ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পেট্রোলবোমা মেরে আগুন দিয়ে ॥ গণহত্যা

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১০ জুলাই ২০১৫

পেট্রোলবোমা মেরে আগুন দিয়ে ॥ গণহত্যা

রশিদ মামুন ॥ কোন জনগোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে পরিচালিত হত্যাকা-ই গণহত্যা। বছরের গোড়ার দিকে বিএনপি-জামায়াত জোট রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে নিরীহ মানুষের ওপর হামলা করে। নির্বাচনের দাবি আদায়ের আন্দোলনের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে দেশের নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ। কেবল রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণ করতেই ১৩৪ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরে আরও ৩০০ জন দগ্ধ হয়েছেন। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে সুপরিকল্পিতভাবে এত রাজনৈতিক হত্যার শিকার হয়নি সাধারণ মানুষ। গণহত্যার সংজ্ঞার সঙ্গে নৃশংস এই হত্যাকা-ের কিছুটা অমিল থাকলেও উস্কানির মাধ্যমে নিরীহ মানুষের জীবন এবং সম্পদের ধ্বংসকারী লাগাতার ৯২ দিনের হত্যাকা-কে প্রকারান্তরে এক ধরনের গণহত্যা বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্দোলনের নামে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ চালানোতে বিশ্বব্যাংকের হিসেবে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তবে দেশীয় ব্যবসায়ীদের হিসাবে এর পরিমাণ অনেক বেশি। বিএনপি-জামায়াত জোট আন্দোলনের নামে দুই হাজার পরিবহন জ্বালিয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে এখন যে বিচার হচ্ছে সেখানে সরাসরি কেউ হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করুক আর না করুক তার নির্দেশে হত্যাকা- হলে তার দায় নিতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধীকে। দেশের সাধারণ আইনে দ-বিধিতে কারও নির্দেশে হত্যাকা- সংঘটিত হলে ওই ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। তাহলে রাজনৈতিক নির্দেশে সারাদেশে নির্বিচারে মানুষ খুন এবং সম্পদ ধ্বংস করার দায় কেন সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রধান নেবেন না। জানতে চাইলে দেশে সাংবাদিক ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ২০১৩ সালে যখন ঢাকা হেফাজতের আন্দোলনে পুড়ছিল তখন বেগম জিয়া ঢাকাবাসীকে বেরিয়ে এসে এতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। এটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উস্কানি। যা মানুষের সম্পদ ও জীবন ধ্বংসকারী হয়ে উঠতে পারে। তিনি বলেন, হয়ত সরাসরি এই হত্যাকা-কে গণহত্যার সংজ্ঞার ছকে ফেলা যাবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষকে বেগম জিয়ার কর্মী বাহিনী তাঁর নির্দেশেই হত্যা করেছে। তা জানার পরেও তিনি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বরং উস্কানি দিয়েছেন। এতে সারাদেশে ব্যাপক এই হত্যাকা-ের দায় তিনি কোনভাবে এড়াতে পারেন না। বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৩৫ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। সারাদেশে এসব নাশকতার ঘটনায় মামলা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০টি। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বিষয়টি আরও পরিষ্কার করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন মানুষ হত্যার ঘোষণা যার, দায়ও তার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়েছেন হুকুমদাতা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়াকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর পেট্রোলবোমায় দগ্ধরা আশায় বুক বাঁধছে। এই হত্যাকা-ের এবার সঠিক বিচার হবে। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলাতে হুকুমের আসামি করা হয়েছে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে। এছাড়া বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকর্মীই বিভিন্ন মামলার আসামি। গত বৃহস্পতিবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের জামিন শুনানিতে তাঁর আইনজীবী ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেনকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, যেহেতু আপনারা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, তার ফলে এই গাড়ি পোড়ানো হয়েছে, মানুষ মরেছে, সন্ত্রাসী কর্মকা- হয়েছে। অতএব এর দায়িত্ব আপনাদের নিতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির ঘোষণা দেয়ার পর রাজনীতিবীদরা কোন দায় নেবেন না তা কী করে হয়। তিন মাসে ১৩৪ জন মানুষ মারা গেল তার কোন দায় কী বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ওপর বর্তাবে না এটা হতে পারে না। সরকার দেরিতে হলেও সঠিক পথে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে করছেন পেট্রোলবোমায় দগ্ধ রংপুরের মিনারা বেগম, তিনি বলছেন শরীরের ক্ষত আমার যন্ত্রণা আমার। কিন্তু কেন কোন্ অপরাধে আমাকে এই যন্ত্রণা সারাজীবন ভোগ করতে হবে। যারা আমাদের ওপর হামলা করল তাদের কিছুই হবে না একটাতো ঠিক নয়। বিএনপি-জামায়াতের টানা তিন মাস হরতাল ও অবরোধের সময় চালানো নাশকতায় প্রাণ হারিয়েছে ১৩৪ জন। পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়েছে ৩০০ জনেরও বেশি। এদের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে মোট ১৮১ জন ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে ২২ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যান ১৪১ জন। ৯০ দিনের অবরোধ ও হরতালের মধ্যে সারা দেশে মোট এক হাজার ৯৭০টি যানবাহনে আগুন ও ভাংচুর হয়েছে। মোট ১৬ দফায় ৮০টি স্থানে রেলে নাশকতা হয়েছে। ছয় দফায় নৌযানে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে ভস্মীভূত গাড়ি মালিকদের মধ্যে ৮২৩ জন সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন। এখন পর্যন্ত ১৫৬ জন মালিক ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছেন। সারাদেশে ব্যাপক হত্যাকা-ের পর কেমন আছেন স্বজন হারানোরা খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেছে এতদিনেও বিচারের বাণী নীরবে কাঁদায় অভিমানে আর বিচারও চাইছেন না তাঁরা। এখন তাঁরা কোন ঘোষণা নয় সরাসরি বিচার দেখতে চান। রাজনীতির লোভের আগুনে স্বামী-সন্তান জলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে যশোরের জাসদ নেতা নূরুজ্জামানের স্ত্রী মাফরুহা বেগমের। তিনি ওই সময় এক অনুষ্ঠানে এই হত্যাকা- বন্ধর জন্য রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে তাঁর সেই আহ্বান কেউ কানে তোলেননি। এমনকি এত দিনে তার স্বামী আর সন্তান হারানোর বিচারও হয়নি। এখন তাই মাফরুহার অশ্রু হৃদয়ের আগুনে বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। তারপরও বেঁচে থাকতে হয় জীবন বইছে বলেই। বৃহস্পতিবার তারছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইমতিয়াজ মার্থিনের মাধ্যমে মাফরুহার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। ইমতিয়াজ বলেন, ওই সময় আমাদের বিচারের যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল তার কিছুই তারা এত দিনে দেখতে পাননি। তাই এ নিয়ে কথা বলতে তার মা আর আগ্রহী নয়। কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে কমিল্লায় পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে সন্ত্রাসীরা। এতে যশোরের স্থানীয় জাসদ নেতা নূরুজ্জামানের সঙ্গে তার মেয়ে ফুলের মতো ফুটফুটে মাইশা ঝলসে যায়। গুরুগর আহত হন নূরুজ্জামানের স্ত্রী মাফরুহা বেগম এখনও ধুঁকছেন। ওই সময়ে আলোড়ন তোলে এ হত্যাকা-ের ঘটনা। টানা ৯২ দিনের অবরোধ এবং মাঝে মধ্যে হরতালে ৬০ দিনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব রাখে বিশ্বব্যাংক। সংস্থটি বলছে, প্রথম ৬০ দিনে ২২০ কোটি ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ ১৭ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ওই হিসাবে আরও ৯২ দিনের আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ২৫ হাজার টাকা। যদিও দেশীয় ব্যবসায়ীদের হিসেবে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) মতে, এক দিনের হরতাল-অবরোধে ক্ষতি হয় দুই হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসের হরতাল ও অবরোধের কারণে অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর এফবিসিসিআইয়ের হিসাবে, এক দিনের হরতাল-অবরোধজনিত ক্ষতি দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা। দেশে পলিটিক্যাল কিলিং আর বিপুল এই সম্পদ ধ্বংসের এর কোন দিন বিচার হয় না। স্রেফ বিষয়গুলোকে রাজনৈতিক বলে চালিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু নিরীহ মানুষ কেন এভাবে রাজনীতিবীদের লোভের বলি হবে। রাজনীতিবীদরা কি এভাবে মানুষ হত্যার নির্দেশ দিয়ে বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। আর সেই মানুষের কাঁধে ভর দিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসে মানুষের মাথার ওপর ছড়ি ঘুরাবেন। না কি এর কোন স্থায়ী সমাধান হবে। দেখা যায় বেগম জিয়া আদালতে ৫ এপ্রিল মামলায় হাজিরা দিয়ে বাসায় যাওয়ার পর সারাদেশে এক যোগে পেট্রোলবোমা হামলা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর গত মাসে একটি পেট্রোলবোমা হামলা হয়েছে। পুলিশ বলছে ওই হামলা করেছে স্থানীয় জামায়াত-শিবির কর্মীরা। তারা স্বীকার করছে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আশঙ্কায় ওই হামলা চালানো হয়েছে। এছাড়াও মানুষকে ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে রাখতে সাধারণত এক দিন পর পর এসব ঘটনা ঘটানো হতো। ওই সময় পেট্রোলবোমাসহ পুলিশের হাতে যারা ধরা পড়েছে তারাও বিএনপির স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের নির্দেশে এই হামলা করার কথা স্বীকার করেছে। বিএনপি সিটি নির্বাচনমুখী হয়ে উঠলে সারাদেশে একবারে নারকীয় তা-ব বন্ধ হলে দেশবাসীর কাছে আরও স্পষ্ট হয় এসব কিছুর মূলে ছিল বিএনপির নির্দেশ।
×