ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফয়জুল আলম পাপ্ পু

জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ৩১ আগস্ট ২০১৫

জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি

ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী বাংলা লোকসঙ্গীতের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি আশৈশব বাংলাদেশের গ্রাম-বাংলার শ্যামল প্রকৃতি এবং সাধারণ মানুষের আনন্দ, উৎসব, হাসি ও কান্নার মতো বিষয়গুলোকে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। যা পরবর্তীতে তাঁর লেখা, সুর করা ও গীত গানে দেখা যায়। তাঁর গানের কথা মানুষের মনে দাগ কাটত, মন জয় করত। লোকগান বাঙালীর প্রাণের গান, দোতারা বাংলাদেশের মানুষের লোকবাদ্য। তিনি এই লোকগান ও লোকবাদ্যের মধ্যে এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। তাঁর গানের কথা আর সুরের জাদুতে একদিকে যেমন বিরহী বধূর মর্মবেদনা জীবন্ত হয়ে উঠেছে, তেমনি মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেম ও ভক্তির এক চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে। অসাধারণ সঙ্গীতসাধক, গবেষক এই গুণী ছিলেন একজন প্রকৃত শিল্পী গড়ার কারিগর। তিনি কয়েক হাজার গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং গেয়েছেন। তাঁর নিজের গাওয়া ও সুর করা গান বাংলাদেশ ও ভারতে অসম্ভব জনপ্রিয়। তাঁর কাছে গান শিখে বা তাঁর গান পরিবেশন করে বহু শিল্পী খ্যাতিমান হয়েছেন। যেমনÑ ফেরদৌসী রহমান, আবদুল আলীম, রুনা লায়লা, রেহানা ইয়াসমিন, নিলুফার ইয়াসমিন প্রমুখ। ভারতের শচীন দেববর্মণ এবং পূর্ণ দাশ বাউলও তাঁর সুরে কয়েকটি গান করেছিলেন এবং সেগুলো যথেষ্ট লোকপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর সাহচর্যধন্য আর একজন হলেন খ্যাতিমান সুরকার, গীতিকার, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব সঙ্গীতশিল্পী খান আতাউর রহমান। মোমতাজ আলী খান অনেক গুণী গীতিকারের গানে সুর করেছেন। যেমনÑ জসীমউদ্্দীনের উজান গাঙ্গের নাইয়া/ভাটি গাঙ্গের নাইয়া;/নিশীথে যাইয়ো ফুল বনে, রে ভ্রমরা প্রভৃতি। ফকির লালন সাঁইয়ের বাড়ির কাছে আরশিনগর, তোরা দেখবি যদি আয়।/ কালু শাহ ফকিরের আগে জানি নারে দয়াল, নিরিখ বান্ধরে দুই নয়নে/ভুইল না মন তারে প্রভৃতি। চলচ্চিত্রে গায়ক, সুরকার ও গীতিকার হিসেবেও মোমতাজ আলী খান তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি কলকাতায় চিত্রায়িত ‘অভিযাত্রী’, তৎকালীন পাকিস্তান আমলের ‘আকাশ আর মাটি’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘রূপবান’, ‘জোয়ার ভাটা’, ‘যে নদী মরু পথে’, ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে সুর সংযোজন বা পরিচালনা কিংবা কণ্ঠদান করেন। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর ‘দয়াল মুর্শিদ’, ‘সুজন সখী’, ‘অনেক দিন আগে’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘লালন ফকির’, ‘নিমাই সন্ন্যাসী’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র মোমতাজ আলী খানের অনন্য প্রতিভাদীপ্ত গীত-সুর ও পরিচালনার স্বাক্ষর বহন করছে। তিনি আমৃত্যু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত পরীক্ষার লোকসঙ্গীত বিষয়ের অন্যতম পরীক্ষক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড ঢাকার লোকসঙ্গীত বিষয়ের প্রশ্নকর্তা এবং পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা লোকসঙ্গীতের এই প্রবাদ পুরুষ সুরসম্রাট ওস্তাদ মোমতাজ আলী খানের জন্ম ১৯১৫ সালের ১ আগস্ট মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার ইরতা কাশিমপুর গ্রামে। জীবনের অনেক চড়াই-উতরাইয়ের দীর্ঘ যাত্রায় তিনি সাহচর্যধন্য হয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের। এই মহান সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব তাঁর রচিত ও সুরারোপিত অসংখ্য গান, এলপি রেকর্ড, শিষ্য, গুণগ্রাহীদের রেখে ৭৫ বছর বয়সে ১৯৯০ সালের ৩১ আগস্ট পরলোকগমন করেন। তিনি তাঁর ৬ কন্যা দীপু মোমতাজ, পিলু মোমতাজ, রুপু খান, এ্যানী মোমতাজ, লোরা মোমতাজ এবং মিতি মোমতাজকে রেখে যান। মানুষ হিসেবে ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান ছিলেন অত্যন্ত মহৎ মনের। নিরহঙ্কারী আজীবন প্রচারবিমুখ এই মহৎ ব্যক্তিত্ব সঙ্গীতাঙ্গনে যেমনিভাবে নিজেকে আড়াল করে রাখতে পছন্দ করতেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য ভূমিকার কথা কখনও প্রচার করতে চাননি। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সংগ্রহে থাকা নিজ কণ্ঠে, নিজ পরিচালনায়, নিজের সুরে অন্য শিল্পীর কণ্ঠে গীত অসংখ্য লংপ্লে রেকর্ড নষ্ট হয়ে যায় বা হারিয়ে যায়। এই অমূল্য সম্পদগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হলে আমরা তাঁর সঙ্গীতবিষয়ক আরও নানা গুণ ও প্রতিভার পরিচয় পেতাম এবং তাঁকে নিয়ে বা তাঁর জীবন-দর্শন নিয়ে গবেষণাকর্ম পরিচালনা করা সহজতর হতো। এ বছর ওস্তাদ মোমতাজ আলী খানের জন্মশতবর্ষ চলছে। তাঁর শতবর্ষের এ লগ্নে দাঁড়িয়ে আমরা তাঁর মতো গুণী ও প-িত মানুষ সম্বন্ধে যত বেশি করে জানব বা পড়াশোনা করব, ততই তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানো হবে। লেখক : আবৃত্তিশিল্পী ও গবেষক
×