ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কোন্ দিকে যাচ্ছে দেশীয় চলচ্চিত্র?

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২৬ অক্টোবর ২০১৫

কোন্ দিকে যাচ্ছে দেশীয় চলচ্চিত্র?

গৌতম পাণ্ডে ॥ দেশীয় চলচ্চিত্রের এক ক্রান্তিলগ্ন চলছে নির্দ্বিধায়। সংস্কৃতিপ্রেমীরা এতে অনেকটাই ব্যথিত। তবে ১৯৯৯ সাল থেকে এর চেয়েও বড় অবক্ষয় শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে। অশ্লীলতা ও বিকৃত রুচির নিম্নমানের চলচ্চিত্র নির্মাণের মহোৎসব শুরু হয়েছিল সে সময়। কতিপয় বিকৃত রুচির নির্মাতা, অশ্লীল মানসিকতার অভিনেতা-অভিনেত্রীর কারণে চলচ্চিত্রের অতীত গৌরব হারাতে বসেছিল। সেই সময় থেকে দর্শক সিনেমা হল বিমুখ হতে শুরু করে। তারা ঘরে বসে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, ভিসিআর ভিসিডির মাধ্যমে অবাধে সেন্সরবিহীন বিদেশী চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পায়। ধীরে ধীরে ভাল চলচ্চিত্র এবং দর্শকের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় অগনিত সিনেমা হল। প্রায় ১৫শ’র জায়গায় বর্তমানে সারাদেশে তিনশটির মতো সিনেমা হল অবশিষ্ট রয়েছে। এগুলোও এখন বন্ধ হওয়ার পথে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা শহরে হাতেগোনা কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল নির্মিত হয়েছে। ছোট আয়তনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসুবিধা সমৃদ্ধ মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে বেশিরভাগ সময়ে প্রদর্শিত হয় ইংরেজী চলচ্চিত্র। এতে অনেকটাই নাখোশ সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী রাকায়েত বলেন, আমাদের চলচ্চিত্র কোন দিকে যাচ্ছে এটা বলা কঠিন। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতাও আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনে এক বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। দর্শকের মনে স্থিরতা না থাকলে তাদের বিনোদনমুখী হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের দেশে হল ক্রাইসিসও এই অঙ্গনে এক বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। মেধার সঙ্কটও একটা বিরাট কারণ, বিশেষ করে চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রে। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ধারায় আমাদের আসার সময় আসেনি। সরকার যদি চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাহলে হয়ত চলচ্চিত্রের সুবাতাস বইবে। রাতারাতি এ অঙ্গনকে পাল্টে ফেলা সম্ভব নয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিরাজমান দুরবস্থার নেপথ্যে কাজ করছে অনেক কিছু। প্রথমত তামিল তেলেগু চলচ্চিত্রের হুবহু নকল, নির্মাণে অদক্ষতা, দর্শক পছন্দের তারকার অভাব, ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহার, ডিজিটাল প্রযুক্তিতে নির্মাণ ও প্রদর্শনে অদক্ষতা, অনভিজ্ঞতা সর্বোপরি দর্শকদের কথা মাথায় না রেখে যেনতেনভাবে নির্মাণের কারণে দর্শকরা ওই সব চলচ্চিত্র দেখার কোন আগ্রহ অনুভব করেন না। যার যে গল্প ভাল লাগে সে মনে করে দর্শকদেরও এটা ভাল লাগবে। দর্শকদের মনোজগৎকে ধারণ করার বিষয়টি তারা বিবেচনাতেই আনছেন না। চিত্রনায়িকা ববিতা এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, চলচ্চিত্রে পরিবর্তন তো হবেই। তবে চলচ্চিত্রের সোনালী যুগে আমরা যখন অভিনয় করতাম, তখন ডিরেক্টর, প্রযোজক, অভিনয় শিল্পীরা ছিল একটি পরিবারের মতো। এখন তার কিছুটা ভাটা পড়েছে। আমার মতে তখন চলচ্চিত্র ছিল রিয়েল, আর এখন চলচ্চিত্রকে আমার কাছে মনে হয় লম্বা একটি নাটকের মতো। ডিজটালে আপত্তি নেই, তবে চলচ্চিত্রতো সত্যিকারের চলচ্চিত্র হতে হবে। ডিজিটাল হওয়াতে আমার কাছে এখন এটাকে সিনেমা মনে হয় না। চলচ্চিত্র নির্মাতা কাজী হায়াৎ বলেন, ডিজিটাল চলচ্চিত্রাঙ্গনে এক বিশেষ মাত্রা এনে দিয়েছে। ঝকঝকে ছবি, পরিষ্কার শব্দসহ বিভিন্ন নতুনত্ত্বের কারণে দর্শক হলে আসছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মূল ধারার চলচ্চিত্র থেকে আমরা দূরে সরে আসছি। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, চলচ্চিত্র কোনদিন বন্ধ হবে না, শুধুমাত্র ফরম্যাট চেঞ্জ হবে। সেলুলয়েটের যে চলচ্চিত্র ছিল সেটাকে গুডবাই জানিয়ে দিয়েছে প্রায় সকলে। এখন ডিজিটাল ফরমেটে চলবে। তবে শুধুমাত্র ডিজিটালই সব সমস্যার সমাধান করে দেবে তা নয়। এখন যেটা আমাদের দেশে চলছে তার মধ্যে দূরের জিনিস দেখার ভিশনটা হচ্ছে না। যেটা ছিল থার্টি ফাইভ মিলিমিটারের সময়। এখন চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে সেভাবে লেন্সগুলো সাপোর্ট করছে না। হয়ত ভবিষ্যতে সেটা হবে। এখন সময় নিয়ে মানুষ বেশি ভাবে, চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ থাকলেও হৃদয়ে গেঁথে নেয়ার বিষয়টি কমে গেছে। মূল কথা হলো আমাদের দেশের চলচ্চিত্র অবিভাবকহীনভাবে চলছে। এখন এক শ্রেণীর নতুন নায়ক-নায়িকা একটি দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে মিডিয়ার সামনে নিজেদের সুপারস্টার হিসেবে জাহির করতে চেষ্টা করেন। একদা রাজ্জাক, কবরী, শাবানা, ফারুক, আলমগীর, ববিতা, শবনম, রহমান, আজিম, সুজাতা, সুচন্দা, উজ্জ্বল, সোহেল রানারা সুপারস্টারের যে উজ্জ্বল দ্যুতি নিয়ে অবস্থান করেছেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে, আজকের ঢালিউডি নায়ক নায়িকাদের মধ্যে তেমন উজ্জ্বলতার প্রকাশ নেই। অত্যন্ত নিম্নমানের দুর্বল অভিনয় দিয়ে দর্শকদের হৃদয়ে নাড়া দেয়া অসম্ভব। অপরিপক্ব মেধাহীন চিত্রনির্মাতাদের কবল থেকে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রকে রক্ষা করতে হবে। দর্শক মনে গভীরভাবে রেখাপাত করতে পারে কেবলমাত্র তেমন কাহিনী নিয়ে অভিজ্ঞ দক্ষ মেধাবী চিত্র নির্মাতারা যদি ভাল বাজেটে সুন্দর পরিকল্পনা করে চলচ্চিত্র তৈরি করেন তাহলে সেটা দেখতে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ভিড় করবেই। যেসব মেধাবী অভিজ্ঞ চলচ্চিত্র নির্মাতা অভিমান করে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে অন্য ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন, তাদের একটু কষ্ট স্বীকার করে আবার চলচ্চিত্রের হাল ধরতে হবে, অর্থ লগ্নি করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রাণ ফিরে পাবে, আর চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
×