ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২৬ অক্টোবর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

কৈশোরের আরও স্মৃতি (২৪ অক্টোবরের পর) এই ‘মুকুলমেলা’ ১৯৪৭ সালে শহরজুড়ে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ আমি আমার কতিপয় বন্ধুকে নিয়ে গ্রহণ করলাম। এই বন্ধুদের মধ্যে ছিল নাসির উদ্দিন চৌধুরী (বীমাখ্যাত), হেদায়েত আহমদ (প্রয়াত সচিব ও রাষ্ট্রদূত), আহমদ কবীর চৌধুরী (সিলেটের প্রখ্যাত আবাসন ব্যবসায়ী), উবেদ জায়গীরদার (বর্তমানে বিলেতবাসী ব্যবসায়ী), প্রয়াত আবু সায়ীদ মাহমুদ (ইটিভি খ্যাত), চা-কর জেবা রশিদ, ফলক আরা বেগম (তার সম্বন্ধে বর্তমানে কিছুই জানি না), পরবর্তীকালে মাহমুদের স্ত্রী নিলুফার মাহমুদ, কোহিনূর, প্রয়াত রোকসানা চৌধুরী রাকা, আমার বোন শাহ্্লা খাতুন প্রমুখ। এই সংগঠন গড়ে তুলতে আমি আমার আপা ও বয়ঃজ্যেষ্ঠ ভাইদের বিশেষ সহায়তা লাভ করি। ছেলেদের সংগঠন গড়ে তুলতে সহায়তা করেন ছাত্রনেতারা। যেমন- আবদুল হক, শাহেদ আলী, এমদাদুর রহমান, হাবিবুর রহমান (পরবর্তীকালে পীর হাবিব বলে সমধিক খ্যাত), শিক্ষকবৃন্দ- সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, আবদুর রহমান, আবদুল গাফফার, দত্ত চৌধুরী, দেওয়ান আজরফ ও গ্রন্থাগারিক মোঃ নূরুল হক দশঘরী। মেয়েদের সংগঠন গড়তে সাহায্য করেন- নেসা বু, লুসি বু, রুবি বু; শিক্ষয়িত্রীবৃন্দ- রাবেয়া খাতুন, লুৎফা বেগম, জেবুন্নেসা খানম প্রমুখ। মোটামুটিভাবে পরিচিত গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ আমাদের কিছু কিশোর-কিশোরীর সম্মিলিত আসর ছিল এবং তাকেই পুঁজি করে আমাদের সংগঠন দুটি গড়ে ওঠে। এই সংগঠনটি বিভিন্ন পাড়ায় প্রতিষ্ঠিত শাখার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এসব পাড়া ছিল- রায়নগর, কুমারপাড়া, মীরাবাজার, নাইওরপুল, শেখঘাট, লামাবাজার, দরগা মহল্লা এবং আম্বরখানা। আমাদের মধ্যে একটু প্রতিদ্বন্দ্বিতারও চিন্তা-ভাবনা ছিল। কারণ আনন্দবাজারের ‘মণিমেলা’ তখন সিলেটে বেশ ভালভাবেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারও নেতৃত্বে ছিল আমাদের বন্ধুবর্গ। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই দুটি প্রতিষ্ঠানই সিলেটের কিশোর সংগঠনে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য এবং ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। আমরা প্রায়ই সাহিত্য সভা করতাম। গান-বাজনা বা নাচের আসর জমাতাম। একই সঙ্গে বিভিন্ন শারীরিক ব্যায়াম ও খেলাধুলাও চলত। আমাদের গুরুজন এবং অভিভাবকরা এতে খুব উৎসাহ দিতেন। এটা ঠিক যে, এই উদ্যোগ আমাদের সার্বিক বিকাশে মূল্যবান ভূমিকা রাখে এবং অসৎ কাজকর্ম থেকে বিরত রাখে। আমার সব সময়ই মনে হয় যে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আমাদের মানস, মনন, চিন্তা-ভাবনা এগুলোর উন্নত বিকাশে বিনিশ্চায়ক ভূমিকা পালন করে। কৈশোরের দিনগুলোয় লেখাপড়ার বাইরে এটিই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। এসব উদ্যোগে টাকা-পয়সা তেমন লাগত না। প্রয়োজনীয় খেলার সামগ্রী বা সাজগোজের সামগ্রী সহজেই আমাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে আদায় করা যেত। সংগঠনের প্রথম সময়ে আমি বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত থাকি। কিন্তু যেই সংগঠন বড় হতে থাকল তখন আমার ভূমিকা হলো পেছন থেকে নেতৃত্ব প্রদান। আমি দেখলাম যে, এ রকম আসরে প্রায়ই ছোটখাটো ঝগড়া এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগেই থাকে এবং সেক্ষেত্রে আমি নিজের জন্য মধ্যস্থতার ভূমিকাটি গ্রহণ করি। নাসির উদ্দিন চৌধুরী এবং ওবেদ জায়গীরদার এ বিষয়ে সাক্ষী দিতে পারে, তাদের ঝগড়া মেটানো হয়ে যায় আমার একটি বড় দায়িত্ব। আর একটি প্রভাব অজ্ঞাতেই আমাদের ওপরে পড়ে। তখন ছাত্রমহলে বাম চিন্তাধারা বেশ শক্তিশালী ছিল এবং বাম চিন্তাধারার নেতারা অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করে এ ভাবধারা প্রচার করতেন। ভাল ছাত্রদের তারা নানা বই পড়তে উৎসাহিত করতেন এবং এসব বই এক ধরনের নির্দিষ্ট চিন্তাধারা বিকাশে সাহায্য করত। তারা ব্যায়ামের চর্চা করতেন এবং সেখানে নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা প্রশিক্ষণ দিতেন। এরই ফাঁকে ফাঁকে বাম চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্র প্রসারিত হতো। কৌশিকদা এ বিষয়ে অত্যন্ত সফল প্রশিক্ষক ছিলেন। তার চতুর শিষ্য ছিল বন্ধু অনিমেষ। মুকুলমেলা গঠনের আগে এই বাম গোষ্ঠীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ শুরু হয়। তারা প্রথমেই আমাকে নির্দিষ্ট ছকে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। প্রথম গ্রন্থ যেটি আমাকে পড়তে দেয়া হলো তার নাম ছিল ‘ইতিহাসের ধারা’। একই সঙ্গে কৌশিকদা আমাদের এলাকার বেশকিছু ছেলেকে ব্যায়াম শিক্ষার সুযোগ করে দিলেন। আমাদের বাড়ির পেছনে তখন বেশ বড় খালি মাঠ ছিল, যাকে সবাই বলত লাল মাটির মাঠ। সেখানে আমাদের ব্যায়ামের ব্যবস্থা হলো এবং ব্যায়াম শুরু করার আগে কৌশিকদা কুচকাওয়াজ করাতেন এবং বাম চিন্তাধারার ওপর বক্তব্য রাখতেন। বেশিদিন এই ব্যবস্থাটি চলল না, কারণ কৌশিকদা এবং অনিমেষ সহসা গায়েব হয়ে গেলেন। আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, আমি সে সময় আর একটি বিষয়ে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হই এবং সেটা ছিল ধর্মকর্ম। আমি এ ব্যাপারে বেশ লেখাপড়াও শুরু করি এবং আমার মনে হয় অনেক গোঁড়া বিশ্বাস ও আচরণ অনুসরণ করতে থাকি। যেমন- হাফ প্যান্ট ছেড়ে পাজামা পরা, মাথায় টুপি দেয়া, ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানে বিশেষ আগ্রহ ইত্যাদি। কিছুদিন এমনকি আমি ছবি তোলাও বন্ধ করে দিলাম। যাই হোক, কুসংস্কারে বন্দী হবার আগেই আমার আব্বার উদার নীতির প্রভাব এবং সমাজে ধর্ম শিক্ষক হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা আমাকে এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সাহায্য করে। কলেজে পৌঁছার অব্যবহিত পরই আমি কুসংস্কার থেকে মুক্তি পেয়ে যাই। অবশ্য ধর্মীয় আচরণ আমার জীবনে স্থায়ীভাবে স্থান করে নেয়। আমি যখন এসব বিষয়ে আরও পড়াশোনা করি তখন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছি, যেখানে বিশ্বাস একটি প্রধান বিষয় সেখানে তাকে যৌক্তিকীকরণের প্রচেষ্টা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়েও যখন মোতাজিলা আন্দোলন সম্বন্ধে অবহিত হই তখন আমার কৈশোরের শেষ সময়ের সিদ্ধান্তটি আরও কার্যকরী হয়। আমার নিজস্ব সৃষ্টি চাঁদতারা মার্কা টুপি প্রায় তিন বছর আমার পরিচিতি চিহ্ন হিসেবে কাজ করে। কলেজে যোগদানের পর আস্তে আস্তে সেই টুপিটি বিদায় হয়ে যায়। আমার সহপাঠীদের অসংখ্য নাম আমার এখনও মনে আছে। সেটি পর্যালোচনা করে দেখতে পাই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল হিন্দু বন্ধুবান্ধব। আমাদের বিনোদনের মাধ্যমের খুব অভাব ছিল না। খেলাধুলা, সাহিত্য সভা, গান-বাজনার আসর, বিকেলে দলবদ্ধভাবে হাওয়া খাওয়া অর্থাৎ উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটাহাঁটি এবং বসার জায়গা পেলে সেখানে বসে গল্প করা, এসব করেই সূর্যাস্ত এসে যেত। সূর্যাস্তে স্কুল জীবনে বাড়ি যাওয়া ছিল একেবারে নির্দিষ্ট রেওয়াজ, যার হেরফের কখনও হতো বলে মনে হয় না। কলেজে যাওয়ার পর আমরা অনেকটা শেয়ানা হয়ে যাই এবং সন্ধ্যা রাতে বাড়ির বাইরে থাকার সাহস সঞ্চয় করি। ১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সাল আমাদের জীবনে ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়। স্বাধীনতা আন্দোলন সে সময় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। ব্রিটেনে শ্রমিক দলের এটলি সরকার তো স্বাধীনতা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। সময় লাগে সাম্প্রদায়িক বিষয়ের নিষ্পত্তিতে এবং এতে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনটি প্রকট আকার ধারণ করে। আমি সে সময়ই রাজনীতিবিদ হয়ে যাই। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট অখ- ভারতের অন্যতম মুসলমান নেতা হোসেন আহমদ মাদানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করি। তিনি যে নোয়াসড়ক মসজিদে নামাজ পড়তেন সেখানে আমরা দলবেঁধে একদিন জুমার নামাজে অংশগ্রহণ করি এবং নামাজ শেষে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি। তিনি অবশ্য কোন বিতর্কে না গিয়ে নামাজ শেষে চলে যান। কিন্তু অবস্থা এতই উত্তপ্ত হয় যে, সেখানে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খুরশিদকে শান্তিরক্ষার জন্য উপস্থিত হতে হয়। আমরা দেখতে পাই যে, মোল্লারা লাঠিসোঁটা নিয়ে আগেভাগেই প্রস্তুত ছিল। চলবে...
×