ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহীন রেজা নূর

একেই বুঝি বলে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৪ জুলাই ২০১৫

একেই বুঝি বলে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’

একেই বুঝি বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ! বিএনপির রাজনীতি আজ যে সঙ্কটে পতিত, তাতে একে প্রকৃতির প্রতিশোধ বলাই সঙ্গত। কেননা, এর জন্মের ইতিহাস এবং পরবর্তীতে এর কর্মধারার মধ্যেই নিহিত রয়েছে আজকের এই সঙ্কটের বীজ। সামগ্রিক বিশ্লেষণে এই সত্যটিই প্রতিভাত হয় যে, জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপি প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ করে এসেছে। ফলে প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই যে আজ প্রতিশোধ নিতে উদ্যোগী হবে, তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমি বিশ্লেষণ করলে আমরা তদানীন্তন পাকিস্তানে আমাদের জনগণের তেইশ বছরব্যাপী সংগ্রাম-সাধনার যে গৌরবদীপ্ত অধ্যায় দেখতে পাই তা এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে যে, আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিবাদী, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সদা নিয়োজিত ছিলাম। তখনকার গণবিরোধী শাসকগোষ্ঠী ধর্মের অপব্যাখ্যা করে এবং আমাদের বাঙালী সভ্যতা-সংস্কৃতির ওপর বার বার আঘাত হেনে যে কৃত্রিম এক পাকিস্তানী তাহজিব-তমুদ্দুন সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল, তা আমরা কখনই হতে দেইনি। আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি এবং স্বকীয় ঐতিহ্যকে নস্যাতের ওই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে এদেশের সংগ্রামী কাফেলা এগিয়ে গেছে দৃপ্ত পদভারে। নিজ ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য রক্ষায় এবং সর্বোপরি অধিকার প্রতিষ্ঠায় এদেশের মানুষ শুধু অকুতোভয়ে এগিয়েই যায়নি, প্রয়োজনে বার বার বুকের রক্ত ঝরাতেও পিছপা হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্র তথাকথিত ইসলাম-পছন্দ দল ও উর্বর মস্তিষ্ক বুদ্ধিজীবীরা বাংলা ভাষা ও শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ইসলামিকীকরণের নামে শান্তিকামী ধর্মপ্রাণ জনগণকে বারংবার বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে শান্তি ও উদারবাদী ধর্ম ইসলামের যাচ্ছেতাই অপব্যাখ্যার মাধ্যমে। এই ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নিজেদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখতে অপশাসন, বঞ্চনা ও শোষণের যাঁতাকল চাপিয়ে দিয়েছিল আমাদের জনগণের ওপর। এজন্য তারা প্রধানত ধর্মের নামে মিথ্যার বেসাতী এবং জুলুম-নির্যাতনের দ্বারস্থ হয়েছে বার বার। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে তারা প্রতিবেশী ভারতের ‘হিন্দু সংস্কৃতির’ প্রভাবমুক্ত করার নামে এমন সব উদ্ভট কা--কারখানা করেছে যা শুধু হাস্যকরই নয়, রীতিমতো অন্যায়ও বটে! একটি জাতি- গোষ্ঠীর আবহমান সংস্কৃতি-চেতনাকে উল্টোদিকে ধাবিত করার অপচেষ্টা যখন মিথ্যা, গোঁজামিল, আর প্রতারণার ফাঁদ পেতে বাংলার মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে চেয়েছে, তখন আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি-চেতনা আপন স্বভাবসিদ্ধ নিয়মেই তার বিরুদ্ধে প্রচ-ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে। বাঙালী সংস্কৃতির বিকাশধারা বরাবরই অসাম্প্রদায়িক চেতনা-লালিত। গুপ্ত, পাল, সেন, মোগল-পাঠান, তুর্কি-আফগান, শাসকদের শাসনামলে বাংলার জনপদগুলো কখনই বড় ধরনের কোন সাম্প্রদায়িকতা-দুষ্ট ছিল না। বরং বৌদ্ধদের অহিংস নীতি, শ্রী চৈতন্যের ভক্তিরস আর ইসলামী সুফীদের মানবতাবাদী জীবন-দর্শনের অপূর্ব সংমিশ্রণে এই সংস্কৃতি-চেতনা অহিংস-অসাম্প্রদায়িক ভাবধারা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। ভারতে সেই প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজায় রাজায় যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে প্রচুর, কিন্তু সামাজিক মানুষের জীবন চর্চায় সেসব যুদ্ধ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করলেও, মানুষে মানুষে সখ্য স্থাপনের ক্ষেত্রে কোন বড় অন্তরায় হয়ে ওঠেনি কখনও। ফলে রাজার পরিবর্তন হলে প্রজাসাধারণের অর্থনৈতিক জীবনের মান ওঠা-নামা করেছে বটে, কিন্তু তার সহমর্মিতাবোধ বা মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করতে পারেনি। এই দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা আবহমানকাল ধরে আমাদের বাঙালী সমাজে লালিত হচ্ছে, আর এটিই বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম শক্তি ও সৌন্দর্য্য! ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গোঁজামিল, মিথ্যা আর নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে জনগণকে অধিকার-বঞ্চিত রাখার হীন কর্মকা- শেষ বিচারে যে পরাজিত হতে বাধ্য, ইতিহাসের এই সত্যটিই বাঙালীরা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে একাত্তরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। অতঃপর পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান গং পুনরায় ইতিহাসের সেই আবহমান ধারাটিকে উল্টোদিকে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। সেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর প্রেতাত্মারা জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে ভর করে স্বাধীন বাংলাদেশের এক শ্রেণীর সেনাশাসক-আমলা-ব্যবসায়ী-বুদ্ধিজীবীর কাঁধের ওপর। নিজেদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখতে এবং তথাকথিত ইসলামী বাংলাদেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পাকিস্তানী ভাবধারা ফিরিয়ে আনতে তৎপর হয় এরা। এদের প্রধান কা-ারীরূপেই আবির্ভূত হয় জেনারেল জিয়া আর পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদ, খালেদা জিয়া প্রমুখ। এরা সবাই আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মৌল দর্শনটিকে নস্যাত করে তদস্থলে পাকিস্তানী ভাবধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য পেইড এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে এবং করে চলেছে। আর এই দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছে এরা বার বার। সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাভোগী একশ্রেণীর মানুষের সহায়তায় এসব তথাকথিত শাসক আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ‘হিন্দুত্ব’ বা ইসলাম বহির্ভূত আখ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে চলে। পাকিস্তান আমলের গণবিরোধী রাজনীতিকেই এদেশে ফিরিয়ে এনেছে পাকিস্তানপ্রেমী জিয়াউর রহমান আর তার অগণতান্ত্রিক ও জগাখিচুড়ি দল বিএনপি। বিএনপিকে তাই আমরা এর জন্মলগ্ন থেকেই এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী যাবতীয় কর্মকা- করতে দেখি। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ জিয়া পাকিস্তানী রাজাকার বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে এমনকি একাত্তরের গণহত্যায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত আলবদর-আলশামস-রাজাকারদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব-বিনাশী যে চক্রান্তের সূত্রপাত ঘটায় তার পাকিস্তানী মুরব্বিদের পৃষ্ঠপোষকতায়, সেই চক্রান্তের নীল-নক্সা বাস্তবায়নকল্পে খালেদা-তারেকের বিএনপি সদা তৎপর থেকেছে এবং আছে। বিএনপির পক্ষে আদর্শভিত্তিক কোন রাজনীতির চর্চা অসম্ভব। কেননা দলটির কোন সুনির্দিষ্ট আদর্শ নেই, থাকার প্রশ্নও ওঠে না। ধর্ম ব্যবসায়ী, অসৎ অসাধু ব্যবসায়ী, সুযোগ সন্ধানী আমলা, পথভ্রষ্ট বাম, আর দেশী-বিদেশী চক্রের এজেন্ট হিসেবে কর্মরত একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর সমন্বয়ে বিএনপি গঠিত হওয়ায় এখানে কোন নির্দিষ্ট ও গণমুখী আদর্শ-চর্চার স্থান নেই। একটি দল সমাজের বহুশ্রেণীর মানুষকে নিয়ে গঠিত হবে, সেটিই স্বাভাবিক। এতে কৃষক-শ্রমিক-শিক্ষক, আইনবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, শিল্পোদ্যোক্তা, ডাক্তার, প্রকৌশলীÑ সর্বশ্রেণীর মানুষই এই ধরনের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। তবে এই জাতীয় সংগঠনের একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শ থাকে বিধায় এর সঙ্গে যুক্ত সকল শ্রেণীর মানুষের মননে ও চেতনায় সেই আদর্শ বোধটিই সর্বদা লালিত হওয়ার অবকাশ পায়। ফলে সকলেই ওই আদর্শতাড়িত হয়ে দলের বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নেয়। আমরা ছেষট্টি বছর আগে সৃষ্ট আওয়ামী লীগ সংগঠনটিতে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত যে ধরনের আদর্শের চর্চা দেখেছি এবং এর নেতাকর্মীদের মাঝে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও সংগ্রামী ভূমিকা পালনের ব্যাপারে ত্যাগী মানসিকতার প্রকাশ দেখেছি, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। আদর্শনিষ্ঠা ব্যতীত কোন ব্যক্তি, দল এমনকি সমাজও এগিয়ে যেতে পারে না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অসাম্প্রদায়িক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য জীবনপণ সংগ্রাম করতে পেরেছিল নেতাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়-দৃঢ় সংগ্রামী চেতনার কারণে। কিন্তু পঁচাত্তর উত্তর বাংলাদেশে দলটির মধ্যে নানা কারণেই আদর্শচ্যুতির লক্ষণ ফুটে উঠতে দেখা গেছে। যাক, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রইল। বলছিলাম, বিএনপির পক্ষে কোন আদর্শভিত্তিক রাজনীতি সম্ভব নয়। যাদের নিয়ে দলটি গঠিত হয়েছে, তাদের অধিকাংশেরই মূল লক্ষ্য হচ্ছে দ্রুত অর্থবিত্তে বেড়ে ওঠা আর আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে নস্যাত করতে সর্বদা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে মেতে থাকা। বিএনপি তাই যতবারই ক্ষমতারোহণ করেছে ততবারই তার পেছনে ছিল বড় ধরনের সূক্ষ্ম ও স্থূল চক্রান্ত। হত্যা-ক্যু, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, মিথ্যা ও গোঁজামিলকে আশ্রয় করে ক্ষমতা লাভের পর প্রতিবারই বিএনপি বাঙালী সংস্কৃতি-চেতনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ তথা আমাদের বীরত্বপূর্ণ গৌরব গাথাকে হেয় করার সর্বাত্মক প্রয়াসে লিপ্ত থেকেছে। আর তা করেছে পাকিস্তানী আমলের ধর্মব্যবসায়ীদের উত্তরসূরিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এবং বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করে কৃত্রিম এক জাতীয়তাবাদ তৈরির অপচেষ্টায় মেতে থেকে। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ছিলেন। তার এবং তার দলের রাজনীতি পর্যালোচনা করলেই এই সত্যটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে বৈকি! সুতরাং, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে যেসব কথা বলে, তা নিছক মতলবী-গোষ্ঠীর স্বার্থ চরিতার্থ করার অপকৌশল মাত্র! একাত্তরে যিনি পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন, তিনি কি করে ক্ষমতায় গিয়েই রাজাকারদের রাজনীতিতে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করেন, এ প্রশ্নটি তলিয়ে দেখতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। হানাদারদের সবচেয়ে বড় এদেশীয় দোসর গোলাম আযম গংকে কি অভিনব উপায়েই না জিয়াউর রহমান সেদিন এদেশের মাটিতে জায়গা করে দিয়েছিলেন। তিনি যে কাজ করেছেন, তা বাঙালীবিরোধী আইয়ুব-মোনেম-ইয়াহিয়া-টিক্কা-গোলাম আযমদের কৃত পাপাচারের সঙ্গেই তুলনীয় কেবল! এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের চেয়েও জিয়ার অপরাধ ও পাপের বোঝা অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হবে। জিয়া ক্ষমতায় এসেই পাকিস্তানী হানাদারদের এদেশীয় দোসর হিসেবে পরিচিত ঘাতকদের পুনর্বাসনের পথ তৈরি করলেন পঁচাত্তরের ডিসেম্বরে দালাল আইনটি বাতিল করে দিয়ে। বিচারপতি সায়েমকে শিখ-ী সাজিয়ে ডেপুটি চীফ মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্টেটর জিয়াউর রহমানই প্রকৃত প্রস্তাবে পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে রাজনীতিকে কলুষিত করলেন, যুবশক্তিকে লোভ-লালসার নিগড়ে বেঁধে ফেললেন, সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রিন্সেস লাকী খানদের আমদানি করলেন আর রাজনীতিতে তার নিজের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানসিকতাসম্পন্ন লোকজনদের জায়গা করে দিলেন। যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি স্বপক্ষে আনতে পেরেছিলেন পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতেই ছিল এদের অধিকাংশের অবস্থান। আসলে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের জয়লাভকে এরা ভারতের বিজয় এবং তাদের মনের গহীনে পাকাপোক্ত আসন করে নেয়া সাধের পাকিস্তানের পরাজয় হিসেবেই বিবেচনা করেছে। তাই ভারত বলতে এরা বোঝে (বা নিজেদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখতে এরা মিথ্যাচার করে বেড়ায়) ‘ইসলাম-বিদ্বেষী’ একটি রাষ্ট্র এবং পাকিস্তান এদের চোখে ‘ইসলামের রক্ষক’। সুতরাং, একাত্তরের যুদ্ধে ভারতের সহায়তা-সহযোগিতায় বাঙালীর বিজয়কে এরা মুসলমানদের পরাজয় হিসেবে দেখে থাকে। আর তাই মুসলমানদের আবার বিজয়ী করতে তারা পাকিস্তানীদের চর হিসেবে প্রাণপাত করে চলেছে। একাত্তরের পরাজিত ওই তথাকথিত মুসলিম চেতনার ধারকরাই বিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পরাভূত ও ভারতের ‘পরাজয়’ নিশ্চিত করে ইসলাম কায়েমের জন্য অষ্টপ্রহর মানবতাবিরোধী কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মাটিতে যেসব কুকীর্তি ও নৃশংসতা পাক হানাদার এবং তাদের এদেশীয় দোসররা চালিয়েছিল, তার বিচার চাওয়া তো সভ্যতা ও মানবতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত এত বড় দুষ্কর্মের বিচার চাওয়া দূরে থাক, যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে সদা তৎপর। বেগম জিয়া কিভাবে জামায়াতী-হেফাজতীদের বুক চেতিয়ে গলা ফাটিয়ে সমর্থন দেন, তাতো এদেশের মানুষ সর্বক্ষণই দেখতে পাচ্ছে। এত বড় অন্যায়কে তিনি এবং তার সাঙ্গাতরা সমর্থন করেন নিছক প্রভুদের মনস্তুষ্টি ও নিজেদের মতলবী স্বার্থ উদ্ধারের নেশায়। বিএনপি রাজনীতির আদ্যপান্ত শুধু গোঁজামিল, মিথ্যা আর ষড়যন্ত্রে ভরা। ইদানীং বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মঈন খান, ব্যারিস্টার মওদুদের খানিকটা হুঁশ হতে দেখা যাচ্ছে। বেগম জিয়ার জামায়াতপ্রীতি যে বিএনপির আজকের দুরবস্থার অন্যতম কারণ, এতদিনে তা তারা শনাক্ত করতে পেরেছেন। অবশ্য, জামায়াতপ্রীতি যে আখেরে দলের জন্য বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, এমনটা তারা আগে বুঝতেন না তা কিন্তু নয়! তখন জামায়াতের সান্নিধ্যে থেকে দলকে ‘শক্তিধর’ বলে মালুম হওয়ায় তারা বিষয়টি নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করা উচিত মনে করেননি। কেননা, এই ‘শক্তিময়তার’ বদৌলতে বিএনপি নেতাকর্মীদের দুনিয়াবী আরাম-আয়েশ ও কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখাটা অধিকতর সহজ বিবেচিত হওয়ায় তারা এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন ইচ্ছে করেই বোধ করেননি। আজ অবস্থা বেগতিক দেখে তারা একে একে মুখ খুলছেন। অথচ অতীতে জামায়াতের সাফাই গাইতে এরাও কিন্তু কেউই কম যাননি। ড. বদরুদ্দোজারা আজ বলছেন যে, জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা থেকে বিচ্যুতিই খালেদা নেতৃত্বের দুর্দশার জন্য দায়ী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯ দফা কর্মসূচী বা জিয়ার রাজনীতির সঙ্গে খালেদা গং তথা আপনাদের রাজনীতির কোন গুণগত পার্থক্য আছে কি? আসলে উভয়ের ক্ষেত্রেই যা সত্য বলে প্রতিভাত হয় তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করা। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানী ভাবধারার রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনা। আর এ জন্য প্রবলভাবে ভারতের বিরুদ্ধাচরণ বা ভারত বিরোধিতাকেই তারা সর্বাপেক্ষা উত্তম উপায় বলে মেনে চলে। তাই মুক্তিযুদ্ধ আর ভারতকে অপরাধীর কাতারে দাঁড় করিয়ে চেতনায় পাকিস্তানকে ফিরিয়ে আনার জন্য একের পর এক মিথ্যা ও চক্রান্তের জাল বুনে চলে এরা। কিন্তু এ তো প্রকৃতির বিরুদ্ধতা ছাড়া কিছু নয়, আর সে কারণেই বোধ করি প্রকৃতি স্বয়ং বিএনপির ওপর প্রতিশোধ নিতে তৎপর আজ! লেখক : সাংবাদিক
×