ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একুশ শতক ॥ হাওড় বাংলার রূপান্তর

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১২ জুলাই ২০১৫

একুশ শতক ॥ হাওড় বাংলার রূপান্তর

॥ চার ॥ সমগ্র হাওড় এলাকার সাধারণ চিত্র ছিল প্রতিবছর চৈত্র মাসে পুরো এলাকায় দুর্ভিক্ষ বিরাজ করত। গ্রামের মানুষের কাছে সুপেয় পানি বলতে কিছু ছিল না। স্যানিটেশন ব্যবস্থা নামক কিছু কেউ জানত না। মাঠে ঘাটে নদীর পাড়ে মলমূত্র ত্যাগ করা অতি সাধারণ ঘটনা ছিল। কোন কোন বাড়িতে কাঁচা ল্যাট্রিন থাকত, যার উন্মুক্ত পরিবেশ ল্যাট্রিন না থাকার চাইতেও ভয়ঙ্কর ছিল। ভোরে গোপাটের পাশে, নদীর পাড়ে লাইন ধরে বসে থাকা একটি সাধারণ চিত্র ছিল। আমার গ্রামটিতে এক সময়ে সংস্কৃত টোল থাকলেও সাধারণ শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না। প্রায় দুই শ’ বছর আগে গ্রামে প্রথমে একটি মক্তব চালু হয়। আমার দাদা আলিমুদ্দীন মুন্সি সেটি চালু করেন। সেই মক্তবে তিনি গ্রামের ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। এরপর দাদার আমলেই তার নিজের জমিতে চালু হয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমি সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়েরই ছাত্র। এক সময়ে কবরস্থান ছিল না বলে মানুষের লাশ নদীতে বা হাওড়ের পানিতে ভাসিয়ে দিতে হতো। পরে দাদা নিজের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থান গড়ে তোলেন। দাদার জমিতেই কবরস্থান ও ঈদগাহ দুটিই পাশাপাশি গড়ে ওঠে। বাবাই গড়ে তুলেন দুটি-ই। আমি যখন ১৯৬০ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি তখন আমার সঙ্গে আমাদের গ্রামের একজন ছাত্র ছিলেন। তার নামটা মনে আছে মোহন মিয়া। পাশের গ্রামের দুইজন মহরম আর সফর আলী ছাড়াও বাইরে থেকে আমাদের গ্রামের মামার বাড়িতে বেড়াতে আসা একজন ছাত্রী আমেনাও আমার সঙ্গে পড়তেন। পুরো গ্রামটা খালে ভরা ছিল। মানুষ এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি সাঁকোতে যেত। কৃষিপ্রধান বলে গরু-বাছুরতো ছিলই- জ্বালানির জন্য গোবরের চট লেপা একটি অতি সাধারণ কাজ ছিল। গ্রামে একটি হাট ছিল। সেই হাটে কাপড় কাচার বল সাবান, তেল, গুড় ও অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ছাড়া আর কিছু পাওয়া যেত না। যারা বাংলাদেশের হাওড় এলাকা সম্পর্কে জানেন তাদের অবহিত থাকার কথা যে, এলাকাটি কেবল নি¤œাঞ্চল নয়, প্রত্যন্ত ও দুর্গম। ভৈরব রেল সেতুর নদী শাসনের জন্যও এ এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। সম্ভবত হাজার বছর আগেও এখানে কোন বসতি ছিল না। গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এ অঞ্চলটি জঙ্গলাকীর্ণ থাকায় মানুষ বসবাস করতে পারত না। স্থানীয়রা সংখ্যায় কম থাকায় এখন বস্তুত এই আবাদীদেরই প্রভাব বেশি। মূলত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা অধ্যুষিত এ এলাকায় এখন অবশ্য আবাদী-মুসলমানের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেশি। হাওড় এলাকার সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল যে সেখানে একটি মাত্র ফসল হয়। শিলাবৃষ্টি বা অকাল বন্যায় ফসল নষ্ট হলে এলাকার মানুষের বেঁচে থাকার উপায় আর ছিল না। কিন্তু এখন সেই অবস্থাটি আর কাজ করে না। আমার গ্রামের মানুষের অর্ধেকেরও বেশি এখন আর এক ফসলী চাষের ওপর নির্ভর করে না। একজন আমাকে জানালেন, কেবল ঈদের চাঁদে নয়, এখন বছরের সব দিন এই গ্রামে বাইরে থেকে টাকা আসে। সেই এলাকাটির নতুন রূপ এরকমÑ গ্রামের একটি ঘর পেলাম না যেখানে বসতে দেয়ার জন্য চেয়ার নেই। একটি ঘর পেলাম না যেখানে এক বা একাধিক পড়ার টেবিল নেই। উদোম গতরের শিশু, জুতাহীন ছাত্রছাত্রী কিংবা পাকা পায়খানাবিহীন বাড়ি নজরে পড়েনি। সকালে কয়লা বা ছিটকিনির ডাল নয়; ওরা এখন টুথব্রাশ আর টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজে। নলকূপের পানি খায় নাÑ এমন একটি মানুষও চোখে পড়ল না। পুরো এলাকার চারটি গ্রাম ঘুরে আমি একটি ছনের ঘর পেলাম না। সত্যি সত্যি কৃষ্ণপুর গ্রামতো নয়ই তার পাশের গ্রাম কল্যাণপুর, মামুদনগর, আমানীপুর; কোথাও একটি ছনের ঘর নেই। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের নিজেদের একটি টিনের ঘর ছিল। পরে সেখানে পাকা ঘর হয়েছে। তখন বাড়ির রায়তরা ছনের ঘরে থাকত। এখন ওদের ঘরও টিনের। মনে পড়ে, প্রতিবছর কার্তিক মাসে কলেরার মহামারী লেগেই থাকত। গ্রামের পর গ্রাম কলেরায় উজাড় হয়ে যেত। বাবাকে দেখতাম দিনের পর দিন মানুষের বাড়িতেই থাকতেন। এখন সেখানে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রতো আছেই গ্রামের বাজারসহ সব বাজারেই আছে ফার্মেসি। রোগাক্রান্ত মানুষ চোখে পড়ল না একটাও। ওই গ্রামেরই দুটি মেয়ে ডাক্তার হয়েছে। ওরা আব্দুল জব্বার তালুকদারের নাতনি। এই দুইজনের একজন নাইজেরিয়ায় এবং অন্যজন নেদারল্যান্ডে। গ্রামের আরও আধাডজন ছেলেমেয়ে ডাক্তারি পড়ছে। একজন ছেলে ডাক্তার ফেনীতে সরকারী হাসপাতালে কাজ করে। গ্রামের বাজারে একগাদা কম্পিউটারের দোকান। আছে মোবাইলের দোকান; বিক্রি আর মেরামত দুটোই হয় এসব দোকানে। প্রতি সপ্তাহে বাজারে মাল আসে কোটি টাকার। বিলাসী তরল পানীয় থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবজির কোনটাই বাদ যায় না। এমনকি ফার্মের মুরগি, পুুকুরের পাঙ্গাস বা রসায়নে ভরা আমের রমরমা বাজার জমে ওঠে প্রতিদিন। এই গ্রামের মানুষ চৈত্র মাসে কচু-ঘেচু খেয়ে বেঁচে থাকত। এখন কচু-ঘেচুতো দূরের কথা, অভাবের চেহারা দেখে না কেউ। এখন সেই গ্রামে কখনও কোন মাসেই অভাব আসে না। গ্রামের কামলাদের মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকার কাছাকাছি। বর্ষায় যখন কাজ থাকে না তখন ওরা চলে আসে গ্রামের বাইরে। সেখানেও দিনে ৮০০ টাকা পর্যন্ত কামাই করা যায়। শুধু ঈদের সময় গ্রামে রেমিটেন্স আসে কোটি টাকার। শিক্ষার হার পৌঁছেছে হাওড় এলাকার সর্বোচ্চ। গ্রামের শতভাগ শিশু স্কুলে যায়। যে গ্রামে হাই স্কুল ছিল না সেই গ্রামে একটি ছেলেদের ও একটি মেয়েদের হাইস্কুলের পাশাপাশি একটি ডিগ্রী মাদ্রাসা ও একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ রয়েছে। তিনটি কেজি স্কুল এবং তিনটি প্রাইমারি স্কুল তো আছেই। গ্রামের একটি প্রাইমারি স্কুলে পেলাম একজোড়া ভাইবোনকে। ওদের বাবা দিনমজুর। বোনটা ফাইভে আর ভাইটা ফোরে পড়ে। মেয়েটার ইচ্ছা সে ডাক্তার হবে আর ছেলেটা হবে শিক্ষক। গ্রামের রাস্তায় দুই দিন হেঁটে হেঁটে স্কুলের ড্রেস পরা শিশুদের দেখে, কথা বলে জানলামÑ অনেকেই কেজি স্কুলে পড়ে। মাসিক বেতন দু’শ টাকা। পুরো গ্রামে মানুষ বাস করে হয়ত ৪ হাজার। অথচ সেই গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া করে তার চাইতে বেশি ছেলেমেয়ে। প্রত্যন্ত হাওড়ের পাড়ে এমনকি মেয়েরা হোস্টেলে থেকে কলেজে লেখাপড়া করছে বহু দূর-দূরান্ত থেকে এসে। এসব রূপান্তর আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। তবে কোন কোন রূপান্তরের বিষয়টি আমার জন্য হজম করাও কঠিন। আমাদের গ্রামেরই মেয়ে হাসিনা আক্তার। দেখা হলো গ্রামের হাটে। একটি সবজির দোকানে বসে আলু মাপছিল। জানতে চাইলাম, কে চালায় দোকানটা? জানাল সে, হাসিনা এবং তার বাবা চালায়। মেয়েটি স্কুলে পড়ে। সেই সময়ে বাবা বসে। স্কুলের পরে সে নিজে বসে। দোকানের হিসাবপত্র সবই সে রাখে। বাবা লেখাপড়া করেনি-কেবল টাকা পয়সা গুনতে পারে। মালপত্র কোত্থেকে আসেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে জানাল, ভৈরব থেকে। ভৈরব হচ্ছে আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় শত মাইল দূরের এক বন্দর। সহজাত প্রশ্ন করলাম, তুমি কি ভৈরব থেকে মাল কিনে আন? না, আমি বা বাবা কেউ ভৈরব যাই না। আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে, তাহলে ভৈরবের মালামাল আসে কেমন করে। হাসিনা একটা মোবাইল ফোন দেখিয়ে বলল, আমাদের জিনিসপত্র আসে এই মোবাইলের অর্ডারে। আমিই মোবাইলে বলে দিই কি কি মাল কতটা দিতে হবে। ওরা ‘আইত্্লা’ (যে নৌকা নিয়মিত মালামাল আনা নেয়া করে) নৌকায় মালামাল দিয়ে দেয়। টাকা দাও কেমন করে? এই প্রশ্নের জবাবে হাসিনা জানাল, সেটাও মোবাইলে? আমি জানি বাংলাদেশে এখন দৈনিক ৩৭০ কোটি টাকা শুধু মোবাইলেই লেনদেন হয়। কিন্তু কৃষ্ণপুর গ্রামের হাসিনা আক্তার বিকাশ হিসাব খুলে এভাবে ব্যবসা করেÑ সেটি আমি ভাবিনি। বাজারে বেশ কয়েকটি বিকাশের দোকান আছেÑ যদিও কোন ব্যাংকের শাখা নাই। হাসিনাই জানাল এই গ্রামের যেসব মানুষ বাইরে থাকে তারা টাকাতো বিকাশেই পাঠায়। আবার যারা বাইরে পড়াশোনা করে বা ওর মতো ব্যবসা করে তারাও বিকাশেই টাকা লেনদেন করে। হাসিনাকে দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না। মনে হচ্ছিল, আমি কৃষ্ণপুরে নয়, কোন এক ভিন্নগ্রহে এসেছি। যে গ্রামে মাত্র ৫০ বছর আগে একজন ছাত্রী পাইনি, সেই গ্রামের সকল মেয়েরা লেখাপড়া করে; আর কিশোরী মেয়ে হাসিনা লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়িতে বসে ডিজিটাল উপায়ে ব্যবসা করেÑ এমনটি আমার নিজের স্বপ্নেই ছিল না। আমি আমার দাদার কথা ভাবি। একদিন খালি হাতে শুধু একটি মক্তব করার সামর্থ্য নিয়ে যিনি এই গ্রামে এসেছিলেন, তার গ্রামটি তিনি এখন যদি দেখতেন তবে চিনতে পারতেন বলে আমার মনে হয় না। এরপরও কি আমরা বলব দেশটা বদলায়নি? এবার যখন এক বছর আগের লেখাটি আবার পড়ছিলাম তখন বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংক নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেন, ২০২১ সালের আগেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব। চারপাশে যখন অগ্রগতি দেখি তখন হেনরি কিসিঞ্জারের কথাই প্রথমে মনে পড়ে। ’৭২ সালে মার্কিন এই নেতা আমাদের তলাহীন ঝুড়ির দেশ বলেছিলেন। এবার আমরা তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট পাস করেছি। সেই দেশে এখন জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ কেবল ছাত্র। ৩০ বছরের নিচের বয়সের মানুষ শতকরা ৬৫ ভাগের ওপরে। (সমাপ্ত) ঢাকা, ৭ জুলাই, ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected] ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×