ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পথে পথে চাঁদাবাজি পণ্যবোঝাই পরিবহনে

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১১ জুলাই ২০১৫

পথে পথে চাঁদাবাজি পণ্যবোঝাই পরিবহনে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজশাহী থেকে ফল নিয়ে রাজধানী বাবুবাজার আড়তে পৌঁছতে অর্ধশতাধিক স্থানে একশ্রেণীর অসাধু পুলিশ, সরকারী দলের ক্যাডার ও শ্রমিক নেতাদের ঈদ বকশিশের নামে প্রায় ১৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধের রাস্তায় লালবাগ সেকশন যানজটে আটকা পড়া এক পরিবহনের (ট্রান্সপোর্টের) চালক এ কথা জানান। সেখানে যানজটে আটকে পড়ে আরেক ট্রান্সপোর্টের চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঈদ সামনে। ভোলা থেকে ট্রাকে করে পণ্য আনতে বরিশাল-ভোলা, শিকারপুর দুয়ারিকা, মাওয়াঘাটসহ অর্ধশতাধিক স্থানে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ পরিবহন ব্যবসায়ীরা। আর ঈদ বকশিশের নামে পথে পথে মালবাহী পরিবহন থামিয়ে একশ্রেণীর অসাধু পুলিশের চাঁদাবাজিও এখন ওপেন সিক্রেট। এ কারণে ট্রাকের ভাড়াও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাই ভোলা ও রাজশাহী থেকে পণ্য বোঝাই ট্রাক ভাড়া নেয়া হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা। আগে এ ভাড়া লাগত মাত্র ২৫ হাজার টাকা। মহাসড়কে কোন ধরনের চাঁদাবাজি হবে না বলে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহিদুল হক। রবিবার দুপুরে পুলিশ সদর দফতরে ঈদ-উল-ফিতর ও রমজান উপলক্ষে নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এর দু’দিন পর মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে পুলিশের এক বৈঠকে ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এসএম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান কঠোর ভাষায় জানান, মহাসড়কের চাঁদাবাজদের রেহাই দেয়া হবে না। কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। কোন পুলিশ সদস্য কিংবা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের সদস্যও চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারপরও মাঠ পর্যায়ে একশ্রেণীর পুলিশ সদস্য তার নির্দেশ মানছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিনই রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক কাগজপত্র দেখার নাম করে বিভিন্ন যানবাহন থামিয়ে পুলিশ প্রকাশ্যে ঈদ বকশিশের নামে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি নগরীর পাইকারী ব্যবসার প্রাণকেন্দ্রের পুরান ঢাকার ২০টি পাইকারী মার্কেটে প্রবেশ করার একমাত্র নিরাপদ রুট ঢাকা শহর রক্ষাবাঁধে শত শত মালবাহী যানবাহন থামিয়ে অবাধে চাঁদাবাজি চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, রাজধানীর অভিজাত মার্কেট, বিপণি-বিতান, পাইকারী মার্কেট, নগরমুখী প্রবেশ মুখ, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মহাসড়ক, গাবতলী থেকে মিটফোর্ড বাবুবাজার ১১.৬০ কিলোমিটার রাস্তায় তল্লাশির নামে জায়গায় জায়গায় চেকপোস্ট বানিয়ে একান্তে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। মালবাহী ট্রাক, ট্রলি, পিকআপ, ভ্যানগাড়িসহ নানাভাবে আনা মালামাল যানবাহনে তল্লাশির নামে এরকম কর্মকা- নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, একশ্র্রেণীর পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মী পরিচয়ে একদল লোক ‘ঈদ বকশিশ’ আদায়ের নামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার শিমরাইল ও সোনারগাঁও উপজেলার কাঁচপুর মোড় ও মদনপুর-জয়দেবপুর ঢাকা বাইপাস সড়কে যানবাহনে চাঁদাবাজি চলছে। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মী পরিচয়ে একদল লোক ‘ঈদ বকশিশ’ আদায়ের নামে প্রতিদিন এখানে শত শত গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায়ের কারণে গুরুত্বপূর্ণ ওই মহাসড়কে যানজট অন্য সময়ের তুলনায় আরও বেড়ে গেছে। ২০টি স্পটে চাঁদাবাজি ॥ ঈদকে সামনে রেখে ঢাকা শহর রক্ষাবাঁধে শত শত মালবাহী যানবাহন থামিয়ে অবাধে চাঁদাবাজি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এবার ঈদের বিশাল অঙ্কের টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে সন্ত্রাসীরা। পুরো বেড়ীবাঁধ এলাকা থেকে অন্ততপক্ষে ২০টি স্পটে দৈনিক ৫০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। ৮ থানার কিছু পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা মিলে পুরো রমজান মাসকে ঘিরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা চাঁদা তোলা টার্গেট নিয়েছে। বাঁধের রাস্তা দখল করে শত শত দোকানে পসরা বসানোর ফলে ভয়াবহ যানজটে নগরবাসীর নাভিশ্বাস উঠেছে। ঢাকা বেড়ীবাঁধের এলাকা সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত পাইকার ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পরিবহন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছে আতঙ্কের স্থানে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ এক যুগ ধরে বেড়ীবাঁধের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে বাতি না থাকায় এখানে ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ঈদ কেনাকাটা শেষে অথবা কেনাার জন্য মার্কেটের যাবার সময় বেড়ীবাঁধের রাস্তায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে সব খুইয়ে ঈদ আনন্দ ম্লান হয়ে যায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। এ ব্যাপারে লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মাফিজউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি সেখানে নিজে গিয়ে তদন্ত করে দেখব। রেড়ীবাঁধে চাঁদাবাজি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে ডিসি লালবাগ জানান। সরেজমিন ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধের গাবতলী থেকে মিটফোর্ড বাবুবাজার ১১.৬০ কিলোমিটার দীর্ঘপথ ধরে প্রতিদিন দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে শত শত মালবাহী ট্রাক, ট্রলি, পিকআপ, ভ্যানগাড়িসহ নানা ধরনের যানবাহনে করে হাজার হাজার কোটি টাকার মাল নামায় নগরীর পাইকারী কেন্দ্র পুরান ঢাকার কামালবাগ, সোয়ারীঘাট, চকবাজার, মৌলভীবাজার, বেগমবাজার, চম্পাতলী, বড়কাটারা, ছোটকাটারা, মিটফোর্ড, বাদামতলী, বাবুবাজার, ইসলামপুরসহ প্রায় ২০টি পাইকারী মার্কেটে। সূত্রগুলো জানায়, সারাবছর অপেক্ষার পালা শেষে ব্যবসায়ীরা রমজানের ঈদকে টার্গেট করেন। অধিক লাভ ও বেশি বেচাকেনার আশায় ব্যবসায়ীরা ঈদের মালও তোলেন কয়েকগুণ। এসব মালবাহী পরিবহন বেড়ীবাঁধে প্রায় ২০টি স্পটে চেকপোস্টের নামে রাস্তার মাঝখানে বাঁশ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে প্রকাশ্যে চাঁদা তোলা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। সূত্রগুলো জানায়, দু’দফা থানার ডিউটি বদলের সূত্র ধরে ডবল গ্রুপে চাঁদা আদায় চলে। অনেক ক্ষেত্রেই ডিউটিকালীন দারোগা, কনস্টেবল ও র্সোস মিলে বেড়ীবাঁধের নির্দিষ্ট স্থানের রাস্তায় একই উপায়ে মালবাহী যানবাহন থামিয়ে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শাসকদলীয় প্রভাবশালী নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে আতিপাতি নেতারাও এ থেকে পিছিয়ে নেই। সূত্রগুলো জানায়, ৮ থানা পুলিশের চাঁদাবাজির স্পটগুলো হচ্ছে, দারুস সালাম থানাধীন গাবতলী, আদাবর থানাধীন ঢাকা উদ্যান, মোহাম্মাদপুর থানাধীন মোহাম্মদপুর, রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, হাজারীবাগ থানাধীন শিকদার মেডিক্যাল, নবাবগঞ্জ সেকশন, কামরাঙ্গীরচর থানাধীন হাক্কুল এবাদ বেইলী ব্রিজ ও পাকা ব্রিজের উভয় পাশে, লালবাগ থানাধীন শহীদনগর, বৌবাজার, শ্মশানঘাট, চকবাজার থানাধীন চাঁদনীঘাট শরিফ হোটেলের সামনে, চকবাজার জাহাজ বিল্ডিংয়ের সামনে, ইসলামবাগ আলীরঘাট, সোয়ারীঘাট, কামালবাগ, লবণের কারখানা, নলগোলা, চকবাজার ও কোতোয়ালি থানার সীমান্ত অবস্থিত বাবুবাজার ও মিটফোর্ড সংলগ্ন দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে নদীর তীরের বেড়ীবাঁধে, কোতোয়ালি থানার বাদামতলী ফলের আড়তের সামনে বাকল্যান্ড বাঁধসহ কয়েকটি স্থানে। সূত্রগুলো জানায়, মহাজোট ক্ষমতা আসার পর লালবাগ কিল্লার মোড় থেকে বেড়িবাঁধ বাসস্ট্যান্ড থেকে লোহারপুল পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দুই শতাধিক দোকান তুলে চাঁদা আদায় করছে স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও কামরাঙ্গীরচর থানার প্রভাবশালী নেতা। এখান থেকে প্রতিমাসে তারা লাখ লাখ টাকার ভাড়া তুলছেন। এ রোডটি এখন যানজটের নাভিশ্বাস উঠেছে ৮ লাখ অধ্যুষিত কামরাঙ্গীরচর বাসিন্দার। রমজান ও ঈদকে ঘিরে কামরাঙ্গীরচর প্রবেশদ্বার হাক্কুল এবাদ লোহার ব্রিজ সংলগ্ন শাসক দলীয় ক্লাবে দিনরাত মদ জুয়ার আসর বসে। অভিযোগ আছে এসব স্থান থেকেই সাপ্তাহিক ও মাসিক চাঁদার বড় একটি অংশ পাচ্ছেন লালবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানার উর্ধতন কর্মকর্তাসহ মাঠ পুলিশ। আর নবাবগঞ্জ পার্ক থেকে নবাবগঞ্জ সেকশন ঢাল সংলগ্ন কামরাঙ্গীরচরের প্রবেশ ব্রিজ ঘেঁষে বেড়ীবাঁধের দু’পাশে পাউবোর প্রায় ৫শ’ ফুট প্রশস্ত দীর্ঘ আধা কি.মি. জুড়ে সম্পত্তি দখল করে আবাসন, ফার্নিচার মার্কেট, ব্যাটারির কারখানা, মোটর ওয়ার্কসপ, বাঁশ-মুলির গদি তৈরি করে অবৈধ উপায়ে বিদ্যুত, গ্যাস ও পানি সংযোগের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার ভাড়া তোলা হচ্ছে নবাবগঞ্জের একটি সামাজিক ক্লাবের নামে । লালবাগ বিজিবি ১ নম্বর গেট সিনেমা হলের সামনে টেম্পো স্ট্যান্ডে প্রতিদিন নিষিদ্ধ শতাধিক ব্যাটারি চালিত টেম্পো থেকে চাঁদা আদায় করছে থানার পুলিশের চাঁদা কালেক্টর বখাটেরা। অভিযোগ রয়েছে, রিক্যুইজিশনের ভয় দেখিয়ে এসব স্থানে চাদাঁবাজি করেন ট্রাফিক পুলিশ কনেস্টেবলরা।
×