ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধী বিচার

তিন মামলায় অর্ধ শতাধিক রাজাকারের বিরুদ্ধে ঈদের পর তদন্ত রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১২ জুলাই ২০১৫

তিন মামলায় অর্ধ শতাধিক রাজাকারের বিরুদ্ধে ঈদের পর তদন্ত রিপোর্ট

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কক্সবাজারের মহেশখালী, নোয়াখালীর সুধারাম ও কিশোরগঞ্জের নিকলীর তিন মামলায় অর্ধ শতাধিক রাজাকারের বিরুদ্ধে ঈদের পরপরই তদন্ত রিপোর্র্ট প্রদান করবে তদন্ত সংস্থা। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন তদন্ত করেছে, তদন্ত করতে গিয়ে বেশ কিছু নতুন রাজাকারের নাম আসায় নতুন করে আবারও তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সূত্রে এ খবর জানা গেছে। এই তিন মামলার পাশাপাশি আরও পাঁচটি মামলার তদন্ত চলছে। সেগুলো হলো, হবিগঞ্জের লাখাই থানার লিয়াকত আলী, গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানীর এনায়েত মোল্লা, পটুয়াখালী সদরের আয়নাল খাঁ এবং গলাচিপার মোঃ আস্রাব আলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের এমদাদুল হক ওরফে টাক্কাবালী। সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটরগণ জানিয়েছেন, এ মামলাগুলোর তদন্ত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত শেষ হলেই এগুলোর রিপোর্ট প্রদান করা হবে। তবে এগুলো এখনও দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমাদের হাতে বেশ কিছু মামলা রয়েছে। কিছু মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। মহেশখালীসহ কয়েকটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ঈদের পর দিতে পারব বলে আশা করছি। হাতের মামলাগুলো শেষ হলে নতুন করে আরও মামলার তদন্ত শুরু করা হবে। আমরা একের পর এক মামলার তদন্ত করে যাচ্ছি। যাচাই বাছাই করেই মামলা হাতে নিতে হয়। সে ক্ষেত্রে একটি মামলা হাতে নিতে সাক্ষীসহ নানা ধরনের তথ্য উপাত্ত থাকতে হয়। সে কারণেই দেরি হয়ে থাকে। দ্রুত তদন্ত করে মামলা পাঠালে তা অনেকাংশেই অসমাপ্ত থেকে যাবে। মহেশখালীর রাজাকার সালামত উল্লাহ খানের মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে প্রায় ৭৫ জন রাজাকারের নাম এসেছে। এদের মধ্যে ৩২ জন রাজাকার মারা গেছে। বাদবাকি ৪৩ জন রাজাকারের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে তেমন বড় ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্মান্তরিতসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় ধাপে আরও ২৪ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে আরও তদন্ত করা হবে। ট্রাইব্যুনাল মহেশখালীর ১৯ রাজাকারের বিরুদ্ধে দুই ধাপে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে আসামি শামসুদ্দোহা কারাগারে অসুস্থ হওয়ার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ১২ জন এখনও পলাতক রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মামলার প্রসিকিউটর রানাদাশ গুপ্ত জনকণ্ঠকে বলেন, মামলা তদন্ত অনেকদূর এগিয়েছে। তদন্ত সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করেই আমরা কাজ করছি। সেই মতে আমি বলতে পারি মহেশখালী মামলার তদন্ত রিপোর্ট ঈদের পরপরই দেয়া হতে পারে। ইতোমধ্যে গ্রেফতারকৃত কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর ৬ রাজাকারকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্ত সংস্থার সেফ হোমে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের যে কোন সময় সুবিধা মতো এক সময়ে তদন্ত সংস্থার সেফ হোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। যাদের জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে তারা হলেন, সালামত খান, উল্লাহ খান ওরফে আঞ্জুবর ওরফে ‘পঁচাইয়া রাজাকার’, মোহাম্মদ রশিদ মিয়া, জিন্নাত আলী, মৌলভী ওসমান গণি, নুরুল ইসলাম ও বাদশা মিয়া। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে কক্সবাজারের মহেশখালীতে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সেখানে শতাধিক লোককে হত্যা করা হয়েছে। গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ হিন্দু ও বৌদ্ধদের মন্দির আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিনশত বছরে পুরনো রাখাইন মন্দির ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। মহেশখালীতে হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে মুসলমান করা হয়েছে। অনেক হিন্দুকে খৎনা করা হলে তারা ইনফেকশনের কারণে মারা গেছে। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হবার পর পুনরায় তারা হিন্দুধর্মে ফিরে এসেছে। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সেখানে তদন্ত করে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। আসামির সংখ্যাও বেড়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম এই মামলার তদন্ত করছেন। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন আশা করছেন শীঘ্রই এ মামলা তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করা হবে। কিশোরগঞ্জের দুই রাজাকার ॥ কিশোরগঞ্জের নিকলির রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মোঃ হুসাইন ও তার সহযোগী মোহাম্মদ মোসলেম প্রধানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হরিদেবনাথ জানিয়েছেন, মামলার তদন্ত কাজ অনেকদূর এগিয়েছে, আশা করা যাচ্ছে ঈদের পর এই মামলার তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করা হতে পারে। ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্তে হত্যা, ধর্ষণ ও অপহরণসহ ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট মামলার প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ জনকণ্ঠকে বলেছেন, ইতোমধ্যে আমরা দুই রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলাম। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মোঃ মোসলেম প্রধানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে কারাগারের পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। মোসলেম প্রধান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিকলি থানা রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মোঃ হুসাইনের সঙ্গে একই মামলার আসামি। এ মামলার আসামি পলাতক সৈয়দ মোঃ হুসাইন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির আসামি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার পলাতক সৈয়দ মোঃ হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর ছোট ভাই। হাসান আলীকে গত ৯ জুন ফাঁসি অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদ- কার্যকরের আদেশ দিয়ে রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। নোয়াখালীর পাঁচ রাজাকার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় নোয়াখালীর সুধারাম উপজেলায় রাজাকার কমান্ডার আমির আহম্মেদ ওরফে আমির আলীসহ ৫ রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগসহ তিনটি অভিযোগ পেয়েছে। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে ঈদের পর তারা এই মামলার তদন্ত রিপোর্ট প্রসিকিউশনে জমা দিতে পারবে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ হেলাল উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা তদন্তে এই ৫ রাজাকারের রিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ পেয়েছি। প্রতিটি হত্যাকা-ের সঙ্গে রাজাকার কমান্ডার আমির আলীসহ ওই ৫ জন জড়িত ছিলেন। তাদের আরও তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে ঈদের পর তদন্ত রিপোর্ট অন্যান্য মামলার মতো সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। সংশ্লিষ্ট মামলার প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জানিয়েছেন, আসামি আমির আলীসহ আরও ৪ জনের বিরুদ্ধে আমরা তদন্ত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের মতো তিনটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্ত সংস্থা রিপোর্ট দেবার পর তা যাচাই-বাছাই করে এক সপ্তাহের মধ্যে ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে। নোয়াখালীর সুধারামে এই ৫ আসামি সেনাবাহিনীকে পথ চিনিয়ে নিয়ে আসে। তারা পিটিআই স্কুলসহ দুই জায়গায় রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল আরও বলেন, আমির আলীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী ও সেনাবাহিনীর লোক প্রায় সুধারামে শতাধিক লোককে হত্যা করেছে। ঈদের পর তদন্ত সংস্থা রিপোর্ট প্রকাশ করার পর আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে তা যাচাই-বাছাই করে ফরমাল চার্জ তৈরি করে ট্রাইব্যুনালে জমা দেব। মীর কাশেম আলীর মামলার রায়ে বলা হয়েছে, যে রাজাকার ক্যাম্পে নির্যাতন করা হয়েছে, সেখানে যারা ছিল তারাও সমভাবে দায়বদ্ধ থাকবে। সে দিক দিয়ে আমির আলী আলীসহ ৫ জন রাজাকার সমভাবে দায়ী।
×