ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সন্ত্রাস দমন ও অর্থনৈতিক সাফল্যই মূল কারণ হিসেবে এসেছে মার্কিন জরিপে

নেতৃত্বের গুণেই আস্থা বেড়েছে সরকারের

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

নেতৃত্বের গুণেই আস্থা বেড়েছে সরকারের

তৌহিদুর রহমান ॥ বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাস মোকাবেলার সাফল্যেই শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা বেড়েছে। এছাড়া অর্থনৈতিক অগ্রগতি, অবকাঠামো নির্মাণ, জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমন, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) জরিপের ফলের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন। তারা জরিপকে স্বাগত জানিয়ে আরও বলেন, এর ইতিবাচক ফল শেখ হাসিনার সরকারের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী এই গবেষণা সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন বেড়েছে। অধিকাংশ মানুষই মনে করে, বাংলাদেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে। তবে দুর্নীতিকে তারা চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে। জরিপের ফলের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইআরআই একটি বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাদের জরিপের ফল শেখ হাসিনা সরকারের জন্য একটি বিশেষ অগ্রগতি। জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিএনপি-জামায়াত জোটের সংঘাত থেকে দেশকে বেরিয়ে এনে সঠিক পথে পরিচালিত করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বেড়েছে। জরিপে সেই বিষয়টিই উঠে এসেছে। এছাড়া বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক অগ্রগতি, অবকাঠামো নির্মাণ, জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমন, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যই তাদের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। জরিপের ফলের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, জরিপে সাধারণ মানুষের অভিমত প্রতিফলিত হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের সংঘাত থেকে দেশ বেরিয়ে আসায় শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। নির্বাচন ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। জরিপে সেই বিষয়টিই উঠে এসেছে। এই জরিপ শেখ হাসিনা সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এটাকে স্বাগত জানান অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। চলতি বছর ২৩ মে থেকে ১০ জুন আড়াই হাজার প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের ওপর চালানো মতামত জরিপের ফল বুধবার প্রকাশ করে আইআরআই। তাদের হয়ে জরিপটি পরিচালনা করেছে নিয়েলসন-বাংলাদেশ। আইআরআই গত ত্রিশ বছর ধরে বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছে। ৫ জানুয়ারির পর গত দেড় বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের প্রতি জনসমর্থন যথাক্রমে ৬৭ ও ৬৬ শতাংশে পৌঁছেছে বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়। উত্তরদাতাদের ৬০ শতাংশ বলেছেন, তারা আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন। ঠিক একইসংখ্যক উত্তরদাতা জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীকে অপছন্দ করার কথা বলেছেন। আর বিএনপিকে যত লোক পছন্দ (৪২ শতাংশ) করার কথা বলেছেন, তার চেয়ে অপছন্দ (৪৬ শতাংশ) করার কথা বলেছেন বেশি উত্তরদাতা। গণতান্ত্রিক সংস্কার, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, তরুণের অংশগ্রহণ, নারীর প্রতি দায়িত্ববোধ, বিশ্বাসযোগ্যতা, ইতিবাচক নীতি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং দুর্নীতি দমনে কোন্ দলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ বেশি আস্থা রাখছে তাও জানতে চেয়েছিলেন জরিপকারীরা। উত্তরে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ভাগেই বিএনপির চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ। যেখানে ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা আওয়ামী লীগে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আছে বলে মনে করছেন, সেখানে বিএনপির পক্ষে বলেছেন ২২ শতাংশ। শিক্ষা, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, জাতীয় নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জাতিগত বিভাজন দূর করার ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগকে বিএনপির তুলনায় বেশি সক্ষম বলে মনে করেন অধিকাংশ উত্তরদাতা। অধিকাংশ উত্তরদাতা বর্তমান সরকারের প্রতি আস্থার কথা বললেও আগামী নির্বাচন কখন হওয়া উচিত, সে প্রশ্নে গত বছরের তুলনায় সাধারণ মানুষের অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীর ৪৩ শতাংশ বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচন হওয়া উচিত। অন্যদিকে ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা বর্তমান সংসদকে পুরো মেয়াদ দায়িত্ব পালন করতে দেয়ার পক্ষে বলেছেন। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আইআরআইয়ের জরিপে একই প্রশ্ন করা হয়েছিল। সে সময় ৪৫ শতাংশ উত্তরদাতা বর্তমান সংসদের মেয়াদ পূর্ণ করার পক্ষে বলেছিলেন; আর ৪০ শতাংশ বলেছিলেন, তারা যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন চান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে জনসমর্থন কমলেও এখনও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন দেখতে চায় বলে আইআরআইয়ের এই জরিপে উঠে এসেছে। চলতি বছর জুনে এই জরিপে অংশগ্রহণকারীর ৬৭ শতাংশ বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা উচিত। অন্যদিকে ২২ শতাংশ উত্তরদাতা এর বিরোধিতা করেছেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে যখন নির্বাচন হয়, ওই মাসে আইআরআইয়ের জরিপে ৭৭ শতাংশ উত্তরদাতা তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে এবং ১৮ শতাংশ বিপক্ষে বলেছিলেন। দেশ সঠিক পথে, দেশ যেভাবে চলছে তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন জরিপের অধিকাংশ উত্তরদাতা। ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, দেশ সঠিক পথেই এগোচ্ছে, যেখানে ৩৬ শতাংশ উল্টোটা মনে করেন। ২০১৩ সালের নবেম্বরে এই প্রশ্নে ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছিলেন, বাংলাদেশ ভুল দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে ইতিবাচক মত দিয়েছিলেন ৩৩ শতাংশ উত্তরদাতা। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে খুব ভাল বলেছেন ২৮ শতাংশ উত্তরদাতা, ৪৪ শতাংশ বলেছেন ভাল। ১২ শতাংশ অর্থনীতি নিয়ে একেবারেই সন্তুষ্ট নন। জরিপে অংশগ্রহণকারীর ৬৮ শতাংশ নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ৬৪ শতাংশ মনে করেন, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। এই স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে বলে আশা করছেন ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা। জরিপে অংশগ্রহণকারীর ২৪ শতাংশ দুর্নীতিকে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা বলে মনে করেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবকে ১৬ শতাংশ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ১৫ শতাংশ উত্তরদাতা বড় সমস্যা বলে মনে করছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীর ১১ শতাংশ বলেছেন, সরকারী সেবা নিতে তাদের ঘুষ বা উপহার দিতে হয়েছে। তাদের ৫৩ শতাংশের ভাষ্য অনুযায়ী, ঘুষের অঙ্ক ছিল পাঁচ হাজার টাকার বেশি। ৬৮ শতাংশ উত্তরদাতা উন্নয়নের চেয়ে গণতন্ত্রকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা বললেও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ যেভাবে চলছে তাতে সন্তুষ্ট নন ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা। ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টির কথা বলেছেন। আর পুলিশের কাজে সন্তুষ্ট নন ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা। সেনাবাহিনী, র‌্যাব, আদালত ও নির্বাচন কমিশন যেভাবে চলছে তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন যথাক্রমে ৮৬, ৭৬, ৭৩ ও ৫৯ শতাংশ উত্তরদাতা। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কাজকে ৮৩ ও ৮০ শতাংশ উত্তরদাতা ‘ইতিবাচক’ বলে মনে করছেন। উল্লেখ্য, আইআরআই ত্রিশ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বিষয়ে জরিপ চালিয়ে এলেও ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সুশাসন নিয়ে জরিপ চালিয়ে আসছে।
×