ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অনলাইনে সরকার উৎখাতের গোপন বৈঠক!

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

অনলাইনে সরকার উৎখাতের গোপন  বৈঠক!

বিভাষ বাড়ৈ ॥ রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে নির্বিঘেœই অনলাইন রাজনৈতিক সম্মেলন করল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর! পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গীদের এ সম্মেলন প্রতিহতের ঘোষণা দিলেও বন্ধ করা যায়নি অনালাইন সম্মেলনের নামে করা সরকার উৎখাতের গোপন বৈঠক। বেশ কয়েকদিন ধরেই এ সম্মেলনটি নিয়ে অনলাইন ও পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে আসছিল হিযবুত তাহ্রীর। সরকার উৎখাত করে জঙ্গীবাদী ইসলামী খেলাফত কায়েমের ঘোষণা দিয়ে পোস্টার লাগানো হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। তৎপরতা চালানোর সময় বেশ কয়েক জঙ্গীকে আটক করে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা সম্মেলন প্রতিহতের ঘোষণা দিলেও শুক্রবার ঠিকই কর্মসূচী পালন করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনটি। সংগঠনটির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে ব্যাপক আকারে কর্মসূচী করতে পারেনি নেতাকর্মীরা। শুক্রবার বেলা তিনটায় অনলাইনে সম্মেলনটি শুরু হয়। বেলা সাড়ে তিনটায় শুরু হয়ে সন্ধ্যা ছয়টার কিছু আগ পর্যন্ত অনলাইনে এ সম্মেলন চলতে দেখা যায়। অনলাইনে সরাসরি সম্প্রচারিত সম্মেলনে দেখা যায়, একটি কক্ষের ভেতর পাঁচজন বক্তা বসে আছেন। যারা ধারাবাহিকভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন। তাদের পেছনের দেয়ালে সম্মেলনের ব্যানার টানানো আছে। সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করেন বক্তারা। এছাড়া তারা খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। খেলাফত প্রতিষ্ঠায় তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণের কথাও বলেন বক্তারা। তবে সম্মেলনের শেষে প্রশ্নোত্তরপর্ব থাকলেও তা না করেই তড়িঘড়ি করে কর্মসূচী শেষ করতে দেখা যায় তাদের। এদিকে জঙ্গীদের এ অনলাইন জমায়েত করে বক্তব্য প্রচার বন্ধতো পরের কথা কোথায় বসে এটি করা হয়েছে তাও শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে কর্মসূচী করে নির্বিঘেœই গা ঢাকা দিতে পেরেছে তারা। র‌্যাবের লিগ্যান্ড এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের অনলাইন সম্মেলন কোথা থেকে কারা করেছে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে। পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে কারা জড়িত, কাদের নেতৃত্বে সম্মেলন হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে পুরো বিষয়টিই তাদের নজরদারির মধ্যে রয়েছে। এ ব্যাপারে গভীর অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেছেন, পুলিশী তৎপরতার কারণে অত্যন্ত গোপনে সীমিত পরিসরে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনটিকে স্বল্পসময়ের জন্য অনলাইন সম্মেলন করতে বাধ্য হয়েছে। কোথা থেকে কারা, কাদের নেতৃত্বে কিভাবে সম্মেলন করেছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। সম্মেলনের মাস্টারমাইন্ডসহ সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান চলছে। পুরো বিষয়টির ওপরই পুলিশের নজরদারির মধ্যে ছিল। চেষ্টা করলে হয়তো সম্মেলন বন্ধ করাও সম্ভব ছিল। তিনি আরও বলেন, কিন্তু কৌশলগত কারণে পুলিশের তরফ থেকে সেটি করা হয়নি। বিশেষ করে এ ধরনের জঙ্গী সংগঠনকে কোন কোন শ্রেণী পেশার মানুষ বা কোন কোন রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ অন্যান্য শ্রেণীর মানুষ সহযোগিতা করে, সেটি জানার জন্যই এবং সেইসব ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতেই কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে পুলিশ। এর আগে রাজধানীসহ চট্টগ্রাম ও অন্য জেলায় এ সংক্রান্ত পোস্টার ছড়িয়ে দিয়েছিল সংগঠনটি। হিযবুত তাহ্রীরের ‘খেলাফত আসন্ন’ শিরোনামের পোস্টার রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর হয়ে উঠে। যে কোন মূল্যে তাদের প্রতিহত করারও চ্যালেঞ্জ ছিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সাংগঠনিক কর্মকা- চালানোর কোন সুযোগ নেই। গোপনে তারা তৎপর হওয়ার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। অনলাইনে তারা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে মাঝে মধ্যে। তাদের অনলাইন সম্মেলনের বিষয়টি পুলিশের নজরে আছে। কোনভাবেই এ সম্মেলন করতে দেয়া হবে না। সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনা হবে। এর পেছনে যারা আছে তাদের ধরার চেষ্টা চলছে। হিযবুত তাহ্রীর সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে নিজেদের আদর্শ প্রচার এবং কর্মীদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করাই এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল। এতে সংগঠনের কমপক্ষে দশ শীর্ষনেতা বক্তব্য রাখার পরিকল্পনা ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত পাঁচজনকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। অনলাইনে এ সম্মেলন প্রচারিত হয় ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট ‘লাইভ স্ট্রিম ডটকম’-এর মাধ্যমে। এছাড়াও সম্মেলনকে ঘিরে চালু করা হয়েছিল ফেসবুক ইভেন্ট। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গী সংগঠন হিসেবে ছয় বছর আগে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্রীরের তৎপরতা কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে তারা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কর্মকা-। একই সঙ্গে অনলাইনে চালাচ্ছে নানা ধরনের প্রচারণা। এজন্য ওদের চালু রয়েছে একাধিক ওয়েবসাইট। অভিজাত এলাকা ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে তাদের নেটওয়ার্ক। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তারা কৌশলে এগোনোর চেষ্টা করছে। তৎপরতার অংশ হিসেবেই শুক্রবার সম্মেলনের নামে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্ন দেখছে জঙ্গী সংগঠনটি। এদিকে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে আসছে অনলাইন সম্মেলনের নানা কাহিনী। জানা গেছে, এমন পরিকল্পনা এসেছিল গাজীপুরের কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি জেলে বন্দী জঙ্গী সংগঠনটির শীর্ষনেতাদের মাথা থেকে। আর পুরো প্রক্রিয়াটির নেপথ্যে কাজ করছে যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত একটি ইসলামী দল ও বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের কারাবন্দী শীর্ষনেতারা। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেফতারকৃত হিযুবত তাহ্রীর সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে এবং অনুসন্ধানে মিলেছে এমন তথ্য। ডিবির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সম্মেলনকে ঘিরে হিযবুত তাহ্রীরের শীর্ষনেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ অন্য জঙ্গী নেতাদের সঙ্গে নানাভাবে আলোচনা করেন। এমনকি হিযবুত তাহ্রীরের কারাবন্দী ও কারামুক্ত নেতাদের সঙ্গেও আলোচনা করেন। এরপরই শীর্ষনেতারা হিযবুত তাহ্রীরের নেতাকর্মীদের কাছে এমন নির্দেশনা পাঠিয়ে দেয়। সেই নির্দেশনা মোতাবেক ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকেই সম্মেলনের জন্য কাজ করে হিযবুত।
×