ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সন্ধ্যায় ফোটা বিষণ্ন ফুল, দুখিনী রাজকন্যার অশ্রুবিন্দু

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সন্ধ্যায় ফোটা বিষণ্ন ফুল, দুখিনী রাজকন্যার অশ্রুবিন্দু

মোরসালিন মিজান ॥ শিউলি ফুলের গল্প অনেক হয়েছে। হয়েছে তো বটেই। এর পরও ফুরোয়নি। গল্পটা ফুরোয় না আসলে। শিউলি এত সুন্দর ফুল! এত মিষ্টি এর ঘ্রাণ! গ্রামে তো বটেই, শহরের অনেক পুরনো ইটের গা ঘেঁষে এখনও দাঁড়িয়ে আছে শিউলি গাছ। এই শরতে আরও অনেক ফুলের ভিড়। তবে শিউলির কোন তুলনা হয় না। শরতের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ শিউলি সৌন্দর্যপ্রেমীদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে রেখেছে। পৃথিবীর এই ফুলকে স্বর্গের শোভা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্বল্পাপায়ু শিউলির সূর্যের সঙ্গে আড়ি। তাই রাতে ফোটে। সকাল হতেই অশ্রুবিন্দুর মতো ঝরে যায়। পৌরাণিক কাহিনী মতে, শিউলি বেদনার প্রতীক। ব্যর্থ প্রেমের আলেখ্য। কোন সে ব্যর্থ প্রেম? বেদনার কেন? উত্তর আছে পুরাণে। গল্পটা এক রাজকন্যার। রাজকন্যার নাম পারিজাতিকা। তার রূপে মুগ্ধ সবাই। আর তিনি মুগ্ধ সূর্যতে! সূর্যের প্রেমে পাগলপ্রায়। এর পরও ভালবাসা অধরাই থেকে যায়। মন ভেঙ্গে খান খান হয় রাজকন্যার। বেদনার ভার সইতে না পেরে আত্মাহুতি দেন তিনি। হিন্দু শাস্ত্র মেনে তাকে দাহ করা হয়। কিন্তু আগুনে পুড়ে যে ছাই, তাতে শেষ হয় না সব! রাজকন্যার দেহভস্ম থেকে জন্ম নেয় একটি গাছ। সেই গাছে ফুল ফোটে। রাজকন্যার নামে রাখা ফুলের নামÑ পারিজাতিকা। হ্যাঁ, শিউলির আরেক নাম পারিজাতিকা। একই ফুল পারিজাত নামে পরিচিত। এবার পুরাণ থেকে পারিজাতের গল্পটি করা যাক। অনেকেরই জানা, কৃষ্ণের দুই স্ত্রী সত্যভামা ও রুক্কিনীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগান পারিজাতের ঘ্রাণে ভরে উঠুক। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা! তবুও কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে চান। তাই লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন তিনি। এর ফুল রুক্কিনীর বাগানেও ঝরে পড়ে সুগন্ধ ছড়ায়। এদিকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্র তো ঘটনাটা জেনে খুব রেগে যান! তিনি বিষ্ণু অবতারের ওপর গোপনে ক্রুদ্ধ ছিলেন। এ কারণে তিনি কৃষ্ণকে শাপ দেনÑ কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই। কোনদিন ফল হবে না। তার বীজে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না। শাপ যথেষ্টই সত্য হয়েছিল। শিউলি তাই ফুল হয়ে আছে। এই থাকা আজ আনন্দের বলেই গণ্য! শিউলির প্রচলিত অন্য নামগুলোর মধ্যে রয়েছে শেফালি, শেফালিকা, নাইট ফ্লাওয়ার জেসমিন, হারসিঙ্গার, কোরাল জেসমিন, রাগাপুষ্প, খারাপাত্রাকা ও প্রজক্তা। শিউলির বৈজ্ঞানিক নাম ‘নিক্টান্থেস আরবর-ট্রিসটিস’। নামটিকে ভাঙলেও বেদনার সুর বেজে ওঠে। লাতিন শব্দ ‘নিক্টান্থেস’ অর্থ সন্ধ্যায় ফোটা। ‘আরবর-ট্রিসটিস’ হচ্ছে বিষণœ গাছ। চোখজুড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে সন্ধ্যায় ফোটা এবং সকাল হতেই ঝরে যায় বলে এমন নামকরণ। একই কারণে শিউলিকে বলা হয় ‘ট্রি অব সরো’। প্রিয় ফুলের ছয়টি শুভ্র সাদা পাপড়ি। বৃন্ত দেখতে কমলা রঙের টিউবের মতো। গাছ সাদামাটা ধরনের। নরম ধূসর ছাল বিশিষ্ট। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা জানান, গাছ ১০ মিটারের মতো উঁচু হয়। গাছের পাতা ৬ থেকে ৭ সেন্টিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল প্রান্তের বিপরীতমুখী সাজানো থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে শিউলি ফোটে। পশ্চিমবঙ্গ ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের রাষ্ট্রীয় ফুল শিউলি। বাংলাদেশে বহুকাল ধরে আছে শিউলি। গ্রামে খুব ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা শিউলি কুড়োতে যায়। তরুণীরা শাড়ির আঁচল ভরে শিউলি নিয়ে ঘরে ফেরে। মালা গেঁথে খোঁপায় জড়ায়। এমন দৃশ্য দেখেই হয়ত নজরুল লিখেছিলেনÑ শিউলি তলায় ভোর বেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।/ শেফালি ফুলকে ঝ’রে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা...। ইট-পাথরের জঞ্জাল ঢাকা শহরেও শিউলি গাছের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেকের বাসার সামনে, ছাদে শিউলি গাছ দেখা যায়। শিশু একাডেমির বাগানে আছে শিউলি গাছ। শুক্রবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, যথারীতি ফুল ফুটেছে। কিছু তখনও গাছে। বেশিরভাগ ঝরে পড়েছে। গাছের নিচে ফুলের স্তূপ! সবুজ ঘাসের ওপর শুভ্র সাদা ফুল যেন গড়াগড়ি খাচ্ছে! শিশু একাডেমিতে আসা শিশুরা তো বটেই, মায়েরাও সেই ফুল কুড়াতে ব্যস্ত। পথশিশুরাও এসেছিল। ওরা রীতিমেতা কাড়াকাড়ি করে ফুল নিল। কী হবে এত ফুল দিয়ে? জানতে ওদের অনুসরণ করে টিএসসি এলাকায় আসতে হলো। তখন দেখা গেল, মাঝ বয়সী নারী অভ্যস্থ হাতে মালা গেঁথে চলেছেন। সেই মালা নিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ে শিশুদের আরেকটি দল। এভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে শিউলি। শেষ করা যাক আবিদ আজাদের খুব প্রিয় কবিতা দিয়ে। প্রচ- আত্মবিশ্বাসী প্রেমিক কবি তাঁর প্রিয়াকে উদ্দেশ করে লিখেছিলেনÑ যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না সে শহরে জনহীন কোন/পেট্রোল পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে/একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি...।
×