ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চাঁদাবাজির নানামুখী কৌশল- ঈদ বকশিশ, উপরি

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৫ জুলাই ২০১৫

চাঁদাবাজির নানামুখী কৌশল- ঈদ বকশিশ, উপরি

শংকর কুমার দে ॥ ‘ঈদের সালাম, ঈদ বকশিশ’। উপরি আদায়ের জন্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের এক ধরনের চাঁদাবাজির কৌশল। ঈদ ঘনিয়ে এলেই, ধুম পড়ে যায় এ ধরনের চাঁদাবাজির। পুলিশ, কাস্টমস, ইনকামট্যাক্স, ভ্যাট, গ্যাস, বিদ্যুত, টেলিফোনসহ সেবা প্রতিষ্ঠানের সবাই এ নিয়েই মহাব্যস্ত। সন্ত্রাসী, মস্তান, রাজনৈতিক ক্যাডার কেউই কম যান না। শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদাবাজির এই কৌশলটি মারাত্মক আতঙ্ক। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে উপরি আদায়ের জন্য বকশিশ নেয়ার মৌসুমি চাঁদাবাজির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ উপরি বা বকশিশের নামে চাঁদাবাজির আদায়ের তালিকায় শীর্ষে। রোগ বুঝে যেমন ওষুধ তেমনি কার কাছে উপরি বা বকশিশ চাইতে হবে তা তাদের জানা। আর যদি কেউ মামলা মোকদ্দমা কিংবা কোন ঝামেলায় থাকে তাহলে তাকে নানা ধরনের প্রলোভন বা ভয়ভীতি দেখানো হয়। পুলিশের সঙ্গে কাস্টমস, ইনকামট্যাক্স, ভ্যাট, বিদ্যুত, গ্যাস, টেলিফোন, ওয়াসা, ডেসার মত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যান এলাকাভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে। সারা বছরের সেবাদানের ওসুল তোলার জন্য একথা সেকথায় বলে অনুনয় বিনয় আবদারের সুরে আসল কথাটা বলেন, ‘আমরা ঈদের সময়ে পেয়ে থাকি’। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পুলিশ, কাস্টমস, ইনকামট্যাক্স, ভ্যাটের কর্মকর্তাদের সুর আবার একটু ঝাঝালো। তাদের ঝাঝালো সুরে থাকে ফাঁসিয়ে দেয়ার মতো প্রচ্ছন্ন হুমকির ইঙ্গিত। ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা সব সময়ই ঈদ বকশিশের নামে বাড়তি সুবিধা পায়। অবস্থা বেগতিক হলে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন স্থানে সমিতি সংগঠনের নাশে ফান্ড করে চাঁদাবাজির দাবি মিটাতে হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগীরা বলেন, সন্ত্রাসী, মস্তান ও রাজনৈতিক ক্যাডাররা যেভাবে বকশিশ নামের চাঁদা আদায়ের কৌশল নানা ধরনের। তারা ঈদ বকশিশের জন্য টেলিফোন করেন। মামা, চাচা বা ভাইজান সম্বোধন করেন। বলেন, ঈদ করাবেন না ? নরম কথায় কাজ না হলে গরম কথায় ভয়ভীতি দেখানো হয়। যেই ব্যবসায়ী যত বড় তার কাছে বকশিশ বা চাঁদার অংকের হাক ডাক পড়ে তত বেশি। যেই মস্তান যত বড় তার চাঁদাবাজির নজরানাও তত বড়। ব্যবসায়ীদের অনেকেই ঝক্কি ঝামেলা এড়াতে কম বেশি যা হোক একটা অংকের টাকার সমঝোতায় এসে মিটমাট করার চেষ্টা করতে হয়। রাজধানীর বঙ্গবাজারের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান, রোজার ঈদের সময়ে কাপড় কেনাবেচা হয় বেশি। এজন্য ভারতীয় কাপড়ের নামে পুলিশ ও কাস্টমসের লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। মাঝে মধ্যেই তারা হানা দেয়। অনেক সময়ে গোপনে সমঝোতা করে ফেলতে হয়। সমঝোতা না হলে মিডিয়ায় চলে আসে ভারতীয় কাপড়ের চোরাচালানের আটকের ঘটনা। তখন আর সামাল দেয়া সম্ভবপর হয় না। সমঝোতা করতেই হয়। যদি ব্যতিক্রম ঘটে তাহলে, ‘আমও যায়, ছালাও যায়’। শ্যামপুরের এক ব্যবসায়ী বলেন, সাদা পোশাকে কয়েক সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এসে গেছেন। তাদের দাবি এবার নিজেদের কথার চেয়ে তাদের দাবি এবার বড় সাহেবদের ঈদ করাতে হবে। এবারের ঈদের বকশিশের অংকটাও একটু বেশি দেয়ার জন্য বলে গেছেন, আবদারের সুরে। ব্যবসায়ীর কথা, আবদারের সুরটায় যদি কাজ না হয়, তবে বড় ধরনের কাফরা দিতে হবে, এটা প্রায় নিশ্চিত। সুতরাং আবদার রক্ষা করে সম্পর্ক রক্ষা করার জন্য কাফরা দিচ্ছি। যাত্রাবাড়ীর এক ডায়িং ফ্যাক্টরির মালিক জানান, ঈদের আগেই চাঁদাবাজির শিকার তিনি ও তারা মতো এলাকার আরও ব্যবসায়ী। কয়েক সন্ত্রাসী এসে বলে গেছে, তাদের ঈদ করাতে হবে। এক ডায়িং ফ্যাক্টরির মালিকের অভিযোগ, শুধু টাকাই নয়, ঈদের সময়ে তাদের কাপড় দিতে হবে। তিনি বলেন, আমি কাপড়ের রং করি। কাপড় পাব কোথায়? এটা বুঝিয়ে বলার পরও বোঝানো যাচ্ছে না। তারা বলছে, কাপড় নিয়ে গরিবদের যাকাত দিবে। রি-রোলিং মিলের এক মালিক বলেছেন, তার কাছে এক ভ্যাট অফিসার এসে বলে গেছেন, তার অফিসে দেখা করার জন্য। তিনি জানালেন, এমনিতেই ব্যবসার মন্দা। এখন ভ্যাট অফিসারের ঈদ বকশিশের দাবি মিটানো যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির এক মালিক জানালেন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য খবর পাঠিয়েছেন। দেখা করা মানেই টাকা পয়সা দেয়ার দাবি। ইনকামট্যাক্সের এক এক কর্মকর্তা এক কাপড়ের ব্যবসায়ীর কাছে এসে খবর নিয়ে গেছেন তিনি ইনকামট্যাক্স দেন কিনা? তবে যাদের সেবা খাতের বিষয়ে সারা বছরের বিল পরিশোধ কিংবা অন্য কোন বিষয়ে ফাঁকফোকর আছে তাদের সেবা খাতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ঈদের বকশিশ দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতে হবে, নিজের সুবিধার্থেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ৪৯ থানা এলাকায় ডেসা, ওয়াশা, টেলিফোন, বিদ্যুতসহ সেবা খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে যার মতো সালাম দিয়ে উপরি বা বকশিশ আদায়ের জন্য যেন প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। মস্তানদের সঙ্গে সরকারী সংস্থার লোকজনদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। সকলেরই একটই উদ্দেশ্য, ঈদের বকশিশ বা উপরি। তবে গত বছরের ঈদের তুলনায় এবারের ঈদে উৎপাত একটু কম। বিশেষ করে টপটেররদের নাম ভয়ভীতি প্রদর্শনের টেলিফোনে চাঁদাবাজি আদায়ের আতঙ্ক নেই। সরকারী দলের নাম ভাঙিয়ে মস্তানদের চাঁদাবাজি আদায়ের কৌশল হিসেবে বকশিশ চাওয়া শুরু হয়ে গেছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, সংবাদ মাধ্যমে নাম প্রকাশ করা হলে জীবন নিয়েই টান দিতে হতে পারে। সংবাদ মাধ্যমে তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ঈদ ঘনিয়ে এলে আর অফিসে যাই না। অফিসে থাকলেই চাঁদাবাজদের আতঙ্ক। লুকিয়ে থাকি। টেলিফোনে কাজকর্ম সেরে নেই। আরেক ব্যবসায়ী জানালেন, কেউ বুঝতে যাতে বুঝতে না পারে সেই জন্য অফিস করলেও বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে রাখি। অফিসের সহকারীরা বলে দেয়, সাহেব আসেনি। মোবাইল টেলিফোন সেইভ করা নাম্বার ছাড়া অপরিচিত নাম্বারে কল ধরি না। উপরি বা বকশিশ যে যাই বলুক না কেন আসলে এটা ঈদ আসলেই শুরু হয়ে গেল মৌসুমি চাঁদাবাজি।
×