ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অবশেষে বিধবা মা ও তিন সন্তানের ইচ্ছারই জয় হলো

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১২ জুলাই ২০১৫

অবশেষে বিধবা মা ও তিন সন্তানের ইচ্ছারই জয় হলো

তাহমিন হক ববি, ছিটমহল থেকে ॥ ভারত, না বাংলাদেশের নাগরিকত্ব? স্বামী ফরহাদ হোসেন বলছিল ভারত। আর বিধবা মা, স্ত্রী-সন্তানরা বলছিল বাংলাদেশ। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে লঙ্কাকা- চলছিল গত চার দিন ধরে, তা অবশেষে নিরসন হয়েছে। বিধবা মা জয়গুন বেওয়া, স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগম, তিন সন্তান আলিমুজ্জামান (২৩), আখতারুজ্জামান (১৬) ও আফরোজা আক্তারের (৭) সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়ে ছিটমহলের জনগণনার ষষ্ঠ দিন শনিবার ফরহাদ হোসেন নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের মধ্যে থাকা ভারতীয় ২৮ নম্বর বড়খানকীবাড়ী খারিজা ছিটমহলের জনগণনার ক্যাম্পে এসে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চেয়ে সপরিবারে নিবন্ধন করেন। ফরহাদ হোসেনের সপরিবারে জনগণনার নির্দিষ্ট ফরম পূরণের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন জনগণনা পরিদর্শনে আসা রাজশাহীস্থ ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার সন্দ্বীপ মিত্র ও ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম। উল্লেখ্য, জনগণনার দ্বিতীয় দিন গত ৭ জুলাই ফরহাদ হোসেন জনগণনা ক্যাম্পে সপরিবারে উপস্থিত হয়ে ভারতের নাগরিক হতে নিবন্ধন করার আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু তা কঠোরভাবে নাকচ করেছিল বিধবা মা, স্ত্রী-সন্তানরা। এ নিয়ে জনগণনা ক্যাম্পে তাদের মধ্যে শুরু হয়েছিল প্রচ- তর্কবিতর্ক। বিধবা জয়গুন বেওয়া তখন বলেছিলেন, ‘স্বামী জাফর আলী ১৯৭৩ সালে মইরা গেছে। স্বামীর কবর ছেড়ে কই যামু। বাকি জীবনটা স্বামীর কবর ধইরা জয়বাংলার দেশ থাকবার চাই।’ ফরহাদ হোসেনের স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগম বলেছিলেন, ‘জয়বাংলা শুনতেও ভাল লাগে, বলতেও ভাল লাগে। তাই এ দেশের (বাংলাদেশ) মায়া ত্যাগ করতে পারব না।’ ফরহাদ হোসেন বলেন, আমার অনেক শক্র। প্রতিপক্ষদের অত্যাচার সহ্য হয় না। তাই ভারতে চলে যেতে চাই। ওই পরিবারের এমন সিদ্ধান্তহীনতা নিয়ে সেদিন আর তাদের নিবন্ধন করেননি জনগণনা ক্যাম্পের ভারতীয় প্রতিনিধি জরিপ দল। তারা তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে সমস্যা সমাধান করে নিবন্ধনের জন্য আসতে বলেন। গত ৮ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠের প্রথম পাতায় ‘জয়বাংলা ছেড়ে কই যামু’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। ওই খবরের সূত্র ধরে স্থানীয় ও ভারতের দুটি প্রতিনিধি দল ফরহাদ হোসেনের ‘অনেক শক্র’ কথার বিষয়টি খতিয়ে দেখেন। তবে ফরহাদ হোসেনের কোন শক্র খুঁজে পাননি তারা। এরপর ঘটনার চার দিনের মাথায় পরিবারের সদস্যরা একমত হয়ে শনিবার দুপুর ১টা ২০ মিনিটে ফরহাদ হোসেন সপরিবারে বাংলাদেশের নাগরিকত্বেরে জন্য জনগণনার ক্যাম্পে নিবন্ধন করেন। এ সময় ফরহাদ হোসেনের বিধবা মা জয়গুন বেওয়া বলেন, শান্তি পাইলাম জয়বাংলার দেশের নাগরিকত্বের নিবন্ধন করতে পেরে। এদিকে দৈনিক জনকণ্ঠের শেষের পাতায় গত ১০ জুলাই ‘এই দেশ ছেড়ে ওই দেশে গিয়ে পরিবার নিয়ে হাবুডুবু খেতে চাই না’ শিরোনামে সংবাদটি দৃষ্টিতে আসে ভারত সরকারের। তাই শনিবার ছিটমহলের জনগণনার ষষ্ঠ দিন পরিদর্শনে এসে রাজশাহীস্থ ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার সন্দ্বীপ মিত্র দুপুর ১২টায় ৩১ নম্বর নগর জিগাবাড়ী ছিটমহলে যান। সেখানে তিনি ভরত চন্দ্র রায় (৪৭), রঞ্জিত কুমার রায় (৪০), সনাতন রায় (৩৫) ও অতুল চন্দ্র রায়ের (৪০) পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার ওই চার হিন্দু পরিবারকে তাদের প্রশ্নের উত্তরে জানান, ‘আপনারা যদি ভারতে যেতে চান, তাহলে আপনাদের ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে জনগণনা ফরমে স্বাক্ষর করতে হবে। যারা ভারত যাবেন তাদের ভারত সরকার আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। পাশাপাশি আপনাদের সার্বিক নিরাপত্তা দেয়া হবে। এছাড়া আপনাদের যাবতীয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন। শুধুমাত্র জমি বিক্রির ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হবে। যারা ভারতে যাবেন তাদের ১ আগস্ট থেকে ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য ট্রাভেল পাস ইস্যু করা হবে।’ এরপর ভরত চন্দ্র রায়ের (৪৭) পরিবারের পাঁচ সদস্য ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে ক্যাম্পে গিয়ে দুপুর দুইটায় নিবন্ধন করেন। তবে ভরতের অপর দুই ভাইয়ের পরিবার এবং অতুল চন্দ্রের পরিবার এখনও কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় তারা নিবন্ধন করেননি। ছিটমহলের জনগণনার ষষ্ঠ দিন শনিবার নীলফামারীতে ১০ পরিবার নিবন্ধন করেন। ৩১ নম্বর নগর জিগাবাড়ি ছিটমহলে একটি পরিবার ভারতের নাগরিকত্ব চেয়ে নিবন্ধন করলেও বাকি ৯ পরিবার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চেয়ে নিবন্ধনে অংশ নেন বলে জরিপকারীরা জানান। এদিকে নীলফামারীর ছিটমহলের জনগণনা ক্যাম্প শনিবার পরিদর্শন করেন ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার সন্দ্বীপ মিত্র। তিনি জরিপ কাজের অগ্রগতি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। পঞ্চগড় ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করার জন্য তাড়াহুড়ো করে নাম নিবন্ধনসহ ছবি তুলে নির্দিষ্ট ফরমে স্বাক্ষর করার পর এখন আর ভারতে যেতে চাইছেন না সদর উপজেলার এক ছিটমহলের চার পরিবার। সিদ্ধান্ত বদলের কারণ হিসেবে তারা বলেন, আবেগপ্রবণ হয়ে ভারতে যাওয়ার ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এখন আর ভিটেমাটি ও দেশের মায়া ত্যাগ করে ভিন দেশে যেতে মন চাইছে না। তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এ দেশেই থেকে যেতে চাই। অভিযোগ উঠেছে, ছিটমহল সংলগ্ন বিশেষ একটি মহলের প্ররোচণায় সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের লোকজন ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য নাম নিবন্ধন করেন। ছিটমহলের নাগরিকরা কোন দেশে থাকতে চান তা নিয়ে কোন চাপ বা প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগটি সত্য নয় বলে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। তারা জানান, নিজেদের ইচ্ছায় ছিটবাসী তাদের দেশ বেছে নিচ্ছেন। এখানে কারও কোন জবরদস্তি বা ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে না। সদর উপজেলার গারাতী ছিটমহলে শনিবার দুপুরে সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে জানা যায়, এ ছিটমহলের পাঁচ পরিবারের ১৮ জন ভারতে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট আবেদন ফরমে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু শনিবার সকালে চার পরিবার তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এদেশেই থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন। গারাতী ছিটমহলের নাগরিক পলাশ চন্দ্র বলেন, তাড়াহুড়ো করে ভারতে যাওয়ার ফরমে স্বাক্ষর করেছি। এখন বাবা-মাসহ পরিবারের অন্যরা এদেশে থেকে থেকে যাওয়ায় আমিও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দেশেই থাকতে চাই। একই ছিটমহলের নাগরিক জগন্নাথ বলেন, একপ্রকার আবেগপ্রবণ হয়েই ভারতের নাগরিকত্ব নিতে চেয়েছিলাম। আমার সিদ্ধান্তটি ভুল হয়েছে বুঝতে পেরে এখন বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার আবেদন করি।
×