ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঈদকে সামনে রেখে অস্ত্র চোরাচালানী চক্রের তৎপরতার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ঈদকে সামনে রেখে অস্ত্র চোরাচালানী চক্রের তৎপরতার আশঙ্কা

শংকর কুমার দে ॥ সীমান্ত পথে অবৈধভাবে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রবেশ করে। ঈদকে সামনে রেখে অস্ত্র চোরাচালানী চক্রের তৎপরতার আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থা। এ সময়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করার উদ্দেশ্যে আন্ডারওয়ার্ল্ডে এই ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যায়। এজন্য সীমান্ত পথে সতর্ক অবস্থায় ও নজরদারী শুরু করেছে বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, দেশের সীমান্ত এলাকার নির্দিষ্ট পয়েন্ট দিয়ে অবাধে ঢুকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। সম্প্রতি র‌্যাব যশোরের বেনাপোল ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্ত পয়েন্ট থেকে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ ৪ জন অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে। মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ও যশোর সীমান্ত এলাকার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের ঘটনা ধরা পড়েছে। এছাড়া দেশের আরও কয়েকটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের খবর রয়েছে। মেহেরপুরের গাংনীর থানার সীমান্তবর্তী সর্দারপাড়া গ্রাম ও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বিলগাথুয়া, জামালপুর, পাকুড়িয়া ভাঙ্গাপাড়া, মুন্সিগঞ্জ, চর মোহাম্মদপুর, চল্লিশপাড়া, ছলিমেরচর, গোড়েরচর, মরারচর, বাংলাবাজার এলাকা দিয়ে শতাধিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের ঘটনা ঘটেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা, বিনোদপুর, পোল্লাডাঙ্গা, বকচর, হাকিমপুর, বাখর আলী, বাগডাঙ্গা, মাসদুপুর, শিংনগর, মনোহরপুর, রঘুনাথপুর, কিরণগঞ্জ ও চৌকা এলাকার প্রায় ১০ কিলোমিটার সীমান্ত দিয়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের একটি অন্যতম রুট। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, কুমিল্লার বিবিরবাজার, চৌদ্দগ্রাম, ফেনীর বিলোনিয়া ও আমতলী এলাকা, দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ, বিরল, ফুলবাড়ী ও নওগাঁর ধামুরহাটের সীমান্তবর্তী ৩টি গ্রাম দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করে। এসব ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীদের ধরার অভিযান চালানোর পাশাপাশি সিমান্তে সতর্ক অবস্থা ও নজরদারী শুরু করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র জানান, দেশের অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দুর্ধর্ষ অপরাধীদের হাতে চলে আসা এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ এখন খুবই বিপজ্জনক মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। অবৈধভাবে আসা এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে ভয়ংকর ধরনের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা। শুক্রবার রাতে রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকায় সানোয়ারা গ্রুপের ম্যানেজার ওবায়দুল হককে গুলিতে খুন করে তার সঙ্গে থাকা ল্যাপটপ, ফোন ও টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা। সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা অবৈধভাবে আনা আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করেছে বলে তদন্তে পেয়েছে পুলিশ। রাজধানীতে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রাজধানীর বাড্ডায় গুলিতে ফোর মার্ডার, ওয়ারীতে ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যাসহ বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এই ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দারা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী থেকে সম্প্রতি উদ্ধার করা হয়েছে অর্ধ শতাধিক ক্ষুদ্রাকৃতি আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ। উদ্ধারকৃত ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর মধ্যে ভারত, ইতালি, চেকোশ্লোভাকিয়া, ব্রাজিল, আর্মেনীস, ইউএসএ ও জার্মানির তৈরি বলে জানা গেছে। উদ্ধারকৃত অবৈধ এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডে প্রবেশ করেছে হাত বদল হয়ে। প্রায়শ সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে অস্ত্র প্রবেশ করার পর তা ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলে যাচ্ছে। অবৈধ ও বৈধ পথে আসা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দেশের ভেতরে প্রবেশের পর চলে যাচ্ছে অপরাধীদের দখলে। অপরাধীরা প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এই ধরনের ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে মানুষজনের জানমাল বিনষ্ট করছে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র সীমান্ত পথ দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাওয়ার পর আন্ডারওয়ার্ল্ডে বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও ঝনঝনানি। এই ধরনের ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র এখন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানান, দেশের সীমান্ত পথে অবৈধভাবে প্রবেশ করছে ইউএসএ, জার্মানি, ভারত, ইতালি, চেকোশ্লোভাকিয়া, ব্রাজিল, আর্মেনীস আরও কত কি দেশের তৈরি অত্যাধুনিক ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ। আন্ডারওয়ার্ল্ডে এখন সবচেয়ে বেশি মজুদ রয়েছে সাত দশমিক ৬৫ বোরের পিস্তল। এছাড়া টুটু বোর, সাত দশমিক ৬২ বোর, নাইন এমএম পিস্তলের মজুদও রয়েছে অনেক। সাত দশমিক ৬৫ বোরের পিস্তলের সাত ইঞ্চি ও পাঁচ ইঞ্চি নামে দুটি ভাগ রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ ইঞ্চির ক্ষুদ্রাস্ত্রটির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এটি শরীরের সঙ্গে সহজেই বহন করা যায় বলে আন্ডারওয়ার্ল্ডেও এর চাহিদা ব্যাপক। এসব আগ্নেয়াস্ত্র হাত বদল হয়ে চলে যাচ্ছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন গ্রুপের কাছে। অস্ত্রের বাজারের দামও এখন চড়া। ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে ছিনতাইকারীরাও এখন অস্ত্রের মজুদ বাড়াচ্ছে। যেসব অস্ত্র আগে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো, সেসব অস্ত্র এখন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্যাডারদের কাছে বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে। বেড়ে গেছে গুলির দামও। একটি অস্ত্রের সঙ্গে দুটি ম্যাগাজিনে ১০ রাউন্ড গুলি দেয়া হয়। এর বাইরে প্রতি পিস গুলি (বিভিন্ন ধরনের) এখন ৫শ’ টাকা থেকে হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশের চিহ্নিহ্নত সীমান্ত পয়েন্ট দিয়েই ঢুকছে এসব আগ্নেয়াস্ত্র। এসব আগ্নেয়াস্ত্রের প্রবেশ স্থল ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। আর এসব আগ্নেয়াস্ত্র কোনটি ভাড়ায় ছিনতাই, ডাকাতি অথবা কিলিং মিশনে ব্যবহার হচ্ছে। আগ্নেয়াস্ত্রের নিয়ন্ত্রকদের কেউ কেউ দেশের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। দেশের বাইরে অবস্থানরত নিয়ন্ত্রকরা সিগন্যাল দিলেই ভাড়ায় আগ্নেয়াস্ত্রের সাময়িক হাত বদল হয়। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে ফেরারী সন্ত্রাসীরাই নিয়ন্ত্রণ করছে এসব আগ্নেয়াস্ত্র। প্রতি ঈদের আগে অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা ও বাজার তুঙ্গে ও রমরমা হয়। রাজধানীতে সম্প্রতি খুন, হত্যা চেষ্টা, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ঘটনায় আন্ডারওয়ার্ল্ড আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
×