ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হামজা ব্রিগেডকে অর্থায়নের অভিযোগে গ্রেফতার গার্মেন্টস মালিক রিমান্ডে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

হামজা ব্রিগেডকে অর্থায়নের অভিযোগে গ্রেফতার গার্মেন্টস মালিক রিমান্ডে

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ জঙ্গী সংগঠন ‘শহীদ হামজা ব্রিগেড’কে ১৬ লাখ টাকা অর্থায়নের অভিযোগে শনিবার রাতে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে গার্মেন্টস কারখানার মালিক এনামুল হককে (৩৯) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে র‌্যাব। রবিবার চট্টগ্রামের বাঁশখালীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাজ্জাদ হোসেনের আদালত এই রিমান্ড মঞ্জুর করে। বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের দুর্গম লটমনি পাহাড়ের জঙ্গী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এনামুলকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করা হয়েছিল। শুনানি শেষে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। গ্রেফতার এনামুল হক টঙ্গীর তুরাগ এলাকার ‘গোল্ডেন টাচ এ্যাপারেল’ পোশাক কারখানার মালিক। তিনি যশোর কোতোয়ালি থানার জয়ন্তা গ্রামের মতিয়ার রহমানের পুত্র। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সমর্থক এনামুলকে শনিবার রাতে রাজধানীর টঙ্গীর তুরাগ এলাকার তালতলা থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। রাতেই তাকে নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রামে। র‌্যাব চট্টগ্রাম জোনের পরিচালক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ এ ব্যাপারে রবিবার সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন। তিনি জানান, মোট ১৪টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় জঙ্গী সংগঠন হামজা ব্রিগেডকে এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা ৫২ লাখ টাকা, আইনজীবী হাসানুজ্জামান লিটন ৩১ লাখ টাকা এবং এ্যাডভোকেট মাহফুজ চৌধুরী বাপন ২৫ লাখ টাকা অর্থায়ন করেছেন বলে আগেই প্রমাণ মিলেছে। গার্মেন্টস মালিক এনামুল হক দিয়েছেন ১৬ লাখ টাকা। বাকি ১৪ লাখ টাকা অর্থায়ন কারা করেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসের ১১ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে হামজা ব্রিগেডের শীর্ষ নেতা মনিরুজ্জামান মাসুদ ওরফে ডনের মালিকানার প্রতিষ্ঠান সানজিদা এন্টারপ্রাইজের এ্যাকাউন্টে জমা পড়ে এনামুলের ১৬ লাখ টাকা। ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখা থেকে চট্টগ্রামের ওআর নিজাম রোড শাখায় এ টাকা জমা করা হয়। রবিবার গ্রেফতারকৃত গার্মেন্টস মালিক এনামুল হককে বাঁশখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করার পর আসামির জামিন প্রার্থনা করা হয়নি। পক্ষান্তরে সরকার পক্ষে আসামিকে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানানো হয়। শুনানি শেষে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ড শুনানি চলাকালে সরকার পক্ষের অতিরিক্ত পিপি বিকাশ রঞ্জন ধর ও বাঁশখালী আদালতের আইনজীবী আ ন ম শাহাদাত হোসেন আদালতকে বলেন, জঙ্গী কর্মকা- পরিচালনায় সহায়তা প্রদানের মানসে এই অর্থ প্রদান করা হয়েছে। এর সঙ্গে আর কারা সংশ্লিষ্ট তা তদন্ত করে উদঘাটনে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন। র‌্যাব সূত্র জানায়, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে জঙ্গী সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেডের সন্ধান পাওয়া যায়। ২০১৩ সালের নবেম্বর মাসে চট্টগ্রাম নগরীর ফয়স লেক এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে সভার মধ্য দিয়ে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। নগদ এবং হুন্ডির মাধ্যমে এ সংগঠনকে বিভিন্নভাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ যোগান দেয়া হয়েছে বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে। সে সূত্র ধরে শুরু হয় র‌্যাবের অভিযান। এতে জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগে এ পর্যন্ত ধরা পড়েছে তিন আইনজীবীসহ মোট চারজন। র‌্যাবের তদন্তে হামজা ব্রিগেডের সদস্যসংখ্যা ২৯ জন। তন্মধ্যে অন্যতম শীর্ষ নেতা মনিরুজ্জামান ডনসহ মোট ২৮ জন এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও প্রদান করেছে। এরপর অর্থ সহায়তার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে সুপ্রীমকোর্টের তিন আইনজীবী ও সর্বশেষ এক গার্মেন্টস মালিক। চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া শহীদ হামজা ব্রিগেড নামের এ সংগঠনটি ব্যাপক নাশকতা ও জঙ্গীবাদী কর্মকা- চালাবার প্রস্ততি নিচ্ছিল। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন্ উৎস থেকে অনৈতিক পন্থায় অর্থ যোগানও চলছিল সংগঠনটিকে। এ সংগঠনের রয়েছে তিনটি সামরিক উইং। এগুলো হচ্ছে গ্রীন, ব্লু এবং হোয়াইট। প্রতি ইউনিটে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৭ জন করে সদস্য রয়েছে। এই তিন সামরিক উইংয়ের দুটির প্রধান মোঃ মাসুদ ওরফে ডন এবং মোঃ আজিজ ওরফে তারেক ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল গ্রেফতার হয়। এ জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদের অধিকাংশই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্র। গত ১২ এপ্রিল হাটহাজারীতে অবস্থিত মাদ্রাসাতুল আবুবকর ও ২১ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালীর লটমনি পাহাড় ও ২৮ ফেব্রুয়ারি নগরীর হালিশহর এলাকা থেকে এ পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া সকলেই হামজা ব্রিগেডের সদস্য। র‌্যাবের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, হাটহাজারী আবুবকর মাদ্রাসাটি এই সংগঠনের তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বাঁশখালীর লটমনির গহীন পাহাড়ে ছিল তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। গরু ও মুরগি খামারের আড়ালে তারা সেখানে প্রশিক্ষণ কর্মকা- চালিয়ে আসছিল। সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের পর থেকেই র‌্যাব সেভেনের একটি চৌকস দল এর আদ্যোপান্ত উদঘাটনে তৎপরতা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২১ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের দুর্গম লটমনি পাহাড়ে আবিষ্কৃত হয় জঙ্গী আস্তানা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেদিন র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হয় একে-২২ রাইফেলসহ বিপুলসংখ্যক অস্ত্র, গোলা বারুদ ও সামরিক সরঞ্জাম। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৩টি একে-২২, ছয়টি বিদেশী পিস্তল, একটি রিভলবার, তিনটি দেশী তৈরি বন্দুক, ৬টি একে-২২ ম্যাগাজিন ও ৭৬১টি গুলি। এছাড়াও উদ্ধার হয় ৩টি চাপাতি, ২টি ওয়াকিটকি, মার্শাল আর্টের সরঞ্জাম, জঙ্গল বুট ও ৩৮ সেট প্রশিক্ষণলাভের পোশাক। এর আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারীর আল মাদ্রাসাতুল আবুবকর থেকে গ্রেফতার করা হয় ১২ জঙ্গী। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে বেরিয়ে আসে বাঁশখালীর জঙ্গী প্রশিক্ষণের এ কেন্দ্রের তথ্য। বাঁশখালীর এ আস্তানা থেকে গ্রেফতার হয় মোঃ মোবাশ্বের হোসেন, মোঃ আবদুল খালেক, আমিনুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান ও আমীর হোসেন নামের ৫ জঙ্গী। এদের বাড়ি ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে। আস্তানাটি গড়ে তুলেছিল মৌলানা মোবারক নামের এক জঙ্গী নেতা। তার সহযোগী ছিল আজিজ। এদের এখনও ধরা যায়নি। হাটহাজারীর আল মাদ্রাসাতুল আবুবকর থেকে জঙ্গীদের গ্রেফতারের সময় বেশকিছু জিহাদী ও জঙ্গী বিষয়ক বই, সফট কপি, অডিওভিডিও উদ্ধার হয়। হাটহাজারী উপজেলার আলীপুরের সুলতান আহমেদ সড়কের এসকে সখিনা ভবনের চতুর্থ তলায় মাদ্রাসাটির অবস্থান। এ মাদাসা থেকে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীরা হচ্ছে আবদুর রহমান ইবনে আসাদ উল্লাহ, ওসমান গনি, মোস্তাকিম বিল্লাহ মাশরুর, মোঃ নাবিল হোসাইন, মোঃ সিরাজুল মুস্তফা সোলায়মান, শামীম হোসাইন ইসমাইল, মাহমুদুল হাসান, মোঃ ইুসুফ, সফিকুল ইসলাম শেখ সালাউদ্দিন, রফিকুল ইসলাম যুবায়ের, আবদুল কাইয়ুম শেখ মানসুর ইসলাম ও হারুনুর রশীদ। এ ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারি নগরীর হালিশহর এলাকা থেকে গ্রেফতার হয় কয়েক জঙ্গী। ৫ ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ॥ র‌্যাবের অনুসন্ধানে এ পর্যন্ত শহীদ হামজা ব্রিগেড নামের সংগঠনটির বিভিন্ন সদস্যের নামে ৫টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য মিলেছে। র‌্যাব সেভেনের সিও জানিয়েছেন, এসব এ্যাকান্ট নিয়ে র‌্যাবের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। তিনি জানান, সুনির্দিষ্ট কোন এ্যাকাউন্ট থেকে জঙ্গীদের কাছে টাকা যেত না। তবে হুন্ডির মাধ্যমে আসা নগদ টাকা এসব ব্যাংক এ্যাকাউন্টে রাখা হতো। হুন্ডির মাধ্যমে এ জঙ্গী সংগঠনকে কারা কারা অর্থায়ন করে আসছে তার তদন্ত চলছে। প্রসঙ্গত, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিভিন্ন সংগঠনের কাছে বিদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থের যোগান আসছে নিয়মিত। এ অর্থের মাধ্যমে এরা গোপন ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে এবং এর বিস্তৃতি ঘটছে। এছাড়া এ অর্থ দিয়ে এরা চোরাপথে অস্ত্র যোগাড় করছে। র‌্যাব সূত্রে জানানো হয়, বাঁশখালীর লটমনি জঙ্গী আস্তানা থেকে যে একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছে তা দেশের কোন নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে না। ওই আস্তানা থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী মোজাহের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল, ভারতের মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে একে-২২ রাইফেল চীন থেকে আনা হয়েছে। প্রতিটি রাইফেল প্রায় পৌনে তিন লাখ টাকা এবং প্রতিটি পিস্তল প্রায় সোয়া একলাখ টাকা হারে কেনা।
×