ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এরা আমার ছাত্র হলে গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত আমার ॥ জাফর ইকবাল

ইয়াসমিন হকসহ শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলল ছাত্রলীগ ॥ ক্ষমার অযোগ্য

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৩১ আগস্ট ২০১৫

ইয়াসমিন হকসহ শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলল ছাত্রলীগ ॥ ক্ষমার অযোগ্য

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ উপাচার্য অপসারণের দাবিতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর রবিবার ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে। এতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দেশবরেণ্য লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সহধর্মিণী অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন হকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত শিক্ষক শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় ক্ষোভ, ঘৃণা আর দুঃখে প্রতিবাদের ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। পিতৃ-মাতৃতুল্য শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার মতো এ ঘটনায় সবাই বিমূঢ়। ক্ষমার অযোগ্য এমন জঘন্য ঘটনাটিও ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ। সম্প্রতি তারা একের পর এক ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে। ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে পিটিয়ে শিশুহত্যার পর বেপরোয়া ছাত্র লীগ আবার এই ঘটনা ঘটাল। বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ব ঘোষিত একাডেমিক কাউন্সিল ঠেকাতে রবিবার সকাল ৯টা থেকেই প্রশাসনিক ভবন-২ (উপাচার্য ভবন)-এর সামনে অবস্থান কর্মসূচী ছিল আন্দোলনকারী ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ’ শিক্ষক পরিষদের। অন্যদিকে শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচী ঠেকাতে সকাল ৭টা থেকে একই স্থানে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। পরে সকাল সাড়ে ৭টায় আন্দোলনকারী শিক্ষকরা উপাস্থিত হলে ছাত্রলীগের সঙ্গে বাগ্্বিত-া হয়। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা নিজেদের সাধারণ শিক্ষার্থী বলে দাবি করে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সঙ্গে বাগ্্বিত-ায় লিপ্ত হয়। ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি আবু সাঈদ আকন্দ, সহ-সভাপতি অঞ্জন রায় ও যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজ এই হমলায় নেতৃত্ব দেন। সকাল আটটায় উপাচার্য তার কার্যালয়ে উপস্থিত হলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা এ সময় উপাচার্যকে তার কার্যালয়ে প্রবেশ করতে বাধা দিতে চাইলে ছাত্রলীগ কর্মীরা মিছিল করে জোরপূর্বক উপাচার্যকে নিয়ে তার কার্যালয়ে প্রবেশ করে। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ‘শাবিপ্রবির মাটি/ছাত্রলীগের ঘাঁটি’সহ জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় তারা শিক্ষকদের ব্যানারও ছিনিয়ে নেয় এবং শিক্ষকদের গলা ধাক্কা দিয়ে এবং মারধর করে সরিয়ে দেয়। তাদের ধাক্কায় ড. জাফর ইকবালের স্ত্রী অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক মাটিতে পড়ে যান। এ সময় শিক্ষকদের লাথি মারতেও দেখা যায় ছাত্রলীগ কর্মীদের। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের লাঞ্ছনার শিকার হন আন্দোলনকারী শিক্ষক ড. ইয়াসমীন হক, দীপেন দেবনাথ, সৈয়দ সামসুল আলম, মোঃ ফারুক উদ্দিন, মোস্তফা কামাল মাসুদ, মোহাম্মদ ওমর ফারুকসহ আরও কয়েকজন। হামলায় হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হন অধ্যাপক ড. মোঃ ইউনুছ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর ও পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতেই এ ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগের হামলার পর অধ্যাপক ইয়াসমিন হক সাংবাদিকদের বলেন, এই যে পরিবেশ নষ্ট করা হলো তার জন্য উপাচার্যই দায়ী থাকবেন। সকালে হামলা করার জন্য রাতে উপাচার্য ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন বলেও অভিযোগ করেন পদার্থ বিদ্যার এই শিক্ষক। অন্যদিকে উপাচার্য আমিনুল হক ভুঁইয়া বলেন, শিক্ষকরা তাকে কার্যালয়ে ঢুকতে না দেয়ার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। যদিও পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জনিয়েছে। যাতে বলা হচ্ছে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক স্বার্থে সে ব্যাপারে সভার পক্ষ থেকে সকল মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। শিক্ষকদের ওপর হামলার পর ক্ষোভ আর ঘৃণায় দগ্ধ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, জীবনে কখনও কল্পনাও করিনি আজকের এই দৃশ্য আমাকে চোখে দেখতে হবে। এখানে শিক্ষকদের ওপর যে ছাত্ররা হামলা চালিয়েছে, যদি তারা আমার ছাত্র হয়ে থাকে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া উচিত। তিনি বলেন, যে জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই জয় বাংলা সেøাগানের এত বড় অপমান আমি জীবনে দেখিনি। আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও এই আন্দোলনে তার সমর্থন রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা যে কারণে আন্দোলন করছে আমি তা ১০০ ভাগ সমর্থন করি। উপাচার্য যোগদানের দু’মাসের মাথায় তিনি উপাচার্যের সঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমি দেখেছি উনি মিথ্যা কথা বলেন। যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলেন তার সঙ্গে আমার কাজ করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমার জীবনে একটি নতুন অভিজ্ঞতা হলো। আজ যা দেখলাম আমার জীবনে তা দেখব কোন দিন কল্পনাও করিনি। কিভাবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমার শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করতে পারল, সেটা আমাকে এখানে বসে বসে দেখতে হলো। তিনি অভিযোগ করেন, উপাচার্যই ছাত্রলীগকে শিক্ষকদের ওপর ‘লেলিয়ে’ দিয়েছেন। তিনি যদি মনে করেন, এভাবে আন্দোলন থামানো সম্ভব, তবে সেটা ভুল করছেন। শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন কোন পদের জন্যে নয়, শাবিকে বাঁচানোর জন্যে। এ সময় অভিমানে আঝোর ধারায় বৃষ্টিতে ভিজে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন তিনি। লজ্জা আর ঘৃণা তার চোখে মুখে ফুটে উঠে। অন্য শিক্ষকদের মাথায় ছাতা থাকলেও জাফর ইকবাল ছাতা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ভবনের সামনে বসে থাকেন। অন্য শিক্ষকরা তার পাশে এসে জড়ো হন। সবাই ছিলেন হতবাক। এমন ঘটনায় সবাই যেন প্রতিবাদের ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন। কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ এনে উপাচার্য অধ্যাপক আমিনুল হক ভূইয়ার অপসারণ দাবিতে গত ১৩ এপ্রিল থেকে আন্দোলন করে আসছে সরকার সমর্থক শিক্ষকদের একাংশের জোট ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ’। পুলিশের উপস্থিতিতে হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আখতার হোসেন কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে শাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই উপাচার্য নিয়োগ পেয়েছেন। তার সুরক্ষায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমরা অবস্থান নিয়েছি। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের নেতা ফারুক আহমদ বলেন, ছাত্রলীগ বর্বরোচিতভাবে হামলা চালিয়েছে। শিক্ষকদের ওপর এই হামলার ঘটনা পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কিত করেছে। সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত আন্দোলনকারী শিক্ষকরা কখনও একত্রে কখনও বিচ্ছিন্নভাবে উপাচার্য ভবনের সামনে অবস্থান করে এক পর্যায়ে স্থান ত্যাগ করে চলে যান। সকাল ১০টায় শিক্ষকদের নিয়ে পূর্বনির্ধারিত এ্যাডভান্সড স্টাডিজ বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেল ৩টায় একাডেমিক কাউন্সিলের সভা শুরু হয়। এই সভায় ৫৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩৯ জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। ক্যাম্পাসে প্রচুরসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলবস্থা কাটাতে দুই পক্ষের সঙ্গেই বৈঠক করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। নিয়োগ, নতুন ব্যবস্থা চালু বা কাউকে নতুন কোন পদে দায়িত্ব দেয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী সবাইকে সমঝোতার মাধ্যমে আন্দোলন না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। শাবির বক্তব্য ॥ রবিবারের ঘটনায় শাবি প্রশাসন বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ৩০ আগস্ট, ২০১৫ তারিখ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্বনির্ধারিত ‘এ্যাডভান্সড স্টাডিজ বোর্ডে’র সভায় অংশগ্রহণের জন্য অফিস সময়ে ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোঃ আমিনুল হক ভূইয়া নিজ দফতরে প্রবেশের সময় কয়েক শিক্ষক তাকে বলপূর্বক বাধা প্রদান ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে এবং ‘এ্যাডভান্সড স্টাডিজ বোর্ডে’র কয়েকজন সম্মানিত সদস্যকে সভায় যোগদানে বাধা প্রদান করে। উক্ত ঘটনায় এ্যাডভান্সড স্টাডিজ বোর্ডের সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক স্বার্থে সে ব্যাপারে সভার পক্ষ থেকে সকল মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আজ অর্ধদিবস কর্মবিরতি ॥ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সোমবার অর্ধদিবস কর্মবিরতি ও কালো ব্যাজ ধারণের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষক পরিষদ রবিবার ৯ থেকে ৫টা পর্যন্ত শিক্ষকদের ভিসি বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে সোমবারের এ কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। ছাত্রলীগের বক্তব্য ॥ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের কেউ জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ দাবি করেছে, ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিয়ে দলে অনুপ্রবেশকারীরা হামলা চালাতে পারে। এ সময় সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ জানান, আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনায় তার দলের নেতাকর্মীরা জড়িত নন। কেউ যদি এতো জড়িত থাকেন তবে তার দায় নিজেকেই নিতে হবে। পার্থ আরও বলেন- শিক্ষকদের আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। আমাদের ওপর মিথ্যা, বানোয়াট যে অভিযোগ উঠেছে তা খুবই দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে করে থাকে তবে তার দায়ভার একান্ত ব্যক্তিগত। তারপরও যদি ছাত্রলীগের কোন সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তবে সাংগঠনিকভাবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ দাবি করেন- কিছু অনুপ্রবেশকারী ‘জয় বাংলা’ সেøাগান ব্যবহার করে এই হামলা করতে পারে। তবে দলে কোন অনুপ্রবেশকারী থাকতে পারে চিন্তায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে জড়িতদের পরিচয় বের করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। শাবি ছাত্রলীগ সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে রয়েছেন সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু সাইদ আকন্দ, সহ-সভাপতি অঞ্জন রায়, ১ম যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজ, সাধারণ সম্পাদক ইমরান খান।
×