসেবে তার ব্যাটিং গড় ৮২.২৩- যা যে কোন ব্যাটসম্যনের সর্বোচ্চ। ২০০৩-২০০৪ ছিল শেবাগের ক্যারিয়ারের সোনালি সময়। ৯ টেস্টে করেছিলেন ১০৪০ রান। যার মধ্যে ছিল এমসিজি টেস্টের এক দিনেই ১৯৫ রানের মতো বিরল কৃতিত্ব। ওই বছরই প্রথম ভারতীয় হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকান শেবাগ। মুলতানে পাকিস্তানের বিপক্ষে করেন ৩০৯ রান। ২০০৮-এ চেন্নাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলেন ৩১৯ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস। এছাড়া ক্যারিয়ারে ২শ’ উর্ধ ইনিংস রয়েছে চারটি। টেস্টে মুম্বাইয়ে দু-বার, গল, কানপুর, কলকাতা, কলম্বো ও আহমেদাবাদের ম্যাচজয়ী দুরন্ত সেই ইনিংসগুলো এখনও শেবাগের স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে। ২০০৮ সালেই এ্যাডিলেডে টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে তার করা ১৫১ রানে ভর করে জয় সম এক ড্র পেয়েছিল ভারত। টেস্টে মোট ২৩ সেঞ্চুরির ১৪টিকেই ১৫০-এর ওপরে নিয়ে গিয়েছিলেন দিল্লীতে জন্ম নেয়া এই ড্যাশিং উইলোবাজ। দখল করেছিলেন আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান। ২০১২ সালে শেবাগ নবম ভারতীয় হিসেবে শততম টেস্ট খেলার কৃতিত্ব দেখান। এতট না হলেও রঙিন পোশাকে ঔজ্জ্বল্য কম ছড়াননি। ১৫ সেঞ্চুরির ১৪টিতেই জিতিয়েছেন ভারতকে। প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি পান ২২ বছর বয়সে, ৬৯ বলে। ২০১১-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হাঁকান ডবল সেঞ্চুরি। ২০০৭ টি২০ এবং ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী ভারত দলের গর্বিত সদস্য। ২০০৩-১২ সালের মধ্যে ১২ ওয়ানডে এবং ৪ টেস্টে দলকে নেতৃত্বও দিয়েছেন বীরেন্দর শেবাগ। নিজের অবসর নিয়ে শেবাগ বলেন, ‘আমি সব সময় সেটাই করেছি যা ঠিক মনে হয়েছে। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, যা করতে চেয়েছিলাম সেটা করতে পেরেছি। মাঠে, জীবনেও। মঙ্গলবার ঠিক করলাম সাঁইত্রিশতম জন্মদিনে ক্রিকেট ছেড়ে দেব। এখন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। সেখান থেকে ঘোষণা করছি যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সব ফরমেট আর আইপিএল থেকে সরে দাঁড়ালাম।’ তবে বিদায় বললেও ক্রিকেটই তার জীবন। এ বিষয়ে তার মন্তব্য, ‘ক্রিকেটই আমার জীবন হয়ে থাকবে। যেমন এতদিন ছিল। এরপর আমি কমেন্ট্রি করতে পারি, বা থাকতে পারি কোন টিমের কোচিং স্টাফ হিসেবে। আসলে ক্রিকেট ছেড়ে থাকাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ’ এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘ক্রিকেটের কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার ছিল না। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় যে, মিডিয়া প্রিয় ফাইভের মধ্যে আমাকে রেখেছে। মনে হয় না আমি তার যোগ্য। আমার সৌভাগ্য, শচীন টেন্ডুলকর, দ্রাবিড়, সৌরভ, ভিভিএসের মতো খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলেছি। ওদের কাছ থেকে শিখেছি। সৌরভের কাছে আমি অসম্ভব ঋণী। ওর জন্যই আমার টেস্ট খেলা। টেস্ট দলে ডাক পাওয়াটা আমার কেরিয়ারের সেরা মুহূর্ত। তার আগে লোকে বলত আমি ওয়ান খেলোয়াড়। সৌরভ নিশ্চয়ই আমার মধ্যে কিছু দেখেছিল। ওর মনে হয়েছিল যে, আমি টেস্টেও পারব। যতদিন খেলার সঙ্গে যুক্ত থাকব, ততদিন সৌরভকে মনে রাখব। ও ভরসা না রাখলে আমার হয়তো টেস্ট খেলাই হতো না।’ সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলিকে স্মরণ করে শেবাগ আরও যোগ করেন, ‘সৌরভের কথা বার বার মনে পড়ছে। আসলে ও যে দলটা করেছিল তারা বিদেশে টেস্ট জিতেছে, ড্র করেছে। ও খেলোয়াড়কে পারফর্ম করার সময়টা দিত। যা খুব দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, ওয়ানডেতে ও নিজের জায়গাটাই আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। আমি ওপেন করতে লাগলাম শচীনের সঙ্গে। এতেই বোঝা যায় সৌরভ কত ভালবাসত আমাকে। কৃতজ্ঞ দাদা।’
×